পর্ব-২৯
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
কিছুক্ষণ পর দূর থেকে ছুটে আসে পাকিস্তানি সেনাদের গুলি। অনেকের গায়ে গুলি লাগে। পড়ে যায় অনেকে। যাদের গায়ে গুলি লাগেনি তারা গড়াতে গড়াতে সীমান্তের এপাশে চলে আসে। একসময় গুলি থেমে গেলে উঠে দাঁড়ায় অনেকে। দেখতে পায় বেশ দূর থেকে গুলি আসছে। এখন ওরা থেমে গেছে। বোধহয় গুলি ফুরিয়েছে। যাদের গায়ে গুলি লাগেনি তারা উঠে দাঁড়ায়। দেখতে পায় পাকিস্তানি সেনারা অন্যদিকে যাচ্ছে। যারা আহত হয়েছে তাদের নিজ নিজ তাঁবুতে পৌঁছে দেয় সবাই। পাঁচ জন মারা গেছে। চারদিকে কান্নার ধ্বনি প্রবল শব্দে মিশে যায় বাতাসে। শরণার্থী শিবিরজুড়ে কান্নার শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নাই। আহতদের আর্তনাদ বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই জ্ঞান হারিয়েছে। বাকিরা মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। থমথম করছে চারদিক। স্তব্ধ যশোর রোডের মাঝখানে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে অঞ্জন। মনে হয় বুকের ভেতরে নিঃশ্বাসও পড়ছে না। পরক্ষণে মনে হয় কিছু ওষুধ আনার জন্য কাছের হাসপাতালে যাওয়া দরকার। অঞ্জন ছুটতে থাকে বনগাঁওয়ের দিকে। নিজেতো ডাক্তার, বনগাঁও হাসপাতাল থেকে কিছু ওষুধ আনতে পারলে আহতদের সুস্থ করা যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বনগাঁও পর্যন্ত যেতে পারে না অঞ্জন। মাথা ঘুরে ওঠে। পথের ধারে পড়ে যায়। ঘাস ও মাটির মাঝে পড়ে গেলে শরীরজুড়ে ময়লা ভরে যায়। উঠে বসে, কিন্তু হাঁটার জন্য দাঁড়াতে পারে না। কেমন অবশ লাগছে শরীর। হাঁটুর ওপর মাথা রেখে চুপচাপ বসে থাকে। একটুপরে মাথা সোজা করলে দেখতে পায় একটি মেয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। কাছে এসে মুখোমুখি বসে বলে, আমি দূর থেকে আপনাকে পড়ে যেতে দেখেছি। আপনাকে ধরে ওঠাব?
-না, এখন না। আর একটুক্ষণ বসি। তোমার নাম কি?
-ছবিরাণী। আমি বড় হলে বাবা আমাকে বলেছিলেন, তুমি আমার কাছে দেশের ছবি। সেজন্য তোমার নাম ছবি রেখেছি। বড় হয়ে সবসময় দেশের কথা মাথায় রাখবে। দেশের জন্য যা কিছু করা দরকার করবে। কখনো পিছিয়ে থাকবে না।
-ছবিরাণী তোমার বাবা একজন মহান মানুষ।
ছবিরাণী হাসতে হাসতে বলে, হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। আপনি কোথায় যাবেন? চলেন আপনাকে পৌঁছে দেই।
-না, আমাকে পৌঁছাতে হবে না। আমি চলে যেতে পারব।
-আবার যদি পড়ে যান?
-পড়ে গেলে আবার উঠব, আবার হাঁটব।
-আচ্ছা, তাহলে আমি যাই।
-হ্যাঁ, যাও। কোথায় যাবে?
-শরণার্থী শিবিরে যাব। দেখব কারো কিছু লাগবে কি না।
-তোমাকেতো আমি শরণার্থী শিবিরে আগে কখনো দেখিনি।
-আমি তিন-চার মাস আগে এসেছি। আপনাকেও দেখিনি। যে মায়েরা ভাতের অভাবে কেঁদেছে তাদেরকে চাল এনে দিয়েছি। বেশিজন না, কয়েকজনকে মাত্র। একটি মেয়ের জন্ম হলে মরে যায়। ওকে কোলে করে নিয়ে গিয়েছিলাম আমার বাড়িতে। ভাইদের দিয়ে গর্ত খুঁড়ে ওকে মাটি চাপা দিয়েছি ধানক্ষেতের পাশে।
-ছবিরাণী তোমার মতো মেয়ে আমি দেখিনি। তুমি এত ভালো মেয়ে-
-চলেন আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। আমি চাইনা আপনি আর একবার পড়ে যান।
ছবিরাণী দুহাত টেনে ধরে অঞ্জনের। অঞ্জন উঠে দাঁড়ায়। ছবিরাণী ওর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। অঞ্জনের তাঁবুতে এসে দাঁড়ালে তার বাবা-মাকে দেখতে পায়। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। বলে, মাসীমা আমার নাম ছবিরাণী। আমি দাদাকে পথে পড়ে যেতে দেখেছি।
-মাগো তোমাকে দেখে মন ভরে গেছে। তুমি লক্ষ্মী মেয়ে। তোমার বাড়ি কোথায়?
-চৌগাছায়।
-তোমার বাবা কি করে?
-আমার বাবা কৃষিকাজ করে। বাবাকে কৃষক বলতে পারেন। নিজের দেশ নিয়ে বাবা অনেক চিন্তা করেন। বলে, আমি অনেক ধান চাষ করব। আমার চারদিকের লোকজন যেন না খেয়ে থাকে। যার থালায় ভাত থাকবেনা আমি তার থালায় ভাত দিয়ে আসব।
-বাব্বা তোমার বাবাতো একজন মহান মানুষ। তুমিও বাবার মতো হয়েছ। আমাদের ছেলেকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছ।
-দিবইতো। রাস্তায় উপুড় হয়ে পড়ে গেলে আমি কি তাকে ছেড়ে দিতে পারি? আমিতো মানুষ, ব্যাঙ না।
হা-হা করে হাসে সবাই। ছবিরাণী নিজেও হাসে। তারপর বলে, এখন যাই। মাঝে মাঝে এসে আপনাদের খোঁজ করব।
-আমার ছেলে ডাক্তার। তোমার বাবা-মায়ের অসুখ হলে ওকে ডেকে নিয়ে যেও।
-হ্যাঁ, মাসীমা ঠিক বলেছেন। যাচ্ছি। দাদা, ভালো থাকুন।
ছবিরাণী শরণার্থী শিবির থেকে বের হওয়ার জন্য দৌড়াতে শুরু করে। অঞ্জন বাবা-মাসহ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। ও দৌড়াচ্ছে দেখে অঞ্জন বলে, এই গতি শরণার্থী শিবিরের না। এখানে আছে দুঃখ-কষ্ট-মৃত্যু-কান্না। মায়ের দিকে ঘুরে ও বলে, ওর ছবি চোখে নিওনা মাগো। ও যাচ্ছে, যাক।
ওর বাবা ওর হাতে ট্রানজিস্টার দিয়ে বলে, নে বিবিসির খবর শোন।
-দাও ওই গাছের নিচে বসে খবর শুনব। যশোর রোডে এত গাছ দেখে আমি ভাবছি, গাছের ছায়ায় বেঁচে থাকব বলে এখানে এসেছি।
-থাক, এত কথা বলতে হবে না। মানুষের কষ্ট চোখে দেখিস না।
-শুধু কি চোখে দেখি? কান্নাকাটিও শুনি বাবা। সেটাতো বুক দিয়ে শুনি।
-চল, তোর সঙ্গে আমি যাব। দুজনে গাছের নিচে বসব। আমারও গাছের নিচে বসতে ভালোলাগে।
-মা যাবেন?
-নারে। আমি এখানে থাকব। জীবনে কখনো তাঁবুতে থাকিনি। এখন স্বাধীনতার স্বপ্ন নিয়ে তাঁবুতে থাকব।
-শুধু তাঁবুতে থাকলেতো হবে না। যুদ্ধ লাগবে মা।
-আমি কেমন করে যুদ্ধ করব? আমি কি অস্ত্র ধরতে পারি?
-আপনি যুদ্ধ করতে পারবেন না। যুদ্ধ আমাকে করতে হবে।
-না, তুই ডাক্তারী করবি। যারা যুদ্ধ করবে তাদের সেবা করবি।
-হ্যাঁ, তাই করব। এটাও যুদ্ধের একটা দিক।
-আর কথা বলতে হবে না। চল, চল।
বাবার হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে অঞ্জন। অনেক তাঁবু থেকে কান্নার শব্দ আসছে। শুধু শিশুদের কান্না না, বড়দেরও। অঞ্জন থমকে দাঁড়ায়। বাবার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে, আমাদের কিছু করার আছে?
-আমরা কি করতে পারি? আমাদের চালের গুদাম থাকলে ঘরে ঘরে চাল পৌঁছে দিতাম।
-এমন কথা শুনলে আমার মন খারাপ হয়। যা পারব না-
-থাক, চুপ কর। একটা তাঁবু থেকে কান্না শুনলে নিজেদের তাঁবু থেকে চাল নিয়ে যেতাম।
-নিজেদের তাঁবুতে যে অল্প চাল আছে। সেখান থেকেতো দেয়ার মতো নেই বাবা।
-তা ঠিক। চল বুকের ভেতর কান্নার শব্দ নিয়ে হাঁটি।
শুনতে পায় কান্নার ধ্বনি বেড়েছে। মন খারাপ করে দুজনে যশোর রোডের গাছের নিচে এসে বসে। দুজনেই চুপচাপ বসে থাকে। কান্নার ধ্বনি বুকের ভেতর জমে আছে। একসময় দেখতে পায় মৃত শিশু দুহাতে ধরে এগিয়ে আসছে আমেনা বেগম। দুজনকে দেখে দ্রুতপায়ে কাছে এসে বসে পড়ে চিৎকার করে কাঁদে।
-মাইয়াটা মইরা গেল ভাত খাইতে না পাইয়া। আমিও মইরা যামু ওর লগে। আমি আর বাঁচমুনা।
অঞ্জন মেয়েটিকে নিজের কোলে তুলে নেয়। শীতল হয়ে গেছে মেয়েটির শরীর। নিষ্প্রাণ দেহটির স্পর্শ ওকে শীতল করে দেয়। ও মেয়েটিকে বুখে জড়িয়ে ধরে। আমেনা বেগম মেয়েটিকে অঞ্জনের কাছ থেকে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়ে হাঁটতে শুরু করে। কান্নার ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে শরণার্থী শিবিরে। জোর কান্নার ধ্বনিতে চারদিক থেকে লোক এগিয়ে আসতে থাকে। আমেনা বেগম দ্রুত হেঁটে ঝাঁপিয়ে পড়ে নদীতে। ডুবে যায় শরীর। চারদিকে ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে সবাই। অনেক মেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। শরণার্থী শিবিরে পরিচিত হওয়া খালার জন্য কান্নার ধ্বনি আপনজনের আর্তনাদের বার্তা ছড়ায়। আমেনা বেগমের নিজের কেউ নেই। শরণার্থী শিবিরে আসার সময় পাকসেনাদের গুলিতে শহীদ হয় স্বামী আফজাল। মেয়েটিকে বুকে নিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নে মগ্ন ছিল। কিন্তু মেয়েটির মৃত্যু ওকে নিঃসঙ্গ করে দিলে বেঁচে থাকার স্বপ্ন ফুরিয়ে যায়।
চলবে...
এমএমএ/
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা: পর্ব ২৭