ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৪১
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
কয়েক মাস পরই চৌগাছায় যুদ্ধ শুরু হয়। অঞ্জন দ্রুত চৌগাছায় পৌঁছে যায়। ওর সঙ্গে মুজফফর আর লুৎফাও আসে। অঞ্জন ওদেরকে বলে, আমাদের তো অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নাই। তাই আমরা আহতদের চিকিৎসা করব। সুস্থ করব সবাইকে। কারো যদি মৃত্যু হয় তাহলে কবর দেব তাকে। কেউ কোথাও পড়ে থাকবে না।
লুৎফা চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। বলে, আমিও আপনার সঙ্গে সবার সেবা করব। কবর দেয়ার আগে দোয়া পড়ব। জানাজা তো হবে না।
- ঠিক বলেছেন ভাবী।
অঞ্জন লুৎফার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। লুৎফা আবার বলে, আমরা একটা বড় গর্ত করব। যার যার ধর্ম তার থাকবে, কিন্তু সবাইকে এক গর্তে রেখে মাটি টেনে দেব।
- বাব্বা, আপনি তো বেশ-
- আমরা হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান খুঁজব না। সবাই আমাদের সামনে স্বাধীনতার শহীদ। আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ হবে।
- তাতো হতেই হবে। শরণার্থী শিবিরে এসে আমরা এই সত্য গভীরভাবে বুঝতে পারছি। ধর্ম যার যার দেশ সবার। শরণার্থী শিবিরে আমরা একসঙ্গে দিন কাটাচ্ছি। এখানে ধর্ম নিয়ে আমাদের কোনো বাড়াবাড়ি নাই। এখানে আমরা একটি স্বপ্ন পূরণের জায়গায় জড়ো হয়েছি। সবাই আমরা এক স্বপ্ন দেখার মানুষ। এর বাইরে আমরা আর কিছু চিন্তা করিনা।
অঞ্জনের কথা শুনে লুৎফা উৎফুল্ল হয়ে বলে, ঠিক বলেছেন দাদা। খুব সুন্দর করে বলেছেন। এমন কথা শুনলে আমার মাথা ভরে যায়। শরণার্থী শিবিরে থাকার সব কষ্ট বুলে যাই। বেঁচে থাকা ফুলে ফুলে ভরে ওঠে। ফুলের গন্ধে শ্বাস টানি।
চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই শব্দ করে হাসে। হাসতে হাসতে সিরাজ বলে, ভাবী নতুন করে কথা বলে।
মাসুম হাসতে হাসতে বলে, বুঝতে পারছি ভাবী ঢাকায় থাকলে কবিতা লিখতেন।
সবাই একসঙ্গে বলে, ঠিক ঠিক।
কারো মুখ থেকে হাসি বন্ধ হয়না। কিছুক্ষণ হাসির স্রোত বয়ে যায়। লুৎফা চুপ করে থেকে সবার মুখের দিকে তাকায়। অঞ্জন বলে, আমি আপনাকে কাগজ কলম দেব। আপনি স্বাধীনতা নিয়ে এক লাইন কবিতা লিখবেন।
- না, না, আমি পারবনা। আমিতো কখনো কবিতা পড়ি নাই।
- পারবেন, পারবেন। আপনার চিন্তা সুন্দর।
- এখন থাক। এখন এসব ভাবব না। আগে যুদ্ধে জিতব আমরা। আমার সামনে যুদ্ধ এখন কবিতা। কঠিন কবিতা। যেটা লেখা সহজ না। এটা লিখতে জীবন দিতে হয়।
মুজফফর লুৎফার পিঠে হাত রেখে বলে, এখন থাম গো। এতকথা বলার দরকার নাই।
- না, আর কথা বলব না। থামলাম।
পাশে দাঁড়ানো সবাই হাততালি দেয়। জোরে জোরে বলে, যুদ্ধ আমাদের কবিতা। কবিতা দিয়ে স্বাধীনতা আনব।
লুৎফা কথা বলে না। মুজফফর সীমান্তের ওপারে তাকিয়ে থাকে। দেখতে পায় পাকিস্তানি বাহিনী ভারতের সীমান্ত গ্রাম বয়ড়ার দিকে এগিয়ে আসছে। কিছুক্ষণ পরই তীব্র আক্রমণ চালায়। বয়ড়া গ্রামের ঢোকার চেষ্টা করছে। চৌগাছায় মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ করে। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। মুজফফর লুৎফার হাত ধরে বলে, আমরা যুদ্ধের পেছনের শক্তি হয়ে থাকব। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যা কিছু করা দরকার তা করব। আমরা আড়াল হয়ে থাকবনা।
অঞ্জন বলে, চলো ওই পাশে যাই। ওখঅনে গিয়ে দাঁড়ালে যুদ্ধের পরিস্থিতি ভালোভাবে বোঝা যাবে।
মুজফফর কড়কড় শব্দে চেঁচিয়ে বলে, পাকিস্তানি সেনারা ষোলটা ট্যাংক নিয়ে এগিয়েছে। আমি গুণেছি।
- আমিও গুনেছি। আমাদের মুক্তিবাহিনীও সমান ট্যাংক আর ভারী কামান নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করেছে।
- চলো, কতজন পাকিস্তানি সৈন্য আছে আমরা গুণে দেখি।
- গোণার কি দরকার?
- এজন্য গুণব যে কতজনের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ হচ্ছে তা দেখব।
মুজফফর বলে, আমরা ওই দিকে দাঁড়িয়ে গুণতে পারব। চলো। গুণে ফেলি।
লুৎফা চেঁচিয়ে বলে, যুদ্ধের সময় এটা তোমাদের একটা খেলা হবে। তখন প্রবল গুলির শব্দে মুক্তিযোদ্ধা সালাম মাটিতে গড়িয়ে পড়ে। অঞ্জন একদৌড়ে কাছে গিয়ে বসে পড়ে। দেখতে পায় বুকে গুলি লেগেছে। মুজাফফর কাছে এসে বলে, আপনি আর আমি ওনাকে নিয়ে ওপাশে যাই। আপনি মাথা ধরেন, আমি পায়ের দিক ধরছি। ওখানে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করব। দুজনে সালামকে তুলে নিয়ে চলে যায়। লুৎফা নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের ধারা মুছতে থাকে। সালামকে ঘাসের ওপর শুইয়ে দিলে অঞ্জন ওর কাছে রাখা যে ওষুধ আছে তা দিয়ে পরিচর্যা শুরু করে। বুকে গুলি লেগে জ্ঞান হারিয়েছে সালাম। অঞ্জন বুঝতে পারে ওকে বাঁচানো যাবে না। যতক্ষণ বেঁচে থাকবে এইটুকুই ওর যুদ্ধের সময়। ও কাউকে কিছু বলে না। কিন্তু নিজে সরে যায় না। নানাভাবে পরিচর্যা করতে থাকে। একসময় লুৎফা এসে ওর কাছাকাছি বসে। বলে, এখনও জ্ঞান ফিরল না? আমার ভয় করছে? আমি কোনো সেবা করতে পারি?
- না, কিছু করতে পারবে না। আমি যা করছি এটাই ঠিক আছে।
লুৎফা কথা বলে না। সালামের কপালে হাত রাখে। বলে, জ্ঞান ফিরলে আমি প্রথম কথা বলব। আপনি বলবেন না।
- আপনি চুপচাপ বসে থাকেন। কথা বলার দরকার নাই।
- আমি আস্তে আস্তে ওনার জন্য দোয়া পড়ব।
- পড়েন। আল্লাহতালা ওকে বাঁচিয়ে দেবে। আমাদের সামনে একজন মুক্তিযোদ্ধা মরে যাবে এটা আমরা ভাবতে পারি না।
লুৎফা মৃদু স্বরে দোয়া পড়ে। ওর কণ্ঠস্বর চারদিকে ছড়িয়ে যায়। সবাই খুব স্বস্তি বোধ করে। আহত মুক্তিযোদ্ধাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সবাই অঞ্জনের বুক শীতল হয়ে আসে। বুঝতে পারে সালামকে বাঁচানো যাবে না। ওর শরীর শীতল হয়ে আসছে। জ্ঞান ফিরবে বলে মনে হচ্ছে না।
একটু পরে মুজফফর এসে বলে, পাকিস্তানি সেনারা পাঁচশ জন আছে।
লুৎফা দাঁড়িয়ে উঠে বলে, ওরা আমাদের মুক্তিযোদ্ধার বুকে গুলি মেরেছে। ওদের সবগুলোকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা শেষ করবে।
দাঁড়িয়ে থাকা সবাই লুৎফার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ কোনো কথা বলে না। চারদিকে গোলাগুলির শব্দ প্রবল হয়ে ওঠে। দূর থেকে দেখা যায় বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ে। দূরে দাঁড়িয়ে শরণার্থীরা উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। সবাই মিলে স্লোগান দেয়, জয় বাংলা - জয় বাংলা।
অঞ্জন দেখতে পায় মরে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা সালাম। উপুড় হয়ে ওর বুকের ওপর মাথা রাখে অঞ্জন। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সবাই এসে সালামকে ঘিরে বসে।
লুৎফা বলে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধা শহীদ সালাম - জয় বাংলা।
চলবে...
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা। পর্ব- ৩৩