ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩৬
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
অঞ্জন দ্রুতপায়ে হেঁটে যায়। মাথায় ভেসে ওঠে সুশান্তের চেহারা। ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। চৌগাছা সীমান্তে। ওখান দিয়ে ভারতে ঢুকে বনগাঁও হাসপাতালের কাছে ওরা একটি বাড়ি ভাড়া করে থাকে। এখনো ওরা ওখানে আছে। পরিবারের সবাই মিলে নানা কাজ করে সংসার চালায়। সুশান্তর কাছে গেলে বনগাঁও হাসপাতাল থেকে ওষুধ আনতে পারবে। কিন্তু যেতে সময় লাগবে। যশোর রোডের ধুলোমলিন রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শরণার্থী জীবনের অনুভব ওকে দায়িত্বের চেতনায় গম্ভীর করে। পথের রেখা স্তব্ধ হয়ে চেপে যায় বুকের ভেতর। ও মাথার উপর ছড়িয়ে থাকা গাছের ডালের ফাঁক দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। নিজেকে বলে, এই আকাশ আমার স্বাধীনতার পতাকা। একটুপরে রাস্তার ধারে বসে থাকা একজনের ট্রানজিস্টারে শুনতে পায় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ অনুষ্ঠানের খবর। খবর শুনে অঞ্জন অনুপ্রাণিত হয়। ভালো করে শোনার জন্য রাস্তার ধারে যার ট্রানজিস্টার তার কাছে বসে পড়ে। জানতে পারে যে আগস্টের ১ তারিখে নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারে একটি গানের অনুষ্ঠান হবে। বর্তমানে পণ্ডিত রবিশংকর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তার লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা। পাশাপাশি টিকিট বিক্রির মাধ্যমে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা শরণার্থীদের আর্থিক সাহায্য হিসেবে দেওয়া হবে।
বিষয়টি জানতে পেরে অঞ্জন একদিকে যেমন অনুপ্রাণিত হয়, অন্যদিকে তেমন মনখারাপ করে। ভাবে, যদি ও নিজেও এই কনসার্টে থাকতে পারত! তাহলে স্বাধীনতার গৌরবগাঁথা আজীবন স্মৃতির সঞ্চয়ে রাখতে পারত। নিজে শরণার্থী হয়ে একটি দিক পেয়েছে। কিন্তু আর কোথাও যুক্ত হওয়ার সুযোগ এখন আর নাই। নিজে নিজে ভাবে কনসার্টের পুরো খবরটা ট্রানজিস্টার থেকে জেনে নেবে। সবসময় খুলে রাখবে। এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ অঞ্জনকে অনুপ্রাণিত করে। মেঠো পথে হাঁটার জন্য পায়ের স্যান্ডেল খুলে হাতে নেয়। তারপর পা ঘঁষে ঘঁষে হাঁটতে থাকে। মনে হয় মাটি আর আকাশ এক হলে এভাবে হেঁটে যাওয়া ব্যক্তির পায়ে সমুদ্রের ছোঁয়া থাকে। সেটা দেশপ্রেমের সমুদ্র। নিজের এমন ভাবনায় নিজের বুকের ভেতর উচ্ছ্বাস বয়ে যায়। নিজেকে আনন্দে রাখার এমন দিক ও মনের ভেতর রাখে। নিজের উচ্ছ্বাসকে নিজে উপভোগ করে। হঠাৎ মনে করে, এমন করে কি অন্যরা ভাবে? নিজের ভেতরে উচ্ছ্বাসের জোয়ার তৈরি করে? ধুত, কি যে সব ভাবছি! পরক্ষণে নিজেকে ধমকায়। অন্যের ভাবনার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করছে কেন? যে যার মতো দিন কাটাবে। একর সঙ্গে অন্যের ভাবনা মিলবে কেন? শয়তান একটা, নিজেকে ধমকায়। কঠিনভাবে নিজেকে শাসন করে। দেখতে পায় রাস্তার পাশে কয়েকজন শিশু চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ও এগিয়ে যেতে থাকলে শিশুরা দৌড়ে ওর কাছে আসে। চারদিক দিয়ে ওকে ঘিরে ধরে। ওরা কাছে এসে দাঁড়ালে অঞ্জন একে একে ওদের মাথায় হাত রেখে বলে, ভালোইতো তোরা সবাই মিলে খেলা করছিস।
তিনচার জন একসঙ্গে বলে, আপনি আমাদের একটা ফুটবল কিনে দেন কাকু। আমরা ফুটবল খেলব।
এখানেতো ফুটবল খেলার মাঠ নেই।
মাঠ লাগবে না। আমরা এই রাস্তাতে খেলব।
না, না রাস্তায় ফুটবল খেলা ঠিক হবে না। রাস্তা দিয়ে লোকজন হাঁটাহাটি করে।
চিৎকার করে ওঠে শিশুরা, আমরা কি কোনো দিন একটা ফুটবল পাব না। ফুটবল খেলা ছাড়া বড় হবো?
দেশ স্বাধীন হলে তোরা ফুটবল খেলবি নিজের দেশে গিয়ে।
কবে দেশ স্বাধীন হবে?
আমরাতো যুদ্ধ করছি। যেদিন যুদ্ধে জিতব সেদিন স্বাধীন হবে।
তাহলে আমরাও যুদ্ধ করব।
তোরাও যুদ্ধ করবি! ওহ্ স্বাধীনতা, স্বাধীনতা! হাসতে হাসতে ওদের মাথার ওপর হাত রাখে অঞ্জন। ছেলেরা হাততালি দিতে দিতে চেঁচিয়ে বলে, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা। ওদের হাততালি থামলে অঞ্জন বলে, তোরা আমার সঙ্গে গান কর।
কী গান? আমরাতো গান গাইতে জানি না।
আমার সঙ্গে গাইবি।
আচ্ছা, আচ্ছা।
অঞ্জন গাইতে শুরু করে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
এক লাইন গানে মুখর হয়ে ওঠে শরণার্থী এলাকা। শিশুদের কণ্ঠস্বর প্লাবিত করে বেঁচে থাকার সমুদ্র। চারপাশ থেকে লোকজন বেরিয়ে ওদের ঘিরে দাঁড়ায়। কেউ কেউ অঞ্জনকে বলে, পুরো গানটা গেয়ে শোনান।
আমার মুখস্থ নাই। আপনারাও একটা লাইন গান।
আপনি আবার শুরু করেন।
অঞ্জন আবার শুরু করে।
সবার কণ্ঠে সুরের ছোঁয়ায় ধ্বনিত হয় ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ কিছুক্ষণ পর গান থামলে শব্দ হতে থাকে, সোনার বাংলা, সোনার বাংলা, আমার সোনার বাংলা। লোকজন নানাভাবে উচ্চারণ করে। ভেসে ওঠে মানুষের আবেগের ধ্বনি। অঞ্জন অভিভূত হয়। শুনতে ভালো লাগে। দু’কান পেতে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় গাছের কান্ডে মাথা ঘঁষে। দেখতে পায় সোনার বাংলা বলতে বলতে চলে যাচ্ছে সবাই। যে যেদিকে যাক না কেন সবার বুকের ভেতরে শব্দ দুটি এক হয়ে থাকে। বিশাল মাত্রায় ফুলের মতো ফুটে থাকে। সৌরভ ছড়িয়ে যায় বিশ্বজুড়ে। অঞ্জন নিজের ভাবনায় আলোকিত হয়ে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে। দ্রুতপায়ে হাঁটতে থাকে যশোর রোড ধরে। এখান থেকেই একদিন স্বাধীন দেশে ফিরবে। এই প্রত্যাশা বুকের ভেতর ঢং ঢং করে। তখন রাস্তার ধার থেকে একজন নারী দৌঁড়ে আসে।
ডাক্তার সাহেব
কি হয়েছে বুবু?
আমার স্বামীর জ¦র এসেছে। কাশিও হচ্ছে।
চলেন দেখি
দুজনে একসঙ্গে হেঁটে যায়। তাঁবুতে ঢুকে রোগীর পাশে বসে পড়ে অঞ্জন। পকেট থেকে থার্মোমিটার বের করে জ¦র দেখে। দেখতে পায় প্রবল জ¦রে আক্রান্ত আমিন মিয়া। জ¦র দেখে নিজেই আঁতকে ওঠে। কিন্তু মুখে কিছু বলেনা। পকেট থেকে জ¦রের ওষুধ বের করে পানি নিয়ে খাইয়ে দেয়। বাকি ওষুধ সখিনার হাতে দিয়ে বলে, বুবু এগুলো রাখেন। সকাল দুপুর রাতে একটি করে খাওয়াবেন। আমি যাই। দরকার হলে আমাকে ডাকবেন।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
অঞ্জন যশোর রোডে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকায়। হাঁটতে হাঁটতে কখনো পায়ের ধুলো ঝাড়ে। একসময় মনে হয় শরীরজুড়ে ধুলো মাখিয়ে নিলে মনে হবে স্বাধীন দেশকে ধারণ করেছে বুকের ভেতর। তখন বিভিন্ন তাঁবু থেকে শিশুদের কান্নার শব্দ ভেসে আসে। দ্রুতপায়ে হেঁটে যায় এক এক তাঁবুতে। ওদের কি হয়েছে, নাকি কিছু হয়নি। নিজেকে এমন প্রশ্ন করে বিব্রত হয় অঞ্জন। একটি তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে জিজ্ঞেস করে, কি হয়েছে বাচ্চাটির?
ওর মা মাথা নাড়িয়ে চোখ মুছে বলে, ছেলেটার জ¦র এসেছে। কি খাওয়াব জানিনা। আমার কাছে কোনো খাবার নাই। ওতো অনেক কিছু খেতে চায়?
অঞ্জন পকেট থেকে থার্মোমিটার বের করে বলে, দেখি কত জ্বর আছে?
দেখেন, দেখেন। মা ছেলেটিকে কোলে তুলে ধরে।
মাটিতে বসে বাচ্চাটিকে নিজের কোলে নেয়। থার্মোমিটার বগলের নিচে দিয়ে ওকে দুহাতের মাঝে আটকে রাখে। ছেলেটি চোখ বুঁজে মাথা নেতিয়ে পড়ে। থার্মোমিটারে একশর উপরে জ¦র দেখে ওর মাথা গুমগুম করে ওঠে। দ্রুত ওষুধ সংগ্রহের জন্য যেতে হবে। নইলে জ¦রের ঘোরে ও বাঁচবে বলে মনে হয়না। ওর বিষণœ মুখের দিকে তাকিয়ে মা বলে, ওষুধ কোথায় পাব? আমি দেখছি। আমি যাব ওষুধ আনতে। এখন আসি।
চলব...
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা। পর্ব- ৩৩