ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৩৩
দ্য ফার্স্ট ম্যান
জ্যাকের নানি এগিয়ে আসতে আসতে বললেন, মসিয়েঁ। তার হাতে অ্যাপ্রোন, চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বললেন, আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলাম, আপনি বলেছেন আপনি ওকে স্কুলের পড়ার বাইরেও পড়াবেন।
এম বার্নার্ড বললেন, হ্যাঁ, অবশ্যই। আপনি আমার ওপর বিশ্বাস রাখুন। সেটা ওর জন্য শুধু ছেলেখেলা হবে না।
কিন্তু আপনাকে কিছু দেওয়ার মতো সামর্থ্য যে আমাদের নেই!
এম বার্নার্ড তার দিকে ভালো করে তাকিয়ে থেকে জ্যাকের কাঁধ ধরে ঝাঁকিুনি দিয়ে বললেন, ও নিয়ে আপনি কিচ্ছু ভাববেন না। আমি জ্যাকের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি।
এরপর তিনি চলে গেলেন এবং নানি জ্যাকের হাত ধরে ভেতরের দিকে হাঁটা দিলেন। জীবনের প্রথম তিনি জ্যাকের হাতটা আশাহত ভালোবাসায় চেপে ধরলেন। মুখে শুধু বলতে পারলেন, আমার সোনা, আমার লক্ষী সোনা!
পুরো একমাস এম বার্নার্ড তার চার ছাত্রকে স্কুল ছুটির পর প্রতিদিন দুঘণ্টা করে পড়ালেন। বাড়ি ফেরার পর জ্যাক ক্লান্ত তবে উচ্ছসিত থাকত। এরপর আবার শুরু হতো বাড়ির পড়াশোনার পালা। নানি তার দিকে দুঃখ আর গর্বের মিশ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন।
নিজের মাথায় নিজের হাতের ঘুষি দিয়ে হালকা আঘাত করতে করতে আর্নেস্ট মামা জোর দিয়ে বলত, জ্যাকের মাথায় অনেক বুদ্ধি।
নানি বলতেন, হ্যাঁ। তবে আমাদের কী হবে? একদিন সন্ধ্যায় তিনি আবারো বললেন, ওর প্রথম কমিউনিয়নের কী হবে? আসলে তাদের জীবনে ধর্মের বিশেষ কোনো স্থান ছিল না। তাদের কেউ খ্রিস্টের নৈশভোজ পর্বে অংশ গ্রহণ করতে যায়নি। তাদের কেউ খোদার দশ বিধান শেখেনি কিংবা সময়ে সময়ে মুখে আনেনি। মৃত্যুর পরে শাস্তি কিংবা পুরস্কারের কথা তারা কেউ কখনও উল্লেখ করেনি। জ্যাকের নানির সামনে কারো মৃত্যুর কথা উঠলে তিনি বলে উঠতেন, লোকটা আর বাতকর্ম করবে না। কিংবা তার সামান্য পছন্দের কেউ মারা যাওয়ার কথা শুনলে তিনি বলতেন, আহা বেচারা অল্প বয়সে মারা গেল। অবশ্য যার কথা বলা হলো তিনি হয়তো অনেক দিন আগেই মারা যাওয়ার মতো যথেষ্ট বুড়ো হয়ে গেছেন। তার দিক থেকে যে অবজ্ঞা ছিল তাও বলা যাবে না। কারণ তিনি চারপাশের অনেককেই মারা যেতে দেখেছেন। তার সন্তানদের মধ্যে দুজন, তার স্বামী, তার জামাতা এবং তার বোনের ছেলেরা সবাই যুদ্ধে মারা গেছে। তবে তার কাছে মৃত্যুর অভিজ্ঞতা যেন দারিদ্র আর কাজের মতোই খুব ঘনিষ্ঠ। মৃত্যু নিয়ে তিনি আলাদাভাবে কিছু ভাবেননি। বরং বলা যায়, মৃত্যুর মধ্যেই তার বসবাস। আলজেরিয়ার সব মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনের চেয়ে তার কাছে বর্তমান মুহূর্তের প্রয়োজনটা যেন আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দাফন সংক্রান্ত ধর্মানুরাগ সভ্যতার সঙ্গে তাদের অবস্থান পর্যন্ত বেড়ে উঠেছে। কিন্তু সাধারণ ভাগ্য এবং অভাবের কারণে নিজেদের জীবনে সেগুলো থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছে। জীবনে যে সকল অগ্নিপরীক্ষার সম্মুখিন হয়েছে মৃত্যুও তাদের কাছে সেগুলোর মতোই একটা অগ্নিপরীক্ষা। ওই সকল অগ্নিপরীক্ষা সম্পর্কে তারা কোনো কথা বলে না। তবে সেগুলোর মুখোমুখি হওয়ার জন্য যে সাহস দরকার সেটা তাদের ছিল, আছে এবং তাদের জন্য ওই সাহসই মানুষের প্রধান গুণ। তবু তারা ওই সাহস আড়ালে রাখে কিংবা ভুলে থাকে। সেই কারণেই সকল দাফনকর্মে এক ধরনের রসিকতার ছোঁয়া লাগে: যেমন মরিস মামার দাফনের কথাই বলা যেতে পারে। ওই সাধারণ প্রবণতার সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের কঠিন পরিশ্রম ও সংগ্রাম এবং বলা বাহুল্য জ্যাকদের পরিবারের মতো দারিদ্রকে যদি যোগ করা যায় তাহলে তাদের জীবনে ধর্মের জন্য স্থান পাওয়া খুব কঠিন। আর্নেস্ট মামার প্রসঙ্গে বলা যায়Ñ ইন্দ্রিয়-চালিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত এই মানুষটির কাছে তার চোখে দেখা বিষয়াদিই হলো তার ধর্ম: যেমন পাদ্রী এবং আচার অনুষ্ঠান। তার হাস্যরসের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে সুযোগ পেলেই ধর্মীয় জমায়েতের আচার অনুষ্ঠান নকল করে দেখাত সে। পাদ্রীর উচ্চাণের ল্যাটিন শব্দগুলোর পরিবর্তে মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে বোঝানোর চেষ্টা করত। সমাবেশের সকলের মাথা নিচু করা এবং সেই ফাঁকে ওখানে জমা রাখা মদের বোতলে পাদ্রীর চোরাগোপ্তা চুমুকের অনুকরন দেখিয়ে তার অভিনয় পর্ব শেষ করত। ক্যাথরিন করমারির কথা বলতে গেলে যে বিষয়টি উল্লেখ করা যায় সেটা হলো, তার শান্ত স্বভাব থেকে বোঝা যায়, তার মধ্যে ধর্মের উপস্থিতি ছিল। কিন্তু আসলে খোদ শান্ত স্বভাবটাই ছিল তার ধর্ম। ধর্মের প্রতি তার অবিশ্বাস ছিল না। আবার প্রগাঢ় সায়ও ছিল না। তার ভাইয়ের অভিনয় দেখে একটু আধটু হাসতেন। আর পাদ্রীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হলে মসিয়েঁ কিউরি বলেই সম্বোধন করতেন। তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে কোনো কথাই বলতেন না। আসলে জ্যাক ছেলেবেলায় ঈশ্বর কথাটাই তাদের পরিবারের কারো মুখে উচ্চারিত হতে শোনেনি। জীবন সুস্পষ্ট এবং রহস্যঘেরা হওয়ার কারণে তার সমস্ত সত্তা জুড়ে শুধু জীবনই ছিল; অন্য কিছুর প্রবেশ ঘটেনি।
এসবের কারণে তাদের পরিবারে কখনও কোনো সভ্য দাফনের প্রসঙ্গ উঠলেই তার নানি এবং পক্ষান্তরে তার মামা পাদ্রীর অনুপস্থিতি নিয়ে আফসোস করে বলত ‘কুকুরের মতো’। আলজেরিয়ার আর সব মানুষের মতো তাদের কাছেও ধর্ম একটা সভ্য জীবনের অংশ ছাড়া অন্য কিছু ছিল না। তাদের শিকড় যেহেতু ফ্রান্সে ছিল, তারা ছিল ক্যাথলিক। সে কারণে তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে কতিপয় আচার অনুষ্ঠানও যুক্ত ছিল। আসলে ওই আচার অনুষ্ঠানগুলো মোটের ওপর ছিল চার রকমের: দীক্ষালাভ, খ্রিস্টীয় ভোজসভায় প্রথম যোগদান, বিয়ে (অবশ্য বিয়ের কাজটা কেউ করে থাকলে) এবং দাফনকৃত্য। কালেভ্রদ্রে সংঘটিত ওইসব আচার অনুষ্ঠানের মাঝে তাদের ব্যস্ততা থাকত অন্য কাজকর্মে, বিশেষ করে টিকে থাকার সংগ্রামে।
সুতরাং ধরে নেওয়া হলো, জ্যাকের গির্জার ভোজসভায় প্রথম যোগদান হবে হেনরির মতোই: এ প্রসঙ্গে হেনরির মনে সবচেয়ে নিরানন্দের স্মৃতিটার প্রভাবই বেশি ছিল। অবশ্য সে স্মৃতিটা খোদ আচার অনুষ্ঠানের নয়, বরং পরবর্তী সামাজিক কার্যকলাপের। বাহুতে মাদুলি পরে তাকে কয়েক সপ্তাহ বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতে যেতে হয়েছিল। প্রথা অনুযায়ী মাদুলি পরার কারণে তারা সবাই তাকে সামান্য কিছু টাকা পয়সা দান দক্ষিণাও করেছে। সেটা নিতে অবশ্য হেনরির ভালো লাগেনি। তবে দানের টাকার সামান্য অংশ হেনরির হাতে থাকতে পেরেছে। কারণ নানির মতে গির্জার ভোজসভায় প্রথম যোগদান করার অনুষ্ঠানের একটা খরচ আছে না? তবে ওই অনুষ্ঠান তার বয়স বারো বছর হওয়ার আগে হয়নি। তার আগে তাকে দুবছর কাটাতে হয়েছে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে ধর্মীয় শিক্ষালাভ করতে। সুতরাং জ্যাককে লিসিতে দ্বিতীয় কিংবা তৃতীয় বছর কাটানোর পরে গির্জার ভোজসভায় প্রথম যোগদান করতে হবে। সেকথা ভেবেই নানি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। লিসিতে জ্যাকের পড়ার ব্যাপারে তার মনে একটা নেতিবাচক এবং ভয়াবহ চিত্র ছিল; ওখানে পাড়ার স্কুলের চেয়ে দশগুণ বেশি পরিশ্রম করতে হবে জ্যাককে। কারণ ওখানে পড়ার পরে অপেক্ষাকৃত ভালো চাকরি পাবে জ্যাক। অন্যদিকে ওখানে না পড়লে তার পক্ষে আগে আগে যে কামাই রুজির সম্ভাবনা ছিল সেটাও তো আর হবে না। জ্যাকের জন্য তিনি আগেই যে ত্যাগটা করতে যাচ্ছেন সেকথা মনে করেই তিনি সর্বান্তকরণে জ্যাকের সাফল্য কামনা করলেন। ধর্মীয় শিক্ষার জন্য যে সময় ব্যয় হতে পারে সে সময় থেকে জ্যাকের কঠিন পরিশ্রমের সময়টা বাদ দিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, না, তুই লিসিতে পড়াশোনা আর ধর্মীয় শিক্ষালাভ এক সাথে করতে পারবি না।
জ্যাক বলল, তাহলে তো আরো ভালো। আমাকে গির্জার ভোজসভায় যোগদান করতে হবে না। তবে জ্যাকের খুশি হওয়ার কারণ হলো তাকে মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দানের টাকা পয়সা গ্রহণ করতে হবে না। কাজটা তার অসহ্য রকমের অবমাননাকর মনে হত।
নানি তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কেন? গির্জার ভোজসভায় যোগদানের ব্যবস্থা তো করাই যায়। এখনই তৈরি হয়ে নে। আমরা এখনই পাদ্রীর সাথে দেখা করতে যাব।
উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় পদক্ষেপে নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দিলেন। একটু পরেই ফিরে এলেন। পরনের ক্যামিসোল আর কাজ করার সময়ের স্কার্ট ছেড়ে বাইরে যাওয়ার একমাত্র পোশাক পরে ফেলেছেন: গলা পর্যন্ত বোতাম আটকানো এবং কালো রঙের সিল্কের স্কার্ফ মাথার চারপাশ পেচিয়ে বেঁধে ফেলেছেন। স্কার্ফের প্রান্তে বের হয়ে থাকা তার সাদা চুলের গোছাগুলো, তীক্ষ্ম চোখ জোড়া এবং দৃঢ় মুখ তার সমস্ত অবয়ব জুড়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাবটা ফুটিয়ে তুলেছে।
চলবে..