ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩৫
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
স্লোগানে মুখর হয়ে উঠে শরণার্থী শিবির। অঞ্জন স্লোগান দিতে দিতে নিজের তাঁবুর দিকে হাঁটতে শুরু করে। অন্যদিকের লোকজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে, কি হয়েছে? কোনো নতুন খবর আছে?
-নতুন খবরের জন্য আমরা স্লোগান দিচ্ছি। তবে এটাও ঠিক খবর না পেয়ে স্লোগান দিয়ে লাভ কি?
-তবে দিচ্ছেন কেন?
-মনের আনন্দের জন্য দেই। ভবিষ্যতের খুশির খবর নিয়ে আমরা স্বাধীন দেশে যাব। বঙ্গবন্ধুকে দেখব। এজন্য নিজেদের প্রস্তুত করছি। যেন কোনোভাবে কোনো দুঃখের খবর না পাই। আমাদের আনন্দ তোমরাও বুকে তুলে নাও।
সঙ্গে সঙ্গে স্লোগান দেয় কয়েকজন-জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। পেছনে দাঁড়ানো একজন তরুণ মামুন গেয়ে উঠে গানের লাইন- ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি, আকাশে বাতাসে ওঠে রণি।’ এক লাইন গান শুনে সবাই হাততালি দেয়। একজন বলে, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আমরাও এই গান শুনেছি, কিন্তু মুখস্ত করতে পারিনি।
মামুন বলে, আপনারা শিখতে চাইলে আমি গানটা সবাইকে শেখাব।
অঞ্জন উচ্চস্বরে বলে, সবাই শিখবে। আমিও শিখব।
একসঙ্গে উচ্চারিত হয়, আমরাও শিখব। আমরা গান গাইতে পারিনা, কিন্তু এই গানটি গাইলে বঙ্গবন্ধুকে আমাদের বুকের ভেতর দেখতে পাব। তার অপূর্ব সুন্দর চেহারা ভেসে উঠবে চোখের সামনে। আমরা তার পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ব।
-সাবাস। ভরে উঠেছে শরণার্থী শিবির। এখানে আমাদের কোনো কষ্ট নেই। আমরা না খেয়ে থাকলেও মরে যাব না। সবার মনের শক্তি এভাবে ধরে রাখতে হবে।
-ঠিক, ঠিক। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বঙ্গবন্ধু।
-চলো, এই স্লোগান দিতে দিতে রাস্তা ধরে এগোই। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হবে সবাই। কেউ বসে থাকবে না।
অঞ্জন নিজে শুরু করে, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বঙ্গবন্ধু।
সবাই মিলে স্লোগান দিতে শুরু করলে সরব হয়ে উঠে যশোর রোডের শরণার্থী শিবির। চারদিক থেকে ছুটে আসে অন্যরা। পথজুড়ে বিশাল সমাবেশ স্লোগানে মুখর করে সবাই। সীমান্তের কাছে এসে শেষ হয়ে যায় মিছিল। কিন্তু স্লোগান ফুরোয় না। চলতে থাকে আরও কিছুক্ষণ। চারদিক থেকে শিশুরা দৌড়াতে দৌড়াতে আসে। একসময় বড়দের স্লোগান থেমে গেলে শিশুরা বলতে থাকে, আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বঙ্গবন্ধু। ওরা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। এদিক-ওদিকে দৌড়াতে থাকে। ওদের কণ্ঠস্বরে স্লোগানের বলিষ্ঠতা মায়াবী উচ্চারণে ভরে থাকে। বড়রা তাকিয়ে থাকে ওদের দিকে। কাছে এলে মাথায় হাত দিয়ে আদর করে। ওরা হাসিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলে কণ্ঠস্বরে স্লোগানের ধ্বনি ব্যাপকতা লাভ করে, যেন শরণার্থী শিবিরে বেঁচে থাকার আনন্দের উচ্ছ্বাস প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে বসন্তের বাতাস হয়ে। অঞ্জন বুকভরে শ্বাস টানে। কাছে আসা শিশুদের বুকে টেনে ধরে। কাউকে কাউকে বলে, আয় একসঙ্গে স্লোগান দেই। আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের বঙ্গবন্ধু। আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিশুরা সবাই ওর সঙ্গে গলা মেলায়। বসন্তের বাতাস আরও প্রবলভাবে প্রবাহিত হয় উঠে যায় নীল আকাশের তটরেখায়। অঞ্জন প্রবলভাবে আন্দোলিত হয়। ভাবে শরণার্থী শিবিরের সুবর্ণরেখা ওদের মাথায় ছুঁয়ে নীল আকাশে ছড়িয়ে আছে। এভাবে স্বাধীনতার স্বপ্ন গৌরব-দীপ্ত হয় শিবিরে বাস করা সবার কাছে। কয়েকজন বলে, আমাদের কোনো কষ্ট নেই। আমরা আনন্দের জোয়ারে আছি। ভেসে যাচ্ছি হাজার হাজার নৌকা ভরা ফুল নিয়ে। ফুলের গন্ধে ভরে আছে প্রকৃতি। আমাদের স্বাধীনতা আমাদের স্বপ্নের ঘর।
সবাই হাততালি দেয়। হাততালি থামলে অঞ্জন সবাইকে বলে, চলো আমরা সীমান্ত পার হয়ে নিজের দেশের মাটি ছুঁয়ে আসি।
-ঠিক, ঠিক। যাই আমরা। মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে আসব।
-অঞ্জন ভাই আপনি যাবেন না?
-যাব, যাব।
দুপা হেঁটে অঞ্জন উপুড় হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকায়। ওর দেখাদেখি অন্যরাও তাই করে। অঞ্জন মাথা উঁচু করে বলে, বাংলার মাটি আমাদের প্রাণের মাটি। জন্ম হয়েছে এখানে, মৃত্যুও হবে এই মাটিতে। বাংলার মাটি আমাদের মাটি। কয়েকবার কথাটি বলে অঞ্জন নিজের দেশের মাটি ছেড়ে ভারতের মাটিতে ঢোকে। বলে, নিজেদের স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় এই মাটিও আমাদের প্রিয় মাটি। ঠাঁই দিয়েছে বেঁচে থাকার অধিকার সামলে নিয়ে। আবার স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করার মহান ব্রতে। সেজন্য আমাদের দায়িত্ব হবে স্বাধীনতার জন্য নিজের শক্তি কাজে লাগাতে। আমরা যেন সময়ের বরখেলাপ না করি।
-অঞ্জন ভাই আপনি আমাদের চেয়ে বেশি বোঝেন। আমরা শুধু বুঝি প্রশিক্ষণ নেওয়া আর যুদ্ধে যাওয়া।
-এটাইতো স্বাধীনতার যুদ্ধের বড় দিক। তোমরা ঠিকই বোঝ।
-আর কতদিন আমাদের যুদ্ধ করতে হবে অঞ্জন ভাই?
-যতদিন আমরা পাকসেনাদের হারাতে না পারি ততদিন। ধৈর্য রাখ সবাই।
সবাই হাততালি দিয়ে বলে, জয় বাংলা-জয় বঙ্গবন্ধু। আমরা করব জয়।
-চলো, কে কেমন আছে জেনে দেখি। সব তাঁবুতে যেতে হবে।
-আপনি তো ডাক্তার, আপনি একা যান।
-কেন একা যাব? আপনারা কি সবার ভালোমন্দ জানতে চান না?
-আমরা জানতে চাই। কিন্তু আমরা চাই না যে একসঙ্গে গিয়ে ভিড় করি। আমরা সবাই সবার খোঁজ রাখব।
-ঠিক আছে, যে যার মতো চলে যান। সবাই এদকি-ওদিক চলে যায়। একটি তাঁবু থেকে শিশুর কান্না শুনতে পেয়ে অঞ্জন সেদিকে যায়। দরজায় দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে, মা আপনি কি ভেতরে আছেন?
-হ্যাঁ আছি। আপনি কে?
-আমি ডাক্তার অঞ্জন। বাচ্চা কাঁদছে কেন তা জানতে এসেছি।
-ওর পায়খানা হচ্ছে, পেট ব্যথা করছে।
-আপনি যত্ন করে রাখেন। আমি ওর জন্য ওষুধ আনতে যাচ্ছি।
অঞ্জন বুঝে যায় বাচ্চাটি কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে। ওর মা সঙ্গে সঙ্গে বলে, ওর বাবা ওষুধ আনতে গেছে আপনাকে যেতে হবে না।
-ও আচ্ছা ঠিক আছে। তাহলে যাই। মাহমুদ ভাইকে বলবেন দরকার হলে আমাকে ডাকতে।
-আচ্ছা। আচ্ছা।
ওর মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথা বলে। মায়ের এই কণ্ঠস্বর অঞ্জনের বুকে বাধে। অন্যদিকে শিশুটির চিৎকার করে কান্নাও মেনে নিতে কষ্ট হয়। তারপরও দ্রুতপায়ে হেঁটে সরে আসে তাঁবুর কাছ থেকে। আর একটি তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসে শরীফ। অঞ্জনকে দেখে দ্রুতপায়ে কাছে আসে।
-ডাক্তার সাহেব আমার মেয়েটির খুব জ্বর। মুষড়ে পড়ে আছে। কিছু খেতেও চায় না।
-ও কত বড়?
-পনেরো বছর হয়েছে।
-চলেন দেখি।
অঞ্জন পকেট থেকে থার্মোমিটার বের করে হাতে রাখে। দুজন দ্রুত হেঁটে গিয়ে তাঁবুতে ঢোকে। মেয়েটি মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে কঁকাচ্ছে। এক অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসছে ওর মুখ থেকে। অঞ্জন ওকে দেখে বিব্রত হয়। বুঝে যায় যে মেয়েটির শুধু জ্বর নয়। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে বিস্মিত হয়। বুঝতে পারে ও টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছে। হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না। তাঁবু থেকে বেরিয়ে শরীফকে বলে, আমি যাই, ওষুধ আনার ব্যবস্থা করি।
শরীফ ঘাড় নেড়ে বলে, আচ্ছা।
চলবে…
আগের পর্বগুলো..
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা। পর্ব- ৩৩