ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-১৭
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
অঞ্জন রাস্তার ধারে গিয়ে রিকশা দাঁড় করায়। কাছে এসে হালিমা খাতুনকে টেনে তোলে। মা-মেয়ে দু’জনকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে বলে, মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে নিয়ে গিয়ে দাঁড়াও। আমি আসছি, তোমার পেছনে পেছনে। রিকশাওয়ালা আস্তে আস্তে চালায়। অঞ্জন দ্রুত পায়ে হাঁটে। অল্পক্ষণে হাসপাতালে ঢোকে ওরা। ঘড়ি দেখে বিড়বিড়িয়ে বলে, ক্লাস তো শুরু হয়ে গেল। আজকে আর ক্লাস করা হবে না। থাক, একটা ক্লাস না করলে কিছু হবে না। এই গরিবের উপকারটুকু করে দিই। রিকশার পাশে এসে দাঁড়ালে কুকড়ি লাফ দিয়ে রিকশা থেকে নামে। মেয়েটি খুব চঞ্চল। নেমেই অঞ্জনের হাত আঁকড়ে ধরে বলে, আমি কিছু খাব।
-কী খাবি?
-ভাত, রুটি, বিস্কুট যা পাওয়া যায়।
-দাঁড়া তোর মাকে নামাই।
হালিমা খাতুনের হাত ধরে রিকশা থেকে নামায় অঞ্জন। তারপর রিকশাওয়ালাকে ভাড়ার টাকা দেয়। হালিমা খাতুনকে জিজ্ঞেস করে, এখন কেমন লাগছে শরীর?
-খুব খারাপ। মনে হচ্ছে গায়ে কোনো শক্তি নেই।
অঞ্জন দু’জনকে সামনের দোকানে নিয়ে গিয়ে পাউরুটি, বিস্কুট কিনে দেয়। দু’জনকে বলে, এই কোনায় দাঁড়িয়ে আপনারা খান। এই পানির বোতলটা রাখেন।
-তুমি খাবে না বাবা?
-না, আমি বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে এসেছি।
-দুটো বিস্কুট খাও।
-না খালা, কিছু খাব না। কুকড়ির হাতে বিস্কুটের প্যাকেট থাকুক। ওর যখন ইচ্ছা হবে, খাবে। ওর কত বয়স হলো খালা?
-সাড়ে চার বছর। আমি হাসপাতালে ভর্তি হলে আমার মেয়ে কোথায় থাকবে? ওকে কি হাসপাতালে থাকতে দেবে?
-ভেতরে চলেন। কথা বলে দেখি।
-বাবারে আমার মেয়েরে যদি হাসপাতালে না রাখে তাহলে আমি ভর্তি হব না।
-না, না, এমন কথা ভাববেন না। দেখি কী ব্যবস্থা করা যায়।
কুকড়ি দু’হাতে অঞ্জনের হাত ধরে বলে, যদি আমাকে হাসপাতালে না রাখে তাহলে আমি ভাইয়ার কাছে থাকব। ভাইয়া তোমার বাড়িতে ঘর না থাকলে আমি বারান্দায় ঘুমাব।
-বলিস কি রে দুষ্টু মেয়ে। তুই তো অনেক কথা জানিস দেখি।
-বস্তিতে থাকি যে সবার কাছ থেকে কথা শিখি। কত লোক চারপাশে। সবাই অনেক কথা বলে।
হালিমা খাতুন ধমক দিয়ে বলে, হয়েছে থাম। আর কথা বলবি না।
-বলব, আমি অনেক কথা বলতে ভালোবাসি।
-থাম কুকড়ি। আর কথা বলিস না। খালা চলেন আমরা ইমার্জেন্সিতে যাই। আপনার কোনো ডাক্তার দেখানোর সুযোগ হয়েছে কি?
-না, রে বাবা। কেমন করে সুযোগ হবে? ভিক্ষার টাকায় ভাত খাই। ওষুধ খাওয়ার জন্য তো রাখতে পারি না।
-ঠিক আছে চলেন।
দু’হাতে দু’জনকে ধরে এগোয় অঞ্জন। বুকের ভেতর চনমন করে। আজ একটি অন্যদিন ওর সামনে। ও এই দায়িত্ব না নিলেও পারত। ওদের ছেড়ে চলে আসত কলেজে। কিন্তু বিবেকের তাড়নায় পারেনি। মানবিক বোধ চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে বলেছিল, মানুষের জন্য মানুষকেই দায়িত্ব নিতে হয়। যে দায়িত্ব নেয় না সে অমানুষ। নিজেকে শাসন করে দায়িত্ব নিয়েছে। ভবিষ্যতে নিজেও ডাক্তার হবে। দেখেশুনে রাখতে হবে এমন অসংখ্য মানুষকে। এই প্রতিজ্ঞা করলাম দু’জনের হাত ধরে। বুকের ভেতর কথা জমিয়ে রাখে অঞ্জন। ভাবে, বাড়িতে গিয়ে বাবা-মাকে এই কথা বলবে।
ইমার্জেন্সিতে গেলে ডাক্তার জিজ্ঞেস করেন, কী খবর অঞ্জন? কাকে নিয়ে এসেছ?
-তিনি একজন পথের ভিখারি।
-কোথা থেকে আনলে তাঁকে?
-শহীদ মিনার থেকে। এটি ওনার মেয়ে। দু’জনে ভিক্ষা করে জীবন চালায়। শহীদ মিনারে দেখা হলো আমার সঙ্গে।
-কী সমস্যা হয়েছে ওনার?
-খুবই অসুস্থ। সেজন্য আমি হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। ওনার জ্বর এবং পেটে ব্যথা।
-যে অসুখের কথা বললে তার জন্য তো ইমার্জেন্সিতে চিকিৎসা নেই। এটা তো জরুরি বিভাগ।
-উনি তো রাস্তার মানুষ। বস্তিতে থাকেন। ডাক্তার দেখানোর সাধ্য নেই। সেজন্য আমি নিয়ে এসেছি যে হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করব। মেডিকেল কলেজে পড়ি বলে আপনাদের চিনি। আপনাদের কাছ থেকে ভর্তির সহযোগিতা নেব। আপনাকে ব্যবস্থা করে দিতেই হবে ডাক্তার ভাই। আপনার মানবিক বিবেচনা এ ক্ষেত্রে কাজ করুক। অফিস ফরমালিটিজ দিয়ে আমরা সব দিক রক্ষা করতে পারব না।
-ঠিক আছে আমি দেখছি। তুমি দাঁড়াও।
কুকড়ি লাফিয়ে বলে, আমিও হাসপাতালে থাকব।
-তুমি কেন হাসপাতালে থাকবে? তোমার তো জ্বর হয়নি।
-আমার তো খিদা পায়। পেট চোঁ-চোঁ করে। এটা অসুখ না?
অঞ্জন দু’হাতে তার মাথা জড়িয়ে ধরে বলে, হ্যাঁ রে, অসুখ। অনেক বড় অসুখ।
-এর ওষুধ কী বলো তো?
-ভাত।
সবাই হো-হো করে হাসে। হাসতে হাসতে ডাক্তার হালিমা খাতুনের ভর্তির ব্যবস্থা করে দেয়। আট নম্বর ওয়ার্ডের পঁচিশ নম্বর বেড। অঞ্জনকে কাগজপত্র দিয়ে বলে নিয়ে যাও। হালিমা খাতুন ডাক্তারকে বলে, ডাক্তার সাহেব। কুকড়ি জিজ্ঞেস করে, আমি কোথায় থাকব?
-মায়ের সঙ্গে।
-ওহ, মায়ের সঙ্গে। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাব। মা-মাগো চলো, চলো।
লাফাতে লাফাতে ও বারান্দায় বেরিয়ে যায়। অঞ্জন হালিমা খাতুনের হাত ধরে এগোয়। কুকড়ি সামনে থেকে ছুটে এসে অঞ্জনের হাত ধরে। নির্দিষ্ট ওয়ার্ডে পৌঁছে সব ব্যবস্থা করে দিয়ে অঞ্জন বেরিয়ে আসার সময় ওয়ার্ডের কর্মী বলে, এই বাচ্চাকে রেখে যাচ্ছেন কেন? কে ওকে দেখাশোনা করবে?
-ওর মা তো অসুস্থ। আমরা এখানে কোনো বাচ্চা রাখি না। রোগীর সঙ্গে আবার বাচ্চা কেন? ওকে বাড়িতে রেখে আসেন।
-ওরা তো রাস্তার মানুষ। বাড়ি নাই। ওর কেউ নাই।
-তাহলে, আপনি ওকে রাখার ব্যবস্থা করেন। আপনি আসুন আমার সঙ্গে আপনাকে বিছানায় দিয়ে আসি।
-হ্যাঁ, আমি বিছানায় যাব। আমার মাথা ঘোরাচ্ছে।
(চলবে..)