ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৬
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
তোজাম্মেল দু’হাতে বউকে জড়িয়ে ধরে। খালিদা উপভোগ করে তার প্রাণের টান। দু’জনে শোবার ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়ে। তোজাম্মেল স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে বলে, বিছানা তো তোমার কাছে নদী? আজকেও কি তাই মনে করছ?
–করব না কেন? একশবার করছি। বিছানার আবেগ থেকে আমি নিজেকে আলাদা করব না। আমরা এখন নদীতে ডুবসাঁতার দেব। ডুবসাঁতারে ভেসে যাবে কামনার ঘোলা জল।
–ঘোলা জল কেন?
–এটাই আমার কাছে মজার কথা। আমি অন্য কোনো শব্দ ব্যবহার করব না।
–বুঝেছি, বুঝেছি। তুমি কি কবিতা লিখতে চাও?
–সন্তানের জন্ম আমার কাছে কবিতা। তুমি তো জানো তা। এখন কথা বন্ধ করো। এসো ডুবসাঁতারে চলে যাই।
হা-হা করে হাসে তোজাম্মেল। হাসতে হাসতে বলে, তোমার ভাষা শুনে খুব মজা পাই। সেজন্য ডুবসাঁতার আমার খুব আনন্দের।
খালিদা হাসতে হাসতে বলে, আনন্দে নিজেকে তৈরি করে ফেলেছি। চলো ডুবি।
–ওহ দারুণ। তোজাম্মেলও নিজেকে ডুবিয়ে ফেলে।
বিশাল হয়ে ওঠে শরীর। দু’জনের আকর্ষণে বিশাল হয়ে ওঠে শরীর। স্রোতের তোড়ে মেতে ওঠে বিছানার শরীর। নিঃশব্দ হয়ে যায় ঘর। বিছানার নড়াচড়া শব্দ মাত্র না, তা আনন্দের ঢেউ। দু’জনে সে ঢেউয়ে ডুবে যায়। কত সময় পেরিয়ে যায় সে খবর ওরা রাখে না। ডুবসাঁতার শেষ হলে খালিদা বলে, আমি উঠব না। কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব।
–আমিও থাকব।
তোজাম্মেল কাত হয়ে খালিদাকে জড়িয়ে ধরে বলে, চলো ঘুমাই।
–না, ঘুমাব না। ভাবনার নদীর পাড় দিয়ে হাঁটব। দেখব নদীর ভেতর থেকে একটি শিশু উঠে আসে কিনা।
সেই শিশু পেলে ওকে বুকে নিয়ে নদীর পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যাব। দেখব তুমি দাঁড়িয়ে আছ নদীর অপর পাড়ে। আমাকে দেখে তুমি ছুটে এলে আমার কাছে। গিুটিকে কেড়ে নিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলে। বললে, ডুবসাঁতারে পাওয়া মেয়েটি–
–থাক, থাক আর বলতে হবে না। এখন আমি নিঃসঙ্গ মুহূর্ত চাই। তোমার শরীর আমার ভালোবাসার নদী। দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে শারীরিক অনুভবের মাত্রা বাড়াই।
–তোমার শরীর আমার ফসলের ক্ষেত। আমি এখন এই ক্ষেতের আল দিয়ে অনুভবে হেঁটে যাব। শুধু বাতাস আমাকে ভালোবাসার পরশ দিয়ে যাবে। সেই পরশ এখন তুমি। খালিদা তোজাম্মেলকে চুমু দিয়ে বলে, আজকে আমাদের মনের দরজা খুলে গেছে। আমরা যে কত কিছু ভাবছি। কবিতা লেখার ভাবনা।
তোজাম্মেল আর কথা বলে না। ঘরের নিস্তব্ধতা প্রগাঢ় হয়ে যায়। দু’জনে চোখ বুঁজে রেখে অনুভবের মাত্রাকে গাঢ় করে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
অঞ্জন আজকে আর রিকশায় ওঠে না। আজিমপুর থেকে মেডিকেল কলেজে প্রায়ই হেঁটে যায় ও। ভালোই লাগে হাঁটতে। কখনো মনে করে পথ ওর প্রিয়জন। যেদিন হাঁটতে ভালো লাগে না, কিংবা সময় কম থাকে, সেদিন রিকশায় ওঠে। আজকে প্রফুল্ল মনে হাঁটে। মাকে ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে এসেছে। মা এই ছোঁয়া নিয়ে সারাদিন আনন্দে কাটাবে। হাঁটতে হাঁটতে শহীদ মিনারের কাছে এলে দেখতে পায় একটি সভা হচ্ছে। দূর থেকে অবশ্য বক্তার কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছিল মাইকে। জয় বাংলা স্লোগান ধ্বনিত হচ্ছে চারদিকে।
অঞ্জন শহীদ মিনারের এক পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে। সেখানে একজন মা একটি শিশুকে নিয়ে মাটিতে বসে আছে। মেয়েটি মায়ের কাছে বসে শুকনো পাতা নাড়াচাড়া করছে। মুঠি করে গুঁড়ো করছে। ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করছে। অঞ্জন বুঝতে পারে এটা ওর খেলা। এই খেলা দেখতে ভালোই লাগছে ওর। এই ছোট্ট দৃশ্যটি দেখে ও দূর থেকে শহীদ মিনারের দিকে দৃষ্টি ফেরায়। শেখ মুজিব বক্তৃতা করছেন। বাঙালির অধিকার নিয়ে কথা বলছেন। ও মগ্ন হয়ে শোনে। কাছে-ধারে দাঁড়ানো ছেলেরা মাঝে মাঝে বলছে, ‘শেখ মুজিব এসেছে, বাঙালি জেগেছে।’ অঞ্জন নিজেও জোরের সঙ্গে বলে, হ্যাঁ বাঙালি তো জেগে উঠেছে। অঞ্জন নিজেকে বলে, আপনি আমার প্রিয় মানুষ। আপনাকে আমি সামনাসামনি দেখিনি। আপনি দেশবাসীর প্রিয় নেতা। বাঙালিকে জাগিয়ে তুলেছেন। বাঙালি তাদের অধিকার আদায়ে সচেতন হয়ে উঠেছে। আপনার নেতৃত্ব আমাদের আকাশ ছুঁইয়ে দিচ্ছে।
ঘণ্টাখানেক পরে শেষ হয়ে যায় সভা। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে মানুষ। যে যার মতো চলে যাচ্ছে। নেতা গিয়ে তাঁর গাড়িতে ওঠেন। চলে যায় গাড়ি। অঞ্জন ঘড়ি দেখে। কলেজে ঢুকতে ওর আর সময় লাগবে না। ভিড় কমে গেলে ও যাবার জন্য উঠে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি ওর হাত ধরে বলে, আমি সকাল থেকে কিছু খাইনি। আমার খুব খিদা পেয়েছে ভাইয়া।
–খাসনি কেন?
–বাড়িতে কোনো খাবার ছিল না। তাই মা দেয়নি। তখন বসে থাকা সেই নারী বলে, আমার খুব অভাব
বাবা। আমি রোজদিন ঠিকমতো খেতে পাই না।
–ওর বাবা কী করে?
–আমার মেয়ের বাবা নাই। আমি মেয়েটাকে নিয়ে পথে পথে ভিক্ষা করি।
এটুকু বলেই কাঁদতে শুরু করে মহিলা। কান্নার শব্দ ছড়িয়ে পড়ে। দু’চারজন কাছে এসে বলে, কী হয়েছে ওনার?
মেয়েটি চিৎকার করে কেঁদে উঠে বলে, আমার মায়ের খুব অসুখ। আমাদের বাড়িতে ভাত নাই। আমার মা ভাত খেতে পায়নি।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা মহিলার হাতে বেশকিছু টাকা দেয়। আঁচল দিয়ে চোখ মুছে টাকাগুলো আঁচলে বাঁধে।
অঞ্জন জিজ্ঞেস করে, আপনার কী অসুখ হয়েছে?
–আমার জ্বর, পেটব্যথা।
পাশে দাঁড়ানো কেউ একজন বলে, পেট শূন্য থাকলে তো ব্যথা হবেই।
–আমি এখন এখান থেকে উঠতে পারছি না। মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাব। আমি পড়ে গেলে আমার মেয়ে কুকড়ির কী হবে?
–আমি মেডিকেল কলেজে পড়ি। চলেন আপনাকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেব।
–সত্যি বাবা দিবা? বাবা আমাকে বাঁচাও। আমার মেয়েটাকেও তোমার দেখতে হবে বাবা। কুকড়ি চেঁচিয়ে বলে, আমিও মায়ের সঙ্গে হাসপাতালে থাকব।
–আমি একটা রিকশা ডাকছি।
(চলবে)
এসএ/