ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩৭
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
দ্রুতপায়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে ও কান্নারত আর এক শিশুর কাছে যায়। তাঁবুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে বেরিয়ে আসে ওর বাবা।
- কি হয়েছে বাচ্চাটার? কাঁদে কেন?
-বলে যে পেট ব্যথা করছে।
এবং এই পর্যন্ত সংশোধণ করা হলো
-কি খাইয়েছেন?
-আমি জানিনা, ওর মা জানে।
হঠাৎ করে কান্না থেকে যায়। গড়িয়ে পড়ে ছেলেটি।
অঞ্জন আঁতকে উঠে বলে, কি হলো?
-কি আর হবে, কান্না বন্ধ করেছে।
-আপনি ওকে বাইরে নিয়ে আসেন।
মুজাফফর ভেতরে ঢুকে ছেলেকে কোলে করে বাইয়ে আনে। বুকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। অঞ্জন ওকে কোলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখে যে, মরে গেছে বাচ্চাটি। ও মুখে কিছু বলেনা। শরণার্থী শিবিরে এমন মৃত্যু প্রায়ই দেখতে হয়। কিছু করার উপায় নাই। মুহূর্তে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে ওর বাবা। পেছন থেকে ওর মাও। মৃত শিশুটিকে ওদের কোলে দিতে হবে এই ভাবনা ওকে মর্মাহত করে। সেজন্য শিশুটিকে বুকে জড়িয়ে রাখে। চোখ থেকে জল ঝরতে শুরু করে। অঞ্জন তাঁবুর সামনে এসে দাঁড়ায়। দুকান ভরে বাবা-মায়ের কান্নার শব্দ শোনে। এ কান্না থামানোর জন্য কিছু বলার নেই। এখন বুকের ভেতরে নদীর স্রোতের মতো বয়ে যাবে কান্নার ঢেউ।
ছেলেকে কোলে নিয়ে মুজাফফর এগিয়ে যেতে থাকে। ধানক্ষেতের পাশে গিয়ে বসে পড়ে। মৃত ছেলেকে কোলে রাখে। আশপাশের থেকে লোকজন আসতে শুরু করে। কেউ কেউ মুজাফফরের পাশে বসে। বাকিরা এদিক ওদিকে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কোনো কথা বলে না। মৃত ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে থাকা বাবাকে কি বলবে? কবর দিতে হবে এটাতো বাবাই ভালো জানে। বলবে কি, একটা কি কবর খুঁড়ে দেব? না, সে কথা কেই বলবে না। এখানে খোঁড়া হবে না, গর্ত খুঁড়তে হবে। সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তখন মুজাফফর ছেলে ঘাসের ওপর শুইয়ে রেখে বলে, আসেন আমরা জানাজা পড়ি।
-এটাতো জানাজা পড়ার জায়গা না। সবাই একসঙ্গে দাঁড়াতে পারব না।
-সেটাতো আমিও দেখছি। যেখানে পারি এলোমেলোভাবে দাঁড়াই। তাও জানাজা হোক। সবাই ধানক্ষেতের পাশে এলোমেলোভাবে দাঁড়ায়। সবাই যারা যার মতো করে সুরা পড়ে। আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে সবার কন্ঠস্বর। সুরার শব্দ শুনে বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে আসে অনেকে। তারাও মাথায় টুপি দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। সকলের বুকের ভেতর তড়পায় শোক। ঘাসের ওপর রেখে দেয়া শিশুটির দিকে তাকালে পানিতে চোখ ভরে যায়।
একসময় শেষ হয় দাঁড়িয়ে থাকা। তারপর দা দিয়ে গর্ত খোঁড়ে কেউ কেউ। মাজাফফর ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকে। মৃদুস্বরে সুরা পড়ে ছেলের সারা গায়ে ফুঁ দিয়ে। চোখের পানি মুখে শেস করতে পারে না। মোছার চেষ্টাও করে না। লুৎফা তাঁবুতে গড়াগড়ি করে কাঁদে। ভাবে, তাঁবুতে ফিরলে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখবে। বলবে, কেঁদো না গো। তোমাকে আর একটি ছেলে উপহার দিব। পরক্ষণে ভাবে, লুৎফা কি মানবে এমন কথা? ও বলবে আল্লাহর কাছে চাও। নামাজ পড় আর চাও। আল্লাহর রহমত হলে আমরা আর একটি ছেলে না হয় একটি মেয়ে পাব। মুজাফফর নিজের ভাবনায় ম্লান হয়ে যায়। লুৎফার কাছে এমন কথা শুনতে চায় না ও। সুতরাং ছেলে উপহার দেবে এমন কথা বলা মানে নিজের সঙ্গে প্রতারণা করা। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে মুজাফফর। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। কেউ কোনো কথা বলেনা। দেখতে পায় মুজাফফর ছেলেটিকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে আছে কঠিনভাবে, যেন ওকে কবরে নামাবেনা। এভাবে নিজের বুকে রেখে দিন কাটাবে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা হাবিবুর ওর পাশে বসে বলে, ছেলেটিকে আমার কাছে দাও। আমি কবরে নামাই।
-না, আমি নামাব। আমি ওকে সুন্দর করে শুইয়ে দেব। যেন ওর কোনো কষ্ট না হয়।
-মাটিতে শোয়ালেতো কষ্ট হবে।
-তাহলে একটা ছোট চাদর নিয়ে আসি।
-না, খবরদার না, কবরে এসব চলবে না। তুমি কি আগে কখনো কবর দেয়া দেখনি?
-হাবিবুর চুপ করে থাক। আমার সঙ্গে কথা বলোনা।
-হ্যাঁ, চুপ করলাম। তুমিও চুপ করো। মরে যাওয়া একটি শিশুর আবার কষ্ট কি?
-তাতো ঠিকই বলেছো। কষ্ট থাকবে বেঁচে থাকা সবার। মৃত্যু মানে কষ্টের বাইরে চলে যাওয়া।
-এত কথা না বলে আমার মানিককে কবর দেই। গর্ত খুঁড়ি। তোমরা ওর জন্য দোয় কর। সবাই বসে পড়ে যে যার মতো দোয়া করো। মৃত ছেলেকে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রেখে বাবা ওকে কবরে নামায়। তারপর দুহাতে মাটি টেনে দেয়। টানা শেস হলে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। দুহাতে মুখ ঢেকে রাখে। তার চিৎকার ছড়িয়ে যায় চারদিকে। আশপাশ থেকে অনেকে এসে তাকে ঘিরে দাঁড়ায়। পানিভরা চোখে সবার দিকে তাকায় মুজাফফর। দুহাতে চোখের পানি মুখে মাথা ঝাঁকায়। কেউ কোনো কথা বলেনা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। মুজাফফার একটুক্ষণ পরে বলে, আমি যাই। বউয়ের অবস্থা দেখি গিয়ে, ওতো কাঁদতে কাঁদতে বেহুঁশ হয়ে যায়।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি যান মুজাফফর ভাই। ভাবীকে সামাল দেন।
মুজাফফর কারো সঙ্গে কথা না বলে দ্রæত পায়ে হাঁটতে শুরু করে। তাঁবুর কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পায় লুৎফা কাঁদছে। কান্নার ধ্বনি বুকের ভেতর গেঁথে নেয় মুজাফফর। তাঁবুর ভেতরে ঢুকে বুকে জড়িয়ে ধরে লুৎফাকে। দুই চোখে চুমু দিয়ে চোখের পানি মুছে দিতে চায়। কিন্তু মোছা হয়না। পানি গড়াতেই থাকে লুৎফার দুই চোখ বেয়ে। ওর মাথা বুকে জড়িয়ে রেখে মুজফফর বলে, আর কেঁদোনা। ছেলের জন্য দোয়া কর।
লুৎফা কথা বলেনা। চুপ করে থাকে।
-কিছু বলছ না কেন?
লুৎফা দুহাতে চোখের পানি মোছে। নিজের মাথা ধাম করে মুজাফফরের ঘাড়ের ওপর রেখে দুহাতে জড়িয়ে ধরে স্বামীকে। সন্তান হারানোর বেদনা কাটিয়ে ওঠা যাবেনা, এমন চিন্তায় নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। মুজফফর লুৎফাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বলে, আমাদের ছেলে স্বাধীনতার স্বপ্ন হয়ে মরে গেছে। ওকে আমরা স্মরণ করে বলব, ও আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন, স্বপ্ন।
-ঠিক বলেছো।
লুৎফা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে। আমি আমার মরণের আগ পর্যন্ত ওকে স্বাধীনতার স্বপ্ন বলতে থাকব। মুজফফর বউকে ছেড়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজের চোখ থেকে পানি গড়ায়। লুৎফা ওর দিকে তাকায়না। ওকে নাস্তা খাওয়ানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভাবে প্রথমে এক চামচ সুজির হালুয়া নিজে ওর মুখে দেবে। মুহূর্তে মনে হয়, যুদ্ধ-জীবন এমনই। মৃত্যুও প্রাণের টান হয়ে দাঁড়ায়। পরক্ষণে নিজেকে বলে, এটা তো যুদ্ধ না স্বাধীনতার স্বপ্ন।
চলবে..