ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩১
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
আমিও তাই মনে করি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী একটি শরণার্থী শিবির দেখতে গিয়েছিলেন। দেখ তিনি গাছের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার মনে হয়েছে যারা ভিড়ের মধ্যে পেছন থেকে তাকে দেখতে পাচ্ছিলনা তারা গাছের উপর উঠেছে তাকে দেখার জন্য। তিনি গাছের দিকে তাকিয়ে ওদেরকে দেখে হাসছেন। আমার নিজেও ছবিটি তুলে প্রাণ জুড়িয়ে গেছে।
অঞ্জন ক্যামেরা বুকে জড়িয়ে ধরে। বলে, তিনি শরণার্থীদের বাঁচিয়ে রাখার আনন্দে আছেন। আমি অনেককে বলি, তিনি আমাদের মা। মায়ের আদর ভেসে উঠেছে তার হাসিমুখে।
অঞ্জন ক্যামেরার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের পলক পড়ে না। ভাবে, শরণার্থীদের নিয়ে এ এক অসাধারণ ছবি। রঘু রাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে ওর চোখ ছলছল করে। তারপরও মৃদু হেসে বলে, এই ছবি আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ের প্রধান দিক। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।
-তুমি বেশ আবেগাড়িত হয়ে গেছ অঞ্জন।
-হবইতো। আমি তোমার বন্ধু। এমন একটা সুন্দর ছবি তুলেছ তুমি। তিনি কত সুন্দরভাবে হাসিমুখে গাছের ডালের দিকে তাকিয়ে আছেন। শরণার্থীরা তাঁর গলায় ফুলের মালা দিয়েছে।
-বাব্বা,তুমি খুব নিখুঁতভাবে ছবিটা দেখছ। আস তোমার একটা ছবি তুলি। তুমি আর তোমার বাবা গাছের নিচে পড়ে আছ। পেছনে শরণার্থীদের তাঁবু।
-হ্যাঁ, ত্যাঁ, তোল বন্ধু। এটাও তোমার আর এক ধরনের ছবি হবে।
রঘু রাই হা-হা করে হাসে। হাসতে হাসতে বলে, শরণার্থীদের জীবন আমার ছবির রূপরেখা। এই শরণার্থী শিবির আমি নানা মাত্রায় দেখতে থাকি। তারপর যেটা পছন্দ হয় তখন সেই ছবিটি তুলি।
-তুমি যে একটি শিশুর মুখ আর বুক নিয়ে হা করে কান্নার ছবিটি তুলেছ সেটা দেখতে আমার মনে হয়েছিল ও শুধু একা না, শরণার্থী শিবির জুড়ে পড়ে থাকা মানুষের মুখ। এই কান্না বেঁচে থাকার সত্য। ছবিটা দেখার সময় আমার মনে হয়েছিল ওটা আমার মুখ। হাজার হাজার মানুষের মুখ।
-বাব্বা, তোমার ভাবনার সীমা নাই। এখন ছবি তুলব।
অঞ্জন প্রথমে বাবার মাথার চুল এলোমেলো করে দেয়। তারপর নিজের মাথার চুল এলোমেলো করে গাছের নিচে চিৎ হয়ে পড়ে। রঘু রাই ছবি তোলে। অঞ্জনকে ছবি দেখিয়ে চলে যায়।
অঞ্জন বাবাকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন তাঁবুতে যায়। কার কি খাবার আছে সেসব খোঁজ করে। একজন তীক্ষ্ণ গলায় বলে, খোঁজ করে কী করবে? চাল-ডাল দিতে পারবে?
-চেষ্টা করে দেখব।
-থাক, এতকিছুর দারকার নাই। ঢং দেখানোর জায়গা নাই। শুধু ডাক্তারী কর। কেউ যেন বিছনায় পড়ে চিল্লায়না। ওষুধের ব্যবস্থা কর।
-আচ্ছা যাই।
অঞ্জন আর দাঁড়ায় না। চলে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই মুখোমুখি হয় হাসনা বানুর।
-কি খুঁজতে এসেছেন ডাক্তার সাহেব?
-দেখতে এসেছি সবাই কেমন আছে?
-এই দেখাতো শুধু চোখের দেখা হবে। আপনিতো ওষুধ আনতে পারবেন না।
-আমি ঠিক করেছি ওষুধ জোগাড় করার চেষ্টা করব।
-হ্যাঁ, ভালো চিন্তা করেন। আমিও জোগাড় করার জন্য আপনার সঙ্গে থাকব। যখনই বলবেন আমি আপনার সঙ্গে কাজ করব। শরণার্থী হওয়ার কষ্ট পাচ্ছি বলে কাজ না করে শুধু বসে থাকব, এটা আমি ভাবিনা।
-আপনি তো অসুস্থ মানুষকে সেবা করেন।
-তাতো করবই। অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে তোলা আমাদের দায়িত্ব না? সবাইকে সুস্থ করে আমরা একসঙ্গে স্বাধীন দেশে ঢুকব। আর যুদ্ধে শহীদ হওয়া সবাইকে মাথায় রেখে স্বাধীন দেশের কারুশিল্পী হব।
-বাব্বা হাসনা বানু, আপনিতো অনেক কথা বললেন।
-শুধুই কথাই বললাম। যুদ্ধ করতে তো পারলাম না।
-আপনি অসুস্থদের সেবা করেন, এটাও যুদ্ধ। কেউ যদি পড়ে থেকে মরে যায় সেটা হবে যুদ্ধের খারাপ দিক। আমাদের চোখের সামনে কেউ পড়ে থাকতে পারবেনা। আমরা অসুস্থতার মতো শত্রুপক্ষকে মেরে কাহিল করব। নইলে যুদ্ধ অসুস্থতা আমাদের জীবন নিয়ে দৌড়াবে।
শব্দ করে হাসে হাসনা বানু। হাসতে হাসতে বলে আপনিতো বেশ গুছিয়ে সুন্দর কথা বললেন।
-আমরাতো আর বেশি দিন এখানে থাকবনা। আমাদের স্বাধীন দেশে ফিরে যেতে হবে। চারদিক থেকে যুদ্ধের খাবর পাই। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা ভালোভাবে যুদ্ধ করছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে মেরে দাবড়াচ্ছে। আমাদের ইন্দিরা গান্ধী মা সবরকম সহযোগিতা দিচ্ছেন। আমার মনে হয় আমাদের আর বেশিদিন লাগবেনা।
হাসনা বানু সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমিও তাই মনে করি। ছেলেমেয়ে দুটোকে রাতদিন এই গল্পই করি। ওরা রাতে ঘুমুতে পারেনা। মাঝে মাঝে কাঁদতে শুরু করে। বেশ কিছুক্ষণ কেঁদে তারপর আবার ঘুমায়। একজনের বয়স ছয়, একজনের বয়স তিন।
-ওদের বাবাতো যুদ্ধ করছে।
-হ্যাঁ, যুদ্ধ করছে। এজন্য আমি খুব কৃতজ্ঞ। আমার স্বামীকে মুক্তিযোদ্ধা ভাবলে আমার গৌরব হয়। আমার এই দুই বাচ্চাকে যদি দেশে রেখে আসতে পারতাম, তাহলে আমিও প্রশিক্ষণ নিয়ে যুদ্ধ করতাম। শুরু তাঁবুর মধ্যে বসে থেকে দিন কাটাতাম না।
-আপনিতো বসে থেকে দিন কাটাচ্ছেন না।
-হ্যাঁ, তা কাটাচ্ছিনা। সাধ্যমতো যা করতে পারছি, তা করছি। করাতো কর্তব্য।
-হ্যাঁ, আমিও তাই মনে করি। দেখি ভারতীয় ভাইদের কাছে যাই। কিছু চাল জোগাড় করতে পারি কিনা। পারলে যাদের ঘরে চাল নাই ,তাদেরকে দেব। আমি বাচ্চাদের কান্না শুনতে পারিনা।
-খুব ভালো কথা। তাড়াতাড়ি যান।
চলবে...