ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৪২
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে কাঁদতে শুরু করে। অন্যরাও কেঁদে বুক ভাসায়। সালাম সবার পরিচিত। মুজফফর বলে, সালামকে কবর দেব আমরা। যাই কবর খুঁড়ে নেই। সবাই চলো আমার সঙ্গে। গর্ত খোঁড়া হলে আমরা এসে শহীদ সালামকে নিয়ে যাব।
সবাই দূরে হেঁটে যেতে থাকে। খালেক নিজের বাড়িতে গিয়ে একটি কোদাল নিয়ে আসে। ধানক্ষেতের পাশে এক জায়গায় গর্ত করে শহীদ সালামের লাশ নামানো হয়। সবাই মিলে দোয়া পড়ে। লুৎফা খানিকটা দূরে বসে চিৎকার করে কাঁদে। যখন মাটি চাপা দিয়ে গর্ত ভরানো হয় তখন লুৎফা কবরের পাশে বসে জোরে জোরে দোয়া পড়ে। কবরের উপরের মাটি সমান করে গোছাতে থাকে। সবাই মিলে লুৎফার সঙ্গে দোয়া পড়ে, মাটি গুছিয়ে একসময় বলে, চলেন ভাবী। আমরা আবার আসব।
-আমি এখন যাব না। শুনতে পান না যুদ্ধ তুমুল হয়ে উঠেছে।
-আমরা দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি পাকিস্তান বাহিনীর ষোলটি ট্যাঙ্কের মধ্যে তেরোটি ধ্বংস করেছে মুক্তিযোদ্ধারা। অনেক সৈন্যের লাশ মাটিতে পড়ে আছে।
-যুদ্ধ এখনই থেমে যাবে বলে মনে হয় না।
-হ্যাঁ, আমরাও তাই মনে করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ধ্বংস করে ছাড়বে।
-চলো আমরা এখান থেকে সরে যাই। মুজফফর সবার দিকে চোখ বড় করে তাকায়, এখানে থাকা কোনো কাজে আসছেনা। তবে থাকতে হবে কেন?
লুৎফা চেঁচিয়ে বলে, আমি মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ দেখব। আমি যাব না। এই গাছের আড়ালে বসে থাকব। দরকার মতো ওদের সেবা করব।
অঞ্জন বলে, আমিও যাব না। যে আহত হবে তাকে সুস্থ করতে হবে। আমরাতো কাজের দায়িত্ব নিয়ে এসেছি। চলে যাব কেন?
-আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে সবাই থাকি।
-শুধু থাকি না, সবাই যুদ্ধে আছি। যুদ্ধের যা কিছু দরকার হবে আমরা মিলিতভাবে করব।
-এই দেখ মুক্তিযোদ্ধারা ষোলটি ট্যাংকের মধ্যে তেরোটি ধ্বংস করে বাকি তিনটি দখল করেছে। পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটছে।
-আমরা যুদ্ধে জিতেছি।
-হ্যাঁ, জিতেছি, জিতেছি, জিতেছি। চেঁচিয়ে ওঠে সবাই, জয় বাংলা।
-প্রায় একশজন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়েছে।
-যুদ্ধ থামেনি। মনে হচ্ছে আরও অনেকক্ষণ চলবে।
-চলুক। যতক্ষণ দরকার ততক্ষণ তো চলতে হবে। বিজয় নিয়ে আমরা তাঁবুতে ফিরব।
অনেকক্ষণ একজায়গায় বসে থাকার পরে সন্ধ্যা হয়ে যায়। মুজফফর লুৎফাকে হাত ধরে টেনে বলে চলে আমরা যাই।
-হ্যাঁ, চলো। অঞ্জন ভাই যাবেন না?
-না, আমি যাব না। মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ যদি আহত হয় তাকে আমার দেখতে হবে।
-ও হ্যাঁ, তাইতো, তাইতো।
-অঞ্জন দাদার সঙ্গে আমরা কয়জন থাকব। দাদা একা থাকলে হবে না।
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছো, থাক। অঞ্জন ভাই একা সেবা করতে পারবে না।
-আপনারা যান।
-ঠিক আছে আমরা যাচ্ছি।
মুজফফর আর লুৎফা এগিয়ে যেতে থাকে। দুকানে ধারণ করে গোলাগুলির শব্দ। মাথা ভরে যায় সেই শব্দে। লুৎফা গুনগুনিয়ে বলে, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের স্বাধীনতা।
মুজফফর নিজেও গুনগুনিয়ে গানের মতো গাইতে থাকে আমাদের স্বাধীনতা-আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা পূর্ণ করবে আমাদের শরণার্থী শিবির। নিজ দেশের ঘরে ফেরার সময় গাইব -আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
-গানটা তোমার মুখস্ত নাই?
-পুরোটা নাই। দুই লাইন মুখস্ত আছে। দুই লাইনই গাইব।
লুৎফা উচ্ছসিত হয়ে বলে, আমাদের চারপাশে যারা থাকবে তাদের সবাইকে গাইতে বলব।
-হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।
দুজনে গুনগুন করে গাইতে গাইতে নিজেদের তাঁবুতে গিয়ে ঢোকে। কুপি জ্বালায় লুৎফা। মুজফফর কলসি থেকে পানি ঢেলে খায়। তারপর এক গ্লাস পানি লুৎফার দিকে এগিয়ে দেয়। লুৎফা, নিজেও একটানে গ্লাসের পানি শেষ করে। বুঝতে পারে বুকের ভেতর পানির টান প্রবল ছিল। পানি খেয়ে বলে, হাঁড়িতে দুপুরের ভাত-তরকারি কিছু আছে। ওইটুকু খেয়ে আমরা শুয়ে যাই। হবে না?
-হ্যাঁ, হবে হবে। তোমাকে এখন আর রান্নার ঝামেলায় যেতে হবে না।
-আমি সকালে রান্না করব। চট করে খেয়ে নিয়ে চৌগাছায় যাব। যুদ্ধের অবস্থা দেখব।
-ঠিকই বলেছ। হাতমুখ ধুয়ে নেই। ভাত খেয়ে শুয়ে পড়ব।
লুৎফা দ্রুত থালায় ভাত-তরকারি দিয়ে মুজফফরকে দেয়। মুজফফর থালা হাতে নিয়ে বলে, তোমার থালা কই? ভাত আছেতো? আমাকে শুধু খাইও না।
-আছে আমার জন্য। তুমি তোমার মতো খাও। আমি থালায় ভাত নিচ্ছি। অল্প সময়ের মধ্যে দুজনে খেয়ে শুয়ে পড়ে। চৌগাছায় দেখা যুদ্ধ দুজনকেই তন্ময় করে রাখে। ঘুম আসে না। ঘুমাতে অনেক রাত হয়ে যায়। লুৎফা ভাবে, শরণার্থী শিবিরের এখানে চৌগাছায় যুদ্ধ হচ্ছে। গোলাগুলির শব্দ রাতের অন্ধকার কাঁপিয়ে তুলেছে। ঘুম আসছে না। মুজফফর ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন ও ভাবে কেন যুদ্ধের এমন চিন্তা ওকে কাহিল করে ফেলেছে। কেন ওর ঘুম আসছে না। বালিশে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে লুৎফা। মাঝে মাঝে নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, তখন মাথা কাত করতে হয়। প্রবলভাবে নিশ্বাস টানে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে মুজফফর বলে, তোমার কি হয়েছে?
-ঘুম আসছে না।
-আমার বুকে মাথা রাখ। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।
লুৎফা ঘুরে শুয়ে মুজফফরকে জড়িয়ে ধরে। মুজফফর ওর মাথা বুকের সঙ্গে গভীর মমতায় জড়িয়ে ধরে গুনগুন করে গাইতে থাকে ‘আমরা যুদ্ধে জিতব, স্বাধীন দেশে যাব’। লুৎফাও মুজফফরের সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়। গুনগুন করতে করতে দুচোখের পাতা বুঁজে আসে। দুজনে একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে যখন ঘুম ভাঙে তখন যুদ্ধের গোলাগুলির শব্দ একইভাবে শুনতে পায়। লুৎফা ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বলে, আমি একটুপরে চৌগাছা যাব। তুমিও যাবে আমার সঙ্গে। যাবে তো?
-হ্যাঁ, যাবই। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ সোজা কথা না।
মুজফফর উঠে তাঁবুর বাইরে যায়। একপাশে দাঁড়িয়ে চারদিকের পরিস্থিতি দেখে। লুৎফা দ্রুতহাতে কয়েকটি রুটি বানায় আর আলু ভাজি করে। দুজনে নিজেদের মতো করে পরিস্থিতি সামলায়। লুৎফার কাজ শেষে দ্রুত আলু ভাজি দিয়ে রুটি খায়। বেশ অনেকগুলো রুটি দেখে মুজফফর বলে, এত রুটি বানালে কেন?
-চৌগাছায় নিয়ে যাব। যদি কারো দরকার হয়ে তাকে খেতে দেব।
-ভালোই করেছ। গুছিয়ে নাও। চলে যাই। কেউ না খেতে চাইলে ক্ষতি নেই। আমরা খাব। তুমি সাধাসাধি করে কাউকে খাওয়াতে চেওনা।
-আমার মাথা এত খারাপ হবে না। কেউ খেতে না চাইলে বুঝব তাদের খাওয়ার ইচ্ছা নেই।
চলবে….
আগের পর্বগুলো পড়ুন>