ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৪৬
দ্য ফার্স্ট ম্যান
দিনের শেষে আলো আর পৃথিবী গ্রাসকারী অন্ধকার নেমে এলে লিসে থেকে ফিরে আসার সময় মৃত্যুর মতো অজানা ভয় জ্যাকের নিত্যসঙ্গী হতো। তার নানি ঝুলন্ত বাতিটা না জ্বালানো পর্যন্ত ওই অন্ধকার কিছুতেই শেষ হতো না। কাচের চিমনি খাবার টেবিলের ওপর নামিয়ে পায়ের আঙুলের ওপর শরীরের ভর রেখে একটুখানি উঁচু হয়ে টেবিলের কোণায় উরু ঠেকিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে মাথা ওপরের দিকে তুলে ছাউনির নিচের বার্নার দেখতেন নানি।
এক হাতে বাতির নিচের দস্তার চাবি ধরে আরেক হাতে জ্বলন্ত ম্যাচের কাঠি দিয়ে সলিতার পোড়া অংশ খসে পড়ে উজ্জ্বল আলো না জ্বলা পর্যন্ত ঘষা দিতে থাকতেন। তারপর তিনি চিমনি ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিতেন। দস্তার প্রকোষ্ঠের খাঁজকাটা পটির সঙ্গে চিমনির ঘষা লেগে চিক চিক শব্দ উঠত। চিমনিটা ওখানে বসিয়ে দিয়ে তিনি আবার টেবিলের পাশে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একহাত ওপরের দিকে তুলে সলিতা ঠিক করে দিতেন। নিচে টেবিলের ওপরে কড়া হলুদ আলো পড়ত নিখুঁত গোলাকার হয়ে। টেবিলক্লথের ওপরে আলোর প্রতিফলন পড়ে নানির মুখের ওপর এবং টেবিলের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে নানির কাজ পর্যবেক্ষণরত জ্যাকের মুখের ওপর পড়ত। আলো যত বেশি উজ্জ্বল হতো তার মনটাও তত হালকা হয়ে আসত।
নানি যখন তাকে অন্ধকার উঠোন থেকে মুরগি আনার আদেশ দিতেন ওই একই রকম ভয় সে জয় করার চেষ্টা করত নিজের ভেতরের অহংকার অথবা গর্বের দ্বারা। এরকম দায়িত্ব পালন করতে হতো ইস্টার কিংবা বড় দিনের আগের রাতে। কিংবা আর্থিক দিক থেকে অবস্থাপন্ন কোনো আত্মীয়ের আগমন উপলক্ষে। তাদের চোখে পরিবারের আসল অবস্থা প্রকাশ না করে বরং মার্জিত ও শালীন অবস্থা প্রকাশ করার চেষ্টা থাকত। কাজটা তাকে করতে হতো সাধারণত রাতের বেলা। জ্যাকের লিসেতে পড়ার প্রথম দিকে নানি একবার যোসেফিন মামাকে বলেছিলেন, মামার রবিবারের ব্যবসায়িক অভিযানের সময় যেন নানির জন্য কয়েকটা আরবের মুরগি এনে দেন।
আর্নেস্ট মামাকে ধরে নানি উঠোনের কোণার দিকে প্যাঁচপেঁচে কাদা মাটির ওপরে একটা মুরগির খাঁচা তৈরি করে নিলেন। নানি সেখানে পাঁচ-ছয়টা মুরগি পুষতেন। মুরগিগুলো নিয়মিত ডিম দিত এবং মাঝে মাঝে এরকম অবস্থায় প্রাণ দিয়ে দিত। প্রথমবার যেদিন নানি একটা মুরগির প্রাণদণ্ড কার্যকর করতে চেয়েছিলেন সেদিন পরিবারের সবাই রাতের খাবার খেতে বসেছিল। তিনি তার বড় নাতিকে হুকুম করলেন দণ্ডিতকে নিয়ে আসতে। কিন্তু লুই (জ্যাকের বড় ভাইকে কখনও কখনও হেনরি বলা হতো, কখনও কখনও লুই বলে ডাকা হতো) সোজাসুজি বলে ফেলল, সে পারবে না। তার ভয় লাগে। নানি এখনকার সময়ের আদুরে বাচ্চাদের প্রতি বিদ্রুপ করলেন এবং উল্লেখ করলেন, তার সময়ের বাচ্চারা বনে জঙ্গলে যেতে ভয় পেত না। তারা কোনো কিছুতেই ভয় পেত না। তিনি জ্যাকের উদ্দেশে বললেন, ওসব বাচ্চাদের চেয়ে জ্যাক অনেক সাহসী। যা, তুই গিয়ে নিয়ে আয়। আসলে জ্যাক অন্য কারো চেয়ে বেশি সাহসী ছিল সেটা সত্যি নয়। তবে হুকুম একবার হয়ে গেছে মানে সে আর না করতে পারবে না। তাকে যেতেই হবে। যা হোক, সে রাতেই প্রথম জ্যাক মুরগি আনতে গেল। অন্ধকারে সিঁড়ি ভেঙে বাম দিকে ঘুরে সব সময় অন্ধকারে থাকা হলরুম পার হয়ে হাতড়াতে হাতড়াতে উঠোনের দিকের দরজাটা খুলে ফেলল। হলরুমের অন্ধকার বাইরের রাতের অন্ধকারের চেয়ে বেশি ঘন। সেজন্য উঠোনে নামার জন্য সবুজ হয়ে যাওয়া চারটে সিঁড়ি বরং আবছা হলেও দেখা যাচ্ছিল। ডান দিকের নাপিত পরিবার এবং আরব পরিবারের ঘরটার খড়খড়ি দিয়ে দুর্বল আলো এসে পড়েছে উঠোনে। উঠোনের এই পাশ থেকেই অন্য প্রান্তে মাটিতে কিংবা নিজেদের বিষ্ঠার স্তম্ভের ওপর ঘুমিয়ে থাকা মুরগিগুলোর ছোপ ছোপ রং আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে। মুরগির খাঁচার কাছে পৌঁছে জ্যাক জাল ঘেরা আচ্ছাদনের ওপর হাত রাখতেই মৃদু কককক শব্দ শুরু হয়ে গেল। তখনই তার নাকের সামনে ঝাপটা মারল বিষ্ঠা থেকে বের হয়ে আসা বমি উদ্রেককারী উষ্ণ দুর্গন্ধ। মাটি লাগোয়া জাফরির দরজা খুলে নিচু হয়ে ভেতরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই ভেতরের নরম এবং আঠালো পদার্থের ওপর হাত পড়ল। তখনই জ্যাক ছিটকে পিছিয়ে এসে হাত বের করে নিয়ে এল। দোদুল্যমান খাঁচাটায় মুরগিগুলোর পাখা ঝাঁপটানোর আকস্মিক শব্দ, দৌড়াদৌড়ি আর সোরগোলের কারণে জ্যাক চমকে ওঠে ভয়ে। তবু তাকে মন শক্ত করতেই হবে। কারণ তাকে অন্যদের থেকে বেশি সাহসী বলে পদবী দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ওই আবর্জনাময় অন্ধকার জায়গার মুরগিগুলোর ভেতর জেগে ওঠা হৈচৈ আর উত্তেজনায় জ্যাক ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তার পাকস্থলী উল্টে যাওয়ার উপক্রম হয়। মাথার ওপরের পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে। আকাশজুড়ে পরিচ্ছন্ন প্রশান্ত তারকারাজি। তারপর এগিয়ে গিয়ে খাঁচার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে নাগালের মধ্যে প্রথম যে পাটা ধরতে পারে সেটা ধরেই একটা সন্ত্রস্ত মুরগি ছোট দরজার কাছে টেনে নিয়ে আসে। আরেক হাত দিয়ে মুরগির আরেক পা ধরে মুরগিটা খাঁচার বাইরে নিয়ে আসে। দরজার পাল্লার সঙ্গে ঘষা লেগে ইতোমধ্যে মুরগিটার কয়েকটা পালক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। ততক্ষণে খাঁচার প্রায় সবগুলো মুরগির ভীত-সন্ত্রস্ত কককক শব্দে কান ঝালাপালা হওয়ার অবস্থা। পাশের ঘরের বৃদ্ধ আরব লোকটা আলো নিয়ে সতর্ক অবস্থায় বের হয়ে এসে জ্যাককে দেখতে পায় এবং জ্যাক তাকে দেখে নিষ্পৃহ কণ্ঠে বলে ওঠে, আমি, এম তাহার। নানির জন্য একটা মুরগি নিতে এসেছি।
লোকটা বলে, ও তুমি! আমি ভাবলাম চোর ডাকাত কি না। বলেই লোকটা ভেতরে চলে যায়। উঠোন আবার অন্ধকারে ডুবে যায়। এবার জ্যাক দৌড়ানো শুরু করে, হাতের মধ্যে মুরগিটা ছটফট করতে থাকে। হলরুমের দেয়াল আর সিঁড়ির ধাপের সঙ্গে বাড়ি খেতে থাকে। হাতের মধ্যে মুরগিটার ঠাণ্ডা, মোটা এবং ক্রমহ্রস্ব পাদুটো নিয়ে জ্যাক আরও দ্রুত দৌড়াতে থাকে। হলরুম পার হয়ে বীরের মতো ভঙ্গিতে ঢুকে পড়ে খাবার ঘরে। দরজায় দাঁড়ানো জ্যাকের চুল উস্কোখুস্কো, উঠোনের শ্যাওলা লেগে হাঁটুর কাছে সবুজ হয়ে গেছে, মুরগিটাকে যতদূর সম্ভব নিজের শরীর থেকে দূরে ধরে আছে। তার মুখটা ভয়ে ফ্যাকাশে। জ্যাকের বড় ভাইকে শুনিয়ে নানি বললেন, দ্যাখ, ও তোর চেয়ে ছোট। কিন্তু ওর সাহসের প্রমাণ দিয়ে তোকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে। নানি মুরগিটা নিজের হাতে নিয়ে শক্ত করে ধরার আগ পর্যন্ত নিজের গর্বে নিজেকে ভালো করে প্রদর্শনের চেষ্টা করতে থাকে জ্যাক। মুরগিটা এবার হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়। মনে হয় বুঝতে পারে, এবার আর কোনো রক্ষা নেই। নির্মম এবং সর্বশেষ হাতে এসে পড়েছে বলে। জ্যাকের ভাই নিরবে ফলার খেতে থাকে। মাঝে দু-একবার জ্যাকের দিকে তাকায় শুধু ভেংচি কাটার জন্য। তাতে জ্যাকের গর্ব এবং সন্তুষ্টি আরও বেড়ে যায়। তবে সেই সš‘ষ্টি খুব সংক্ষিপ্ত হয়। নাতিদের মধ্যে সাহসী হিসেবে একজনকে পাওয়া গেছে দেখে নানি জ্যাককে রান্না ঘরে ডাকেন মুরগিটা জবাই করার কাজে তার সঙ্গে হাত লাগাতে। তিনি ততক্ষণে ঢিলাঢালা এবং বড় একটা নীল রঙের অ্যাপ্রোন পরে নিয়েছেন। মুরগিটা এক হাতে শক্ত করে ধরে আরেক হাত দিয়ে মেঝেতে একটা মাটির গামলা রাখলেন। তার হাতে রান্নাঘরের একটা ছুরি। আর্নেস্ট মামা ওই ছুরিটাতে মাঝে মাঝে একটা লম্বা কালো পাথরের ওপর ঘষে ধার দিয়ে রাখেন। নানি জ্যাককে বললেন, ওই পাশে যা। জ্যাক রান্নাঘরের অপর প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ালে নানি দরজার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়ালেন। মনে হলো, তিনি জ্যাকের এবং মুরগিটার পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন। পেছনের দিকে সিঙ্ক আর বামপাশে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দুরু দুরু বুকে জ্যাক উৎসর্গকারীর সুনিশ্চিত নড়াচড়া দেখতে থাকে। একটা কাঠের টেবিলের ওপরে রাখা বাতিটার নিচে প্লেটটা এগিয়ে রাখলেন নানি। মুরগিটা মাটিতে শুইয়ে দিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে তিনি মুরগির পা শক্ত করে ধরলেন যাতে ঝাঁপটাঝাঁপটি করতে না পারে। তারপর বাম হাত দিয়ে মাথাটা ধরে প্লেটের ওপরে নিয়ে এলেন। ধারালো ছুরি দিয়ে পুরুষ মানুষের যে জায়গাটাতে কণ্ঠমণি থাকে মুরগিটার ঠিক সেখানে ধীরে ধীরে কাটতে লাগলেন। মুরগির মাথাটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ভয়ংকর শব্দের সঙ্গে ছুরি চালালেন। প্রবল বেগে আক্ষেপরত মুরগিটাকে তখনও তিনি খুব শক্ত করে ধরে রেখেছেন। টকটকে লাল রক্ত গড়িয়ে গামলাটাতে পড়ছে। রক্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে জ্যাকের মনে হলো, তার নিজের রক্ত গড়িয়ে পড়ছে; ভয়ে পা কাঁপছে। নানি বললেন, গামলাটা সরিয়ে নিয়ে যা। জ্যাকের মনে হলো, নানি অনেক দীর্ঘ সময় পর কথা বলছেন। মুরগিটার রক্ত পড়া তখন বন্ধ হয়ে গেছে। জ্যাক গামলাটা সযত্নে টেবিলের ওপর রাখল। গামলার ভেতরের রক্ত ততক্ষণে গাঢ় লাল থেকে কিছুটা কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। নানি মুরগিটা গামলার পাশে ধপাস করে রাখলেন। মুরগির পালক চকচকে বর্ণ হারিয়ে অনেকটা বিবর্ণ হয়ে গেছে। চোখের কোঁচকানো পাতা চোখের ওপরে বন্ধ হয়ে গেছে। জ্যাক মুরগিটার নিথর দেহের দিকে তাকিয়ে থাকে: পায়ের নখগুলো কুঁকড়ে জড়ো হয়ে আছে। মাথার ঝুঁটিটা বিবর্ণ হয়ে শিথিল হয়ে গেছে। জ্যাক বুঝতে পারে, মৃত্যু হলো এই। তারপর সে খাবার রুমে চলে গেল।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন
আরএ/