ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৩৬
দ্য ফার্স্ট ম্যান
এখন সে বড় হয়ে গেছে। বন থেকে মনডোভি পর্যন্ত রাস্তায় জে করমারি যে গাড়িটাতে যাচ্ছিল সেটা খাড়া বন্দুক বোঝাই ধীর গতির জিপগুলো পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চলল।
এম ভেইলার্ডের ওখানে যাবেন?
হ্যাঁ।
খামার বাড়ির দরজায় দাঁড়ানো জ্যাক করমারির দিকে তাকিয়ে থাকা লোকটা বেঁটে খাটো সতেজ চেহারার। তবে কাঁধ চওড়া। বাম হাত দিয়ে দরজা খুলে ডান হাত দিয়ে দরজার বাজু ধরে দাঁড়ানো লোকটা তার জন্য পথ খুলে দিলেও আসলে সে পথ আটকেই দাঁড়িয়েছিল। লোকটার বয়স হয়তো চল্লিশ হবে। তার পাতলা হয়ে যাওয়া সাদা সাদা চুলের কারণে সেরকমই মনে হয়। চুলের জন্যই চেহারায় একটা রোমান রোমান ভাব ফুটে আছে। তবে স্বাভাবিক গঠনের তামাটে মুখ, উজ্জ্বল চোখ, খাকি ট্রাউজারের মধ্যে পা দুখানি, ক্ষীণ তবে শক্ত শরীর, স্যান্ডেল এবং পকেটওলা নীল শার্টের কারণে তাকে আরও অল্পবয়সী মনে হয়। চুপচাপ দাঁড়িয়ে লোকটা জ্যাকের ব্যাখ্যা শোনে। তারপর, ভেতরে আসুন, বলে একপাশে সরে পথ করে দেয়। একটা শুধু বাদামী রঙের সিন্দুক আর একটা কাঠের তৈরি ছাতা রাখার স্ট্যান্ড সজ্জিত সাদা রং করা হলরুম পেরিয়ে যেতে যেতে জ্যাক পেছনে লোকটার হাসি শুনতে পায়, তাহলে রীতিমত তীর্থযাত্রা হয়ে গেল। ঠিক আছে, আপনি ঠিক সময়েই এসেছেন।
জ্যাক জিজ্ঞেস করল, কেন?
কৃষক লোকটা বলল, খাবার ঘরে আসুন। এটাই সবচেয়ে ঠাণ্ডা রুম।
খাবার ঘরটা অর্ধেক বারান্দা। সহজে পেঁচিয়ে বোনা যায় এমন খড়ের তৈরি খড়খড়ি; খড়খড়িগুলোর একটা নামানো। কাঠের তৈরি আধুনিক টেবিল এবং বুফে ছাড়া রুমটাতে ছিল রত্তনের চেয়ার এবং ডেক চেয়ার। জ্যাক পেছনে তাকিয়ে দেখল সে একা, লোকটা আসেনি। বারান্দায় এগিয়ে গিয়ে খড়খড়ির ভেতর দিয়ে তাকিয়ে দেখল, সামনে একখণ্ড উঠোন, সেখানে কাগজের গাছপালার মধ্যে চকচক করছে উজ্জ্বল লাল রঙের কয়েকটা কলের লাঙল। সকাল এগারোটার সহনীয় সূর্যের তাপের নিচে দেখতে পেল, সামনের দিকে শুরু হয়ে গেছে আঙুরের ক্ষেত। এক মুহূর্ত পরে লোকটা একটা ট্রেতে সারিবদ্ধ করে সাজানো একটা মৌরির রসের বোতল, দুটো গ্লাস এবং বরফ জলের একটা বোতল নিয়ে ফিরে এল।
লোকটা দুধের মতো সাদা তরল ভরা গ্লাসটা তুলে বলল, আপনি আরও দেরি করে এলে এখানে কোনো কিছুই পেতেন না। এ সম্পর্কে আপনাকে বলার মতো কোনো ফরাসিকেও পেতেন না।
বৃদ্ধ ডাক্তারই আমাকে বলেছেন আপনার এই খামারে আমার জন্ম হয়েছিল।
হ্যাঁ, সেইন্ট আপোর্ত্রের সম্পত্তির একটা অংশ এটা। তবে আমার বাবা মা এটা কিনেছিলেন যুদ্ধের পরে। জ্যাক চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল।
ভেইলার্ড বলল, আমার বাবা মা সবকিছুই নতুন করে তৈরি করেছেন।
ওনারা কি যুদ্ধের আগে আমার বাবাকে চিনতেন? আমার মনে হয় না। ওনারা আগে তিউনিসিয়ার সীমান্তবর্তী এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। পরে সভ্যতার কাছাকাছি এলাকায় আসতে চেয়েছিলেন। তাদের কাছে সলফেরিনো ছিল সভ্যতার প্রতীক।
তাহলে তারা আগের ম্যানেজার সম্পর্কে কিছু শোনেননি?
না, যেহেতু এখান থেকেই আপনার শুরু বিষয়টা আপনি ভালো জানবেন। আমরা এখানে কোনো কিছুই সংরক্ষণ করি না। সবকিছু ভেঙেচুরে আবার নতুন করে গড়ি। আমরা শুধু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা কর, বাকি সব ভুলে যাই।
জ্যাক বলল, ঠিক আছে। আমি আপনার সময় নষ্ট করলাম শুধু।
জ্যাকের দিকে মৃদু হাসি দিয়ে ভেইলার্ড বলল, না, আপনি এসেছেন এটা তো আনন্দের বিষয়।
নিজের গ্লাসের পানীয়টুকুতে শেষ চুমুক দিয়ে জ্যাক বলল, আপনার বাবা মা কি সীমান্ত এলাকাতেই থেকে গেলেন?
না, সেটা তো এক নিষিদ্ধ এলাকা, মানে বাঁধের কাছের এলাকা। আর আপনি অবশ্যই আমার বাবাকে চেনেন না, তাই না? একথা বলেই সে-ও তার অবশিষ্ট পানীয়টুকু শেষ করে ফেলল।
পানীয় শেষ করায় যেন অতিরিক্ত শক্তি সঞ্চয় হলো এমন ভাব করে সে হাসিতে ফেটে পড়ল, বাবা তো পুরনো ঘরানার একজন আসল ভিনদেশি বসতি স্থাপনকারী। আপনি হয়তো জনেন, তাদের মতো মানুষকে প্যারিসে ভিন্ন চোখে দেখা হয়। সত্যিকার অর্থেই বাবা একজন কঠিন মানুষ। বয়স ষাট বছর, তবে পিউরিটানদের মতোই লম্বা চওড়া এবং হালকা গড়নের। পুরুষ মানুষ হিসেবে নিজের প্রাধান্য বিস্তার করে রাখতে পছন্দ করেন। তার আরব শ্রমিকদের এমনকি সব রকমের স্বচ্ছতার ভেতর দিয়ে হলেও তার ছেলেদেরও কঠিন পরিশ্রম করিয়েছেন বাবা। তারপর গত বছর যখন তাদের বের করে দেওয়া হয় সেটা সবার জন্য উন্মুক্ত একটা সুবিধা হয়ে দাঁড়ায়, কেননা ওখানকার জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। ঘুমানোর সময় বন্দুক কাছে নিয়ে ঘুমাতে হতো। রাসকিল খামারে আক্রমণের সময়ের কথা আপনার মনে আছে?
জ্যাক বলল, না।
মালিক আর তার দুই ছেলের গলা কেটে হত্যা করা হয়েছিল। মা এবং মেয়েকে উপর্যুপরি ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিল। কৃষকদের একটা সভায় জেলাধ্যক্ষ সাহেব দুর্ভাগ্যবশত বলে ফেলেছিলেন, ঔপনিবেশিক বিষয়গুলো তাদের আরেকবার ভেবে দেখা উচিত, মানে তারা আরবদের কী চোখে দেখবে। কেননা নতুন সময় এসেছে। তারপর একজন বৃদ্ধ তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, কারো সম্পত্তি সম্পর্কিত আইন কেউ নিজে তৈরি করতে পারে না। তবে তার পরদিন থেকে তিনি আর মুখ খোলেননি। মাঝে মাঝে রাতে বিছানা থেকে উঠে তিনি বাইরে বের হতেন। আমার মা তার ঘরের খড়খড়ির মধ্যে দিয়ে তাকিয়ে দেখেছেন, তিনি তার জমির আশেপাশে হাঁটহাঁটি করছেন। ছেড়ে যাওয়ার হুকুম যখন এল তিনি কোনো কথাই বললেন না। তার আঙুরের মৌসুম শেষ হয়ে গিয়েছিল, তার মদ সংরক্ষিত ছিল ভাঁটিতে। ভাঁটিগুলো খুলে তিনি লোনা জলের একটা ঝরনার কাছে গেলেন। আগে থেকেই তিনি এই জলের ধারা আলাদা করে রেখেছিলেন। এবার তার মাঠের দিকে স্রোতের ধারা চালিয়ে দিলেন। মাটি খোঁড়ার লাঙল দিয়ে সজ্জিত করলেন তার কলের লাঙল। তার জমির ভেতরে লতাগুল্মের গাছগুলো তোলার জন্য একটানা তিন দিন খালি মাথায় কাজ করলেন কলের লাঙল চালিয়ে। কল্পনা করুন ওই বৃদ্ধ লোকটি কলের লাঙলের উপরে বসে লাঙলের ঝাঁকুনিতে উঠা-নামা করছেন, অন্য লতাগুল্মলোর চেয়ে মোটা কোনো লতায় তার লাঙল আটকে গেলে এক্সেলারেটারে চাপ দিচ্ছেন, খাওয়ার জন্যও থামছেন না। আমার মা তার জন্য রুটি, পনির নিয়ে গেলে চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছেন। তিনি অবশ্য অন্যান্য সব কাজই এরকম নীরবে করে যান। রুটির শেষ টুকরো শেষ করেই আবার কলের লাঙলের উপরে উঠে বসছেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তিনি এভাবে কাজ করছেন, দিগন্তের পাহাড়ের দিকে তাকাচ্ছেন না, দূর থেকে তাকে হঠাৎ দেখতে পেয়ে যেসব আরব লোক তার দিকে তাকিয়ে আছে তাদের দিকেও তার খেয়াল নেই। তারাও কিছু বলছেন না তাকে। কার কাছ থেকে যেন খবর পেয়ে যখন এক অল্প বয়সী ক্যাপ্টেন এসে ব্যাখ্যা দাবি করল তিনি বললেন, ইয়াং ম্যান, আমরা যা করছি সেটা যদি অপরাধ হয়ে থাকে তাহলে তো সেটাকে তুলে ফেলতে হয়। সবকিছু শেষ হয়ে গেলে তিনি খামার বাড়ির দিকে হাঁটা দিলেন, ভাঁটির মদে ভেজা উঠোন পেরোলেন এবং ব্যাগ গোছানো শুরু করলেন। আরব শ্রমিকরা তার অপেক্ষা করে উঠোনে দাঁড়িয়েছিল। ক্যাপ্টেনের পাঠানো প্রহরীও ছিল। কেউ জানেনি, কী কারণে পাঠানো হয়েছিল, লোকটা তার সহকারীকে নিয়ে হুকুমের অপেক্ষায় ছিল।
চলবে………