ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব-৪৩
দ্য ফার্স্ট ম্যান
তবে ক্যাবিল রাখাল তার পর্বতের উপরে দাঁড়িয়ে সূর্যের আলো বেয়ে ওঠা দেখে। সে আলো পর্বতকে ক্ষয় করেও দেয়। দীর্ঘ সমুদ্র ভ্রমণের পর যে উত্তর এলাকা থেকে তারা এসেছে সেদিকের স্বপ্ন মাখা দৃষ্টিতে সারসদের চলে যাওয়া দেখে সে। সারাদিন হয়তো তার স্বপ্ন দেখা চলে।
তবে সন্ধ্যা হলে এখনো সে বাকল-পাতা শোভিত খাবারের দিকে চলে যায়। লম্বা পোশাক পরা মানুষদের পরিবারের দিকে যায়। হতভাগাদের দিকে চলে যায়— তাদের কাছেই তার শিকড়। একই রকমভাবে জ্যাক বুর্জোয়া ঐতিহ্যের উপাচারের দ্বারাও উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তবে তার আনুগত্য সবদিক থেকে ঠিক তারই মতো একজন অর্থাৎ পিয়েরের প্রতিই অটুট থাকে।
রবিবার আর বৃহস্পতিবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল সোয়া ছটায় তার ঘর থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গ্রীষ্মের স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়ায় কিংবা শীতের প্রবল বৃষ্টিতে দৌড়ে যেতে যেতে দেখত, তার ছোট প্রাবার ভিজে স্পঞ্জের মতো হয়ে গেছে। পানির ফোয়ারার কাছে পৌঁছে পিয়েরেদের রাস্তায় ঢুকে পড়ত। দৌড়ের উপরেই দোতলায় উঠে আস্তে করে দরজায় টোকা দিত। পিয়েরের মা দরজা খুলে দিতেন। তিনি সুঠাম দেহের সুন্দর চেহারার একজন মহিলা ছিলেন। দরজা দিয়ে সোজা এগিয়ে গেলে দুচারটে আসবাবে সাজানো খাবার ঘর। খাবার ঘরের দুপাশেই দুটো দরজা। একটা পিয়েরে এবং তার মায়ের শোয়ার ঘরের, আরেকটা তার দুজন মামার শোয়ার ঘরের দরজা। মামাদের চেহারা কর্কশ দেখালেও তারা বেশ হাসিখুশি ছিলেন, তবে কথা খুব কম বলতেন তারা। খাবার ঘরের ডানপাশটাতে আবছা অন্ধকার ঘরটা রান্নাঘর এবং গোসলখানা। পিয়েরে ঘুম থেকে সব সময়ই দেরি করে উঠত। উঠে এসে বসত অয়েল ক্লথ বিছানো টেবিলে। শীতের দিন হলে কেরোসিনের কুপি জ্বলত। দুহাত দিয়ে বড় একটা চকচকে মাটির তৈরি বাটি ধরে মায়ের সদ্য তৈরি করা কফিতে মুখ না পুড়িয়ে চুমুক দেওয়ার চেষ্টা করত পিয়েরে। তার মা বলতেন, ফুঁ দিয়ে জুড়িয়ে খাও। পিয়েরে ফুঁ দিয়ে একেক চুমুকে অল্প একটুখানি কফি পান করে জিহ্বা চাটাচাটি করত। সামনে দাঁড়ানো জ্যাক পিয়েরের কফি পান করা দেখতে দেখতে নিজের শরীরের ভর এক পা থেকে আরেক পায়ে স্থানান্তর করত। কফি শেষ করে আবার পিয়েরেকে যেতে হতো মোমবাতি জ্বালানো রান্নাঘরের ভেতর। সেখানে এক গ্লাস পানি এবং একপ্রান্তে পেস্ট জড়ানো দাঁত মাজার একটা ব্রাশ তার জন্য অপেক্ষা করত। তার আবার দাঁতের মাড়ি ফুলে যাওয়ার রোগ ছিল। ছোট প্রাবার এবং ক্যাপ পরে নিয়ে স্কুলের ঝোলাটা তুলে নিয়ে পিয়েরে দাঁত মাজতে যেত। বেশ সময় নিয়ে সজোরে মাজতে থাকত। তারপর শব্দ করে থুথু ফেলত সিঙ্কের ভেতর। পেস্টের ওষুধের গন্ধ মিশে যেত কফির স্বাদের সঙ্গে। জ্যাক অধৈর্য হয়ে বিরক্তি প্রকাশ করত। কেননা ভালো বন্ধুত্বের জন্য এরকম দু-একটু কপট রাগ দেখানোর দরকার থাকে। তারপর দুজনে নীরবে সিঁড়ি বেয়ে রাস্তায় নামত। ট্রলিবাসের স্টেশন পর্যন্ত দুজনের মধ্যে আপাতত হাসি বিনিময় বন্ধ থাকত। তবে অন্য সময় একে অন্যকে ধাওয়া করতে করতে হাসাহাসি করত। কিংবা দৌড়ানোর সময় স্কুলব্যাগ রাগবি বলের মতো করে সামনে পেছনে চালান দিতে থাকত। বাসস্টপে পৌঁছে লাল ট্রলিবাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকত। এরপর বাসের দুতিনজন লোকের সঙ্গে তাদের যাত্রা শুরু হতো।
তারা সব সময় ট্রাক্টরে টানা গাড়িদুটো অপছন্দ করত এবং মোটরগাড়ির সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। সে কাজটা অবশ্য বেশ কঠিন ছিল। কারণ ট্রলিবাসটা ডাউনটাউনের উদ্দেশে ওঠা শ্রমিকদের ভিড়ে ঠাসা থাকত এবং তাদের নিজেদের কাঁধের স্কুল ব্যাগের কারণে সামনে এগুনো যেত না।
গাড়ি কিছুদূর এগিয়ে গেলে সামনের যাত্রীরা নেমে গেলে সে জায়গা দখল করার চেষ্টা করত তারা যাতে চালকের লোহার এবং কাচের ক্যাব এবং উঁচু সরু নিয়ন্ত্রকের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া যায়। সেটার সমতল মাথার উপরে চক্রাকারে ঘুরত ইস্পাতের তৈরি খাঁজ ওয়ালা একটা গিয়ারশিফ্টের হাতল।। সেটা দিয়ে গিয়ারের নিষ্ক্রিয় অবস্থা বোঝাত। আর তিনটা চিহ্ন দিয়ে গিয়ারের সামনের গতি বুঝাত এবং পঞ্চমটা দিয়ে বুঝাত উল্টো গিয়ার। মোটরগাড়ির লোকদের শুধু গিয়ারশিফ্ট ছুঁয়ে কাজ করার অধিকার ছিল বলে বাচ্চাদের চোখে তারা ছিল নরদেবতার মতো। এই মর্যাদা তারা বেশ উপভোগ করত বোঝা যেত। আর মাথার উপরে চিহ্নের সাহায্যে বুঝিয়ে দেওয়া হতো, তাদের সঙ্গে বাচ্চাদের কথা বলা নিষেধ। তাদের পোশাক ছিল প্রায় সামরিক কায়দার— চামড়ার চুরাওয়ালা ক্যাপ মাথায়, শুধু আরব চালকরা পরত কিনারাবিহীন টুপি। তাদের চেহারা অনুযায়ী বাচ্চারা তাদের আলাদা করে দেখত। বাচ্চারা তাদের জন্য বিভিন্ন নাম ব্যবহার করত— হালকা কাঁধ ওয়ালা নেতৃস্থানীয় একজনকে তারা বলত ‘সুন্দর ছোট মিয়া’। মোটাসোটা গঠনের আরেকজন আরব চালকের নাম ছিল ‘সাদা ভালুক’, সে সব সময় শুধু সামনের দিকেই তাকিয়ে থাকত। আরেকজন ইতালীয় চালক ছিল—তার ম্যাড়মেড়ে মুখমণ্ডল জুড়ে স্বচ্ছ বলতে ছিল একজোড়া চোখ। সব সময় গিয়ারশিফ্টের উপর ঝুঁকে থাকত সে। তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘জন্তুর বন্ধু’। কারণ একবার সে একটা অন্যমনস্ক কুকুরকে বাঁচাতে গিয়ে ট্রলিবাসটাকে প্রায় থামিয়ে দিয়েছিল। আরেকবার একটা কুকুর উদাসীনভাবে রেইলের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল দেখে সেটাকেও বাঁচিয়ে দিয়েছিল সে। ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কসের মতো গোঁফ এবং ছোটখাটো মুখওয়ালা লম্বা আরেকজনের নাম দিয়েছিল তারা ‘জোরো’।
জন্তুর বন্ধুকে তারা সত্যিকার অর্থে হৃদয় দিয়ে পছন্দ করত। তবে তাদের প্রশংসা ছিল বাদামী ভালুকের জন্য। কারণ পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে নির্বিকার চিত্তে তার শব্দ করে চলা গাড়িটা ঝড়ের গতিতে চালাত সে। রাস্তায় গাড়ি ঘোড়ার কমতি দেখলেই বিশাল বাম হাত দিয়ে কাঠের হাতলটা ধরে থার্ড গিয়ারে ঠেলে দিত। ডান হাত গিয়ারবক্সের ডান পাশে বিরাট ব্রেকহুইলের উপর পাহারারত থাকত। গিয়ারশিফ্ট নিষ্ক্রিয় রেখে চাকায় কয়েকবার জোরে চাপ দিয়ে এমনভাবে চালাত যে গাড়ি যেন লাফ দিয়ে দিয়ে এগিয়ে যেত। কোনো বাঁক কিংবা সুইচের উপরে গাড়ির ছাদের খাড়া স্প্রিংয়ের সঙ্গে লাগানো ট্রলিপোল মাথার উপরের বৈদ্যুতিক তার পার হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত। একটা ফাঁকা প্রান্তের সঙ্গে লাগানো ছোট একটা চাকা, সে চাকার সঙ্গে সংযোগ থাকত তারের। তারে বাড়ি লেগে গাড়ি সজোরে ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেলে ফুলকি ছুটত। কনডাক্টার গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে পড়ে লম্বা ট্রলিক্যাচার তার তুলে ট্রলিপোলের প্রান্তের সঙ্গে সংযোগ করে দিত। গাড়ির পেছনের দিকে একটা লোহার বাক্স থেকে তার প্যাঁচ খুলে একাই বের হয়ে আসত। ইস্পাতের স্প্রিংয়ের শক্তি সবলে ঠেকিয়ে ট্রলিপোল আস্তে আস্তে উপরের দিকে তুলে আনত সে। তারপর তার আরেকবার চাকার প্রান্তের ফাঁকায় ঢুকিয়ে দিত। এসব কাজ করত সে ছুটন্ত ফুলকির মধ্যেই। গাড়ির বাইরের দিকে ঝুঁকে কিংবা শীতকাল হলে জানালার সঙ্গে নাক লাগিয়ে বাচ্চারা কনডাক্টারের কাজকর্ম দেখত। ঠিকমতো শেষ হয়ে গেলে চালকের সঙ্গে কথা বলা নিষেধ থাকলেও তারা ফিসফিস করে তাকে জানানোর চেষ্টা করত। তবে নিয়মানুযায়ী কনডাক্টর তাকে সংকেত না দেওয়া পর্যন্ত বাদামী ভালুক নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকত। গাড়ির পেছনে ঝুলন্ত দড়ি তুলে এবং সামনের দিকের একটা বেল বাজিয়ে কনডাক্টার তাকে সংকেত দিত। আর কোনো পূর্বসতর্কতা ছাড়াই তখন বাদামী ভালুক গাড়িটা সামনের দিকে সচল করে দিত। গাড়ির সামনের দিকে ভিড় করে বাচ্চারা গাড়ির নিচে এবং উপর দিয়ে ধাতব লাইনগুলোর পেছনের দিকে দ্রুত সরে যাওয়া দেখত। বৃষ্টি কিংবা ঝলমলে রোদের সকালে ট্রলিবাস যখন দ্রুত গতিতে চলার সময় কোনো ঘোড়ায়টানা গাড়ি পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেত কিংবা দ্রুত ধাবমান কোনো অটোমোবাইলের সঙ্গে কিছুটা সময় সমানতালে এগিয়ে যেত তখন তারা আনন্দ উল্লাসে ফেটে পড়ত। প্রতি স্টপেজে ট্রলিবাস আরব এবং ফরাসি শ্রমিকদের নামাতে থাকত। ডাউনটাউনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে যাত্রীদের কারো কারো পোশাকের কেতাও জেল্লাদার হতো। আবার বেলের শব্দে যাত্রা শুরু হতো। শহরের আধাবৃত্তাকার এলাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এভাবেই তাদের ভ্রমণ চলত। তারপর হঠাৎ চোখের সামনে চলে আসত উপসাগরের বিশাল ফাঁকা এলাকার সামনের বন্দরের ছবি। উপসাগরের বিস্তৃতি ছিল দিগন্তের কাছে অবস্থিত নীল পাহাড়ের গা পর্যন্ত। আরও তিন স্টপেজের পর লাইনের শেষে ডু গুভার্নমেন্টের কাছে এলে বাচ্চারা নেমে পড়ত। ওই চত্বরের তিন দিকে গাছপালা আর খিলানঢাকা দালানকোঠা; সামনের খোলা মুখের দিকে সাদা মসজিদ এবং তার উপরেই বন্দরের খোলা পরিসর। চত্বরের মাঝখানে সামনের দুপা উপরে তোলা ঘোড়ার উপরে অরলিন্সের ডিউকের মূর্তি। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির নিচে সবটাই তাম্রমলে ঢাকা পড়ে যেত। বৃষ্টির সময় কালো হয়ে যাওয়া তামার গা বেয়ে জল গড়াত। বাচ্চারা ঘোড়াটার ওই চেহারা দেখে খুব সঙ্গত একটা গল্প ফেদে বসত। ভাস্কর মশাই নিশ্চয়ই ঘোড়ার অন্যান্য সাজসরঞ্জামের সঙ্গে লাগাম পড়াতে ভুলে গিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। বৃষ্টির পানি ঘোড়টার লেজ বেয়ে অবিরত ঘের দেওয়া ছোট বাগানের দিকে গড়াত। চত্বরের বাকি অংশ জুড়ে সবখানে পাকা করার সুরকি ছিটানো ছিল। বাস থেকে নেমে লাফাতে লাফাতে ওইসব সুরকির টুকরো তুলে ছুড়তে ছুড়তে তারা বাব আজুনের দিকে পথ ধরত। পাঁচ মিনিট হাঁটলেই লিসে পেয়ে যেত তারা।
চলবে……
আগের পর্বগুলো পড়ুন
আরএ/