ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৩০
দ্য ফার্স্ট ম্যান
স্কুলের পড়া শেষ হয়ে আসার সময় একদিন এম বার্নার্ড জ্যাক, পিয়েরে, ফ্লিউরি এবং সান্টিয়াগোকে ড্কালেন। প্রথম তিনজন সকল বিষয়ে অসাধারণ পাণ্ডিত্য দেখিয়েছে। সুদর্শন সান্টিয়াগো খুব বেশি মেধাবী না হলেও নিজের চেষ্টায় ভালো করেছে। তাকে উদ্দেশ করে এম বার্নার্ড বললেন, ওর পলিটেকনিক মেধা। ক্লাসরুমের অন্যরা চলে যাওয়ার পরে তিনি ওদের বললেন, তোমরা আমার সবচেয়ে ভালো ছাত্র। এখন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বৃত্তির জন্য আমি তোমাদের নাম প্রস্তাব করব। পরীক্ষায় পাশ করলে তোমরা বৃত্তি পাবে এবং প্রবেশিকা পরীক্ষার মাধ্যমে লিসিতে তোমাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে। বলা হয়, এলিমেন্টারি স্কুলগুলো স্কুলের সেরা। তবে জীবনে কোনো বৃহত্তর দিকে যেতে হলে এলিমেন্টারি স্কুল তোমাদের পথ দেখাতে পারে না। অন্যদিকে লিসিতে পড়াশোনা করলে অনেক দরজা খোলা পাবে। আর আমি চাই তোমাদের মতো দরিদ্র পরিবারের ছেলেরা ওইসব দরজা দিয়ে বাইরের জগতে প্রবেশ করো। তবে সে উদ্দেশে তোমাদের অভিভাবকদের অনুমতি লাগবে। ঠিক আছে, আজকের মতো যাও।
তারা সবাই বিস্ময়াভিভূত হয়ে বের হয়ে এল। এমনকি যার যার পথ ধরার আগে এই বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আর কোনো আলাপ আলোচনাই হলো না। বাড়ি ফিরে জ্যাক দেখল, নানি খাবার ঘরের টেবিলের ওপরের ওয়েলক্লথের ওপরে বিছানো ডাল থেকে পাথর বাছছেন। খবরটা নানিকে দিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেল সে। শেষে সিদ্ধান্ত নিল, মা ফিরলে জানাবে। মা ফিরলেন খুব ক্লান্ত হয়ে এবং ফিরেই একটা অ্যাপ্রোন পরে নানির ডাল বাছার কাজে যোগ দিলেন। জ্যাকও তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা বললে তারা জ্যাককে মোটা চিনা মাটির বাটিতে করে ডাল বাছতে দিলেন। ওই বাটিটাতে ডাল থেকে পাথরের নুড়ি বেছে ফেলা সহজ। ডাল বাছার কাজ শুরু করেই জ্যাক তার খবরটা জানাল তাদের।
শুনে নানি বললেন, এ আবার কোন ধরনের পড়া? এই প্রবেশিকার পড়া পড়তে কয় বছর লাগবে?
ছয় বছর।
নিজের সামনের ডালের প্লেটটা একপাশে সরিয়ে রেখে নানি তার মেয়ের উদ্দেশে বললেন, শুনেছিস কী বলছে জ্যাক?
মা আসলে শোনেননি। জ্যাক ধীরে ধীরে আবারো তার কথাটা বলল এবং মা বললেন, হ্যাঁ, সে বুঝতে পারছি। তুই বুদ্ধিমান বলেই ওরকম পড়ার সুযোগ পেতে পারিস।
নানি বললেন, বুদ্ধিমান হোক আর যা-ই হোক ওকে তো আগামী বছরই কাজকর্মে পাঠাতে চাচ্ছিলাম। জানিস তো, আমাদের টাকা পয়সা নেই। কাজে পাঠালে ও নিজের উপার্জনটা তো আনতে পারবে।
মা বললেন, সেটা ঠিকই।
বাইরে তখন তাপের তেজ কমে আসছে। দিনটাও ফুরিয়ে আসছে। দিনের এই সময়টাতে শুধু কারখানায় কাজ চলছে। পাড়ার সব কিছু নীরবতায় ঢাকা। জ্যাক রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে জানে না তার কী চাই। শুধু জানে, এম বার্নার্ড যা বলেছেন সেটাই মানতে হবে। তবে নয় বছর বয়সে নানিকে না মানার কোনো উপায় নেই, ইচ্ছেও নেই। তখনও নানি দ্বিধান্বিত; তিনি বললেন, তারপর কী করবি তুই?
আমি জানি না। হতে পারে, এম বার্নার্ডের মতো কোনো শিক্ষক হবো।
ছয় বছর পড়েই, হ্যাঁ। তার ডাল বাছার গতি আরো ধীর হয়ে এল। তারপর আবার বললেন, না, মোটের ওপর আমরা তো গরিব। এম বার্নার্ডকে বলিস আমরা পারব না।
পরের দিন বাকি তিনজন জ্যাককে জানাল, তাদের পরিবারের সবাই রাজী হয়েছেন। তারা জ্যাকের খবর জানতে চাইলে জ্যাক বলল, জানি না। বাকি তিনজনের চেয়ে সে আরো গরিব। এই ভাবনাটাই তাকে মনের দিক থেকে আরো তলিয়ে দিল যেন।
স্কুল ছুটির পর সবাই চলে গেলে ওরা চারজন অপেক্ষা করতে লাগল। পিয়েরে, ফ্লিউর এবং সান্টিয়াগো তাদের কথা এম বার্নার্ডকে জানিয়ে দিল। তারপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আর তোমার খবর কী পণ্ডিত?
আমি জানি না।
তিনি জ্যাকের দিকে তাকালেন। বাকি তিনজনকে বললেন, ঠিক আছে, তোমাদের কিন্তু স্কুল ছুটির পর বিকেলে আমার সঙ্গে আরো পড়তে হবে। আজ আপাতত যাও। ওরা চলে গেলে তিনি চেয়ারে বসে জ্যাককে আরো কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে?
জ্যাক বলল, নানি বলেছেন, আমরা খুব গরিব বলে ওই পড়াটা আমার আর হবে না। আগামী বছর থেকে আমাকে কাজ করতে হবে।
আর তোমার মা?
সবকিছু নানির সিদ্ধান্ত মোতাবেক চলে।
জানি, বলে এম বার্নার্ড খানিক কী যেন ভাবলেন। তারপর জ্যাকের কাঁধের ওপর হাত রেখে বললেন, শোনো ওনাকে দোষ দেওয়া যায় না। তার জন্য জীবন খুব কঠিন। কী রকম নিঃসঙ্গ অবস্থায় তোমাকে, তোমার ভাইকে বড় করছেন তারা দুজন। তোমরা যে এত ভালো ছেলে হয়েছো তার জন্যই। সুতরাং তার সাহসহারা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বৃত্তির টাকা ছাড়াও আরো সামান্য কিছু টাকা তোমার দরকার হবে। আর ছয়টা বছর তুমি পরিবারকে কোনো টাকা পয়সা দিতে পারবে না। তার অবস্থাটা বুঝতে পারছ? শিক্ষকের দিকে মুখ না তুলেই জ্যাক শুধু মাথা নেড়ে সায় দিল। এম বার্নার্ড বললেন, ভালো। আমরা তো বিষয়টা ওনাকে বুঝিয়ে বলতে পারি। তোমার ব্যাগ নাও। আমি তোমার সাথে আসছি।
আমাদের বাড়িতে?
হ্যাঁ, অনেক দিন পর তোমার মায়ের সাথে দেখা হলে ভালোই লাগবে।
কয়েক মিনিট পরই বিস্মিত জ্যাকের সামনে দাঁড়িয়ে এম বার্নার্ড তাদের দরজার কড়া নাড়লেন। অ্যাপ্রোনে হাত মুছতে মুছতে দরজায় এলেন জ্যাকের নানি। অ্যাপ্রোনের ফিতা বেশি আঁটো করে বাধার কারণে তার বুড়ি বয়সের পেটটা সামনের দিকে বেরিয়ে এসেছে। জ্যাকের শিক্ষককে দেখে তিনি এমন অঙ্গভঙ্গি করলেন যেন তার চুল হাত দিয়ে পেছনের দিকে সরিয়ে দিচ্ছেন। তিনি কিছু বলার আগেই এম বার্নার্ড বলে উঠলেন, তাহলে ইনি তোমার নানি।
নিত্যদিনের মতো কাজেকর্মে কঠিন ব্যস্ত। আহা, আসলেই আপনি খুব কর্মী মানুষ। জ্যাকের নানি তাকে খাবার রুমে ঢোকার আগে যে রুমটা পার হতে হয় সেটার দিকে এগিয়ে নিয়ে গেলেন। টেবিলে তাকে বসতে দিয়ে গøাস এনে তার সামনে এক বোতল এনিসেত রাখলেন আপ্যায়নের জন্য। এম বার্নার্ড বললেন, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি এসেছি আপনার সাথে কয়েকটা জরুরি কথা বলতে। কথা শুরু করলেন তার ছেলেমেয়েদের প্রসঙ্গ দিয়ে; এরপর খামারে তার জীবন এবং তার স্বামী সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করলেন। এরপর তিনি নিজের সন্তানদের কথাও বললেন। তখন জ্যাকের মা এলেন; মনে হলো কিছুটা আতঙ্কিত। তবু এম বার্নার্ডকে সম্বোধন করলেন মসিঁয়ে লে মাইত্রে বলে। নিজের ঘরে ঢুকে চুলে চিরুনি চালিয়ে এবং আরেকটা অ্যাপ্রোন চাপিয়ে বের হয়ে এসে বসলেন টেবিল থেকে একটু দূরের একটা চেয়ারের কোণায়। জ্যাকের উদ্দেশ্যে এম বার্নার্ড বললেন, তুমি রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়াও। আমি না আসা পর্যন্ত ওখানে অপেক্ষা করো। জ্যাকের নানিকে এম বার্নার্ড বললেন, বুঝতে পারছেন হয়তো, আমি জ্যাকের পক্ষে কয়েকটা কথা বলতে চাই। সত্যি বলতে কী, ওর ওপরে ভরসা রাখা যায়। জ্যাক দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে রাস্তার সামনে দরজায় এসে দাঁড়াল। জ্যাক ওখানে প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষায় রইল। ততক্ষণে রাস্তা জনকোলাহলে প্রাণবন্ত হয়ে উঠছে। ডুমুর গাছের ফাঁক দিয়ে আকাশটা সবুজ রং ধারণ করছে। এম বার্নার্ড সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে জ্যাকের পেছনে দাঁড়ালেন। জ্যাকের মাথায় আদরের একটা সুরসুরি দিয়ে তিনি বললেন, ঠিক আছে; সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। তোমার নানি আসলেই খুব ভালো মানুষ গো। আর তোমার মা, তার কথা আর কী বলব...। তাকে কখনও ভুলে যেও না, বাছা।
জ্যাকের নানি এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, মসিয়েঁ। তার হাতে অ্যাপ্রোন, চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বললেন, আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আপনি বলেছেন আপনি ওকে স্কুলের পড়ার বাইরেও পড়াবেন।
এম বার্নার্ড বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন। সেটা ওর জন্য শুধু ছেলেখেলা হবে না।
কিন্তু আপনাকে কিছু দেওয়ার মতো সামর্থ্য যে আমাদের নেই!
এম বার্নার্ড তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে থেকে জ্যাকের কাঁধ ধরে ঝাঁকিুনি দিয়ে বললেন, ও নিয়ে আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। আমি জ্যাকের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি।
(চলবে..)