ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব-৪০
দ্য ফার্স্ট ম্যান
সেই বিস্মৃতিতেই তিনিও ডুবে গেছেন। কোনো রকম শিকড় ছাড়াই শুরু হয়েছিল তাদের জীবন এবং সেই জীবনের পরিণতি ওই বিশাল বিস্মৃতিতে। সময়ের গ্রন্থাগারে হয়তো আছে তাদের মতো কুড়িয়ে পাওয়াদের বসতিস্থাপনের কথা, তাদের দ্বারা গড়ে ওঠা ক্ষণস্থায়ী শহরের কথা। তারা ওইসব ক্ষণস্থায়ী শহর গড়ে তুলেছিল যেন সেখানে নিজেদের মাঝে এবং অন্যদের মাঝে মৃত্যুবরণ করার জন্যই।
মানুষের ইতিহাস যেন পুরনো ভূ-খণ্ডের উপর দিয়ে নিরবধি হেঁটে যায়। খুব বেশি স্পষ্ট পদচিহ্ন রেখে যায় না। যেটুকু চিহ্ন থাকে সেটুকুও চিরন্তন সূর্যের প্রখর তাপে বাষ্পে পরিণত হয়ে যায়। যারা ওই ভূখণ্ড তৈরি করেছিল তাদের স্মৃতিও খুন আর ঘৃণার আগুনে পরিণত হয়েছে। তার আকস্মিক প্রকোপের ফলে ঝড়েছে রক্তের ধারা। দ্রুত তৈরি হয়েছে ক্ষত। আবার দ্রুত শুকিয়ে গেছে ঠিক এই দেশের মৌসুমি নদীগুলোর মতোই। এখন রাত নেমে আসছে, যেন সরাসরি মাটির ভেতর থেকে, দেশের বুকের ভেতর থেকে। যেন সব সময়ের আকাশতলে জীবিত মৃত সবকিছু গিলে খাওয়ার জন্য নেমে আসছে এই রাত। না, জ্যাক বাবাকে কখনো জানতে চিনতে পারবে না।
বাবা ঘুমিয়ে আছেন ওখানে, ওই মাটিতে। তার মুখটা ছাইয়ের মধ্যে মিশে গেছে, হারিয়ে গেছে। বাবাকে ঘিরে ছিল একটা রহস্য। সেই রহস্যের ভেতর সে প্রবেশ করতে চেয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে, যে রহস্য পাওয়া গেছে সেটা ছিল দারিদ্রের রহস্য। দারিদ্র মানুষকে তৈরি করেছে নামহীন অবস্থায়। সে মানুষের যেন কোনো অতীত নেই। দারিদ্র তাদের সবাইকে ঠেলে দিয়েছে মৃতদের বিশাল ভীড়ের মধ্যে। ওই মৃতরা পৃথিবী তৈরি করেছে; বিনিময়ে নিজেরাই চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেছে। লাব্রাডরে করে যারা দেশান্তরে বের হয়েছিল তাদের নিয়তির সঙ্গে জ্যাকের বাবার নিয়তির এখানেই মিল। সেহেলের মাহুন গোত্রের লোকেরা, উঁচু মালভূমির অ্যালসেসীয়রা ছড়িয়ে পড়েছিল সমুদ্র আর মরুভূমির মাঝের বিশাল দ্বীপাঞ্চলে। পরিচয়হীনতার নীরবতা সেই বিশাল অঞ্চলটা গ্রাস করতে শুরু করে। রক্ত, সাহস, কর্ম আর প্রবৃত্তিও গ্রাস করে ফেলে।
সেই নীরবতা একই সঙ্গে নিষ্ঠুর এবং করুণাময়। আর যে দেশ থেকে, মানুষদের ভীড় থেকে, নামহীন পরিবার থেকে নামহীন অবস্থায় পালাতে চেয়েছিল এবং যার ভেতরে অন্ধকার আর নামহীনতা গজিয়ে উঠেছিল সেও ওই গোত্রেরই একজন হয়ে যায়। সেও ডাক্তারের ডানপাশে থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে রাস্তার মোড়ের উচ্চনাদী সংগীতের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে, বাদন মঞ্চের চারপাশের আরবদের দুর্বোধ্য মুখগুলো আরেকবার দেখতে দেখতে, ভেইলার্ডের হাসি আর কঠিন চাহনির মুখের দিকে তাকিয়ে রাতের মধ্যে এগিয়ে যেতে থাকে। তার মনে ভেসে ওঠে বোমা পতনের সময় মায়ের মুখের ওপরের মৃত্যু-সদৃশ চেহারা। সেই মুখচ্ছবি তার হৃদয় মিষ্টি আর দুঃখী একটা অনুভূতিতে মোচড়াতে থাকে।
বছরের পর বছর সময়ের ব্যাপ্তি জুড়ে থাকা রাতের ভেতর ঘুরতে ঘুরতে সে চলে যায় বিস্মৃতির দেশে। সেখানে সবাই প্রথম মানব। সেখানে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়েছে পিতৃহীন অবস্থায়; বাবা নিজের মুখে ছেলেকে ডাক দিলে কী অনুভূতি জাগে, সে মুহূর্ত কেমন তার জানা হয়নি কখনো। অন্যদের কথা বুঝতে পারার বয়স পর্যন্ত তার জন্য অপেক্ষা করে পরিবারের গোপনীয় বিষয়াদি সম্পর্কে তার সঙ্গে কথা বলার জন্য, কিংবা সুদূর অতীতের কোনো দুঃখ অথবা জীবনের কোনো অভিজ্ঞতা তার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছে সে। এরকমই কোনো মুহূর্তে হাস্যকর পোলোনিয়াম তার কাছে হঠাৎ করে মহান হয়ে ওঠে যেহেতু সে লিয়ারটেসের সঙ্গে কথা বলে। তারপর তার বয়স হয়ে গেল ষোল, এরপর বিশ।
কিন্তু কেউ তার সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে আসেনি। জীবন জগত সম্পর্কে তাকে নিজে জানতে হয়েছে; ধৈর্য ধারণ করে একা একা বড় হতে হয়েছে। নিজের শক্তি বলে নিজের নৈতিক শক্তি আর সত্যকে খুঁজে নিতে হয়েছে। শেষে মানুষ হিসেবে জন্ম নেওয়া এবং অন্যদের সংশ্লিষ্টতায় শিশু হিসেবে কঠিন অবস্থায় জন্ম নেওয়া, এখানকার পুরুষরা যেমন শিকড় ছাড়া এবং বিশ্বাস ছাড়াই বেঁচে থাকতে শেখে তেমনি নারীরাও। চিরন্তন পরিচয়হীনতা এবং পৃথিবীতে নিজের একমাত্র চিহ্ন মুছে যাওয়ার হুমকির মুখে পড়েছে আজ তারা সবাই। রাত তাদের অস্পষ্ট কবর ফলক ঢেকে দিয়েছে। অন্যদের সংশ্লিষ্টতায় তাদের বেঁচে থাকতে শিখতে হয়েছে। অন্যদের, মানে বিজেতাদের যারা এখন ক্ষমতাবর্জিত হয়ে পড়েছে তাদের সংশ্লিষ্টতায়। এই বিভূঁইয়ে তারাই প্রথম এসেছিল এবং তাদের মধ্যেই বর্তমানের মানুষগুলোকে ভ্রাতৃত্ব, জাতি এবং গন্তব্য খুঁজে নিতে হচ্ছে।
বিমান এখন আলজিয়ার্সের দিকে নেমে যাচ্ছে। সেইন্ট ব্রিউকের ছোট কবরখানার কথা মনে পড়ছে জ্যাকের। ওখানে সৈনিকদের কবরগুলো মনডোভির কবরগুলোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো অবস্থায় রাখা হয়েছে। ভূমধ্যসাগর আমার মনের ভেতরের ভুবন দুভাগে ভাগ করে ফেলছে: এক দিকে স্মৃতি আর নামগুলো পরিমাপমতো জায়গায় সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। অন্য অংশে খোলা প্রান্তরে মানুষের সব চিহ্ন মুছে দিয়ে গেছে বাতাস আর বালির ঝড়। দরিদ্র, অজ্ঞ আর পশুর মতো জীবন থেকে এবং পরিচয়হীনতা থেকে সে পালাতে চেষ্টা করেছে বর্তমানের বাইরে, কোনো চিন্তা নেই যে জীবনে সেই বোবার মতো অন্ধ সহিষ্ণুতার জীবন যাপন করতে সে পারেনি। অনেক দূরে দূরে সে ভ্রমণ করে বেরিয়েছে।
অনেক কিছু তৈরি করার চেষ্টা করেছে, সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছে। মানুষজনকে ভালোবেসেছে। আবার ছেড়েও এসেছে তাদের। তার জীবন মাঝে মাঝেই ভরপুর হয়ে উপচে পড়েছে। তবু এখন সে অন্তরের অন্তস্থল দিয়ে বুঝতে পেরেছে, সেইন্ট ব্রিউক এবং এর সকল তাৎপর্য তার কাছে যেন কিছুই নয়। একটু আগে ছেড়ে আসা ক্ষয়ে যাওয়া নীল আবরণ ধারণ করা কবরস্থানের কথা তার মনে আসছে। মনে আসছে, মৃত্যু তাকে তার সত্যিকারের মাতৃভূমিতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে ভাবনাটা মনে আসতে কিছুটা যেন আনন্দের ছোঁয়া অনুভব করে সে। যে মানুষটি সমুদ্র পাড়ের ভাগ্যবাহী দেশে এসে কারো সাহায্য ছাড়াই দারিদ্রের মাঝে নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন দেশত্যাগী ওই সাধারণ মানুষটিকে মৃত্যু তার বিশাল বিস্মৃতি দিয়ে তার সব চিহ্ন মুছে দেবে। পৃথিবীর প্রথম সকালের আলোয় একাকী স্মৃতিহীন বিশ্বাসহীন অবস্থায় তার সমসাময়িক মানুষদের জগতে, তাদের ভয়াবহ এবং মর্যাদাসম্পন্ন ইতিহাসে তিনি প্রবেশ করেছিলেন।
চলবে...