ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৩৫
দ্য ফার্স্ট ম্যান
সংগীতের উচ্চনাদী আওয়াজ জ্যাককে হতোদ্দম করে দিল, ভয় পাইয়ে দিল এবং একই সঙ্গে পরমানন্দের মধ্যে প্রথমবারের মতো সে নিজের শক্তি, টিকে থাকার সীমাহীন ক্ষমতা টের পেল। ওই পরমানন্দ উৎসবের গোটা সময় ধরেই তার সঙ্গে ছিল। ওখানে যা কিছু ঘটছিল সবকিছু থেকে তাকে দূরে কোথাও নিয়ে যাচ্ছিল। সেই অনুভূতিটা তারা যখন বাড়ি ফিরে এলো এবং আত্মীয়স্বজনদের জন্য দেওয়া অন্য দিনের চেয়ে একটু ভালো খাবারের আয়োজনে সাজানো টেবিল পর্যন্ত অটুট ছিল।
অন্যদেরও যেন সেই পরমানন্দ ছুঁয়ে দিয়েছিল। কেন না তাদের উপস্থিতির মধ্যে রুমটা ধীরে ধীরে বিশাল এক উচ্ছলতায় ভরে উঠেছিল। অন্য সবার আনন্দের প্লাবন জ্যাকের আনন্দ যেন নষ্ট করে দিল। শেষে ফলার পরিবেশনের সময় জ্যাক ডুকরে কেঁদে উঠল। নানি ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে তোর?
আমি জানি না। জানি না।
নানি অধৈর্য হয়ে জ্যাককে চড় মেরে বললেন, এইবার তুই জানতে পারবি কাঁদছিস কেন। কিন্তু বাস্তবে সে নিজের কান্নার কারণ জানত। টেবিলের অন্য পাশে মায়ের দিকে তাকিয়ে জ্যাক দেখতে পেল, মা করুণ একটা ক্ষীণ হাসি নিয়ে তার দিকে চেয়ে আছেন।
পরীক্ষার প্রস্তুতি পর্বের শেষের দিকে এম বার্নার্ড একদিন বললেন, প্রস্তুতি মোটামুটি ভালোই হয়েছে। আর কয়েকটা দিন কঠিন পরিশ্রম করতে হবে। এম বার্নার্ডের বাড়িতে পাঠ্যসূচির শেষের দিকের অধ্যায়গুলো পড়া শেষ হয়ে গেলে একদিন সকাল বেলা তারা চারজন জ্যাকদের বাড়ির পাশের ট্রলি বাসস্টপে জমায়েত হলো। সঙ্গে লেখার সরঞ্জাম: লেখার প্যাড, কলম রাখার ছোট বাক্স ইত্যাদি। জ্যাক দেখতে পেল, তাদের বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তার মা এবং নানি জোরে জোরে হাত নাড়ছেন তাদের উদ্দেশে।
তাদের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো লিসিতে, শহরের একেবারে প্রান্তে। সমুদ্রের ধারে শহরের যে আধো গোলাকার অবয়ব ঠিক তার শেষ প্রান্ত অবস্থিত ওই এলাকাটা এক সময় সমৃদ্ধ এবং আনন্দহীন ছিল। তবে ভাগ্যিস ওখানে স্পেনীয়রা এসেছিল অভিবাসী হয়ে; আলজিয়ার্সের সবচেয়ে ভীড়ের প্রাণবন্ত এলাকা সেটা। লিসি যে রাস্তায় অবস্থিত সেখানকার অন্যসব কিছুর ওপর দিয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানো আয়তাকার এবং চোখে পড়ার মতো ভবন নিয়েই লিসির অবস্থান। প্রবেশ করার জন্য দুপাশে ছিল সিঁড়ি। সামনের বিশাল সিঁড়ির দুপাশে ছোটখাটো বাগান, কলাগাছের বাগানের চারপাশে বেড়া দিয়ে ঘেরা যাতে ছাত্ররা নষ্ট করতে না পারে। মাঝখানের সিঁড়ি সামনের দিকে গিয়ে একটা খিলানের সংযোজনে মিশেছে দুপাশের সিঁড়িগুলোর সঙ্গে। খিলান থেকে সামনের দিকে খুলে গেছে বিশাল দরজা। বিভিন্ন উপলক্ষে দরজা খোলা হয়। এটার পাশে একটা ছোট দরজা। সেটা প্রাত্যহিক ব্যবহারের জন্য। এই দরজাটা চলে গেছে দ্বাররক্ষীর কাচঘেরা কেবিন পর্যন্ত।
প্রথম দিকে যেসব ছাত্র এসে জমায়েত হয়েছে তাদের অনেকেই স্বাভাবিক আচরণ দিয়ে নিজেদের বিচলিত অবস্থা আড়াল করার চেষ্টায় সফল হয়েছে। কারও কারও বিচলিত অবস্থা ফুটে উঠেছে তাদের নীরবতা আর ফ্যাকাশে মুখের কারণে। ওই ছাত্রদের মাঝে খিলানের নিচে বন্ধ দরজা খোলা পর্যন্ত এম বার্নার্ড এবং তার চারজন ছাত্র অপেক্ষমাণ। সকালের প্রথমভাগে তখনো ঠাণ্ডা ভাবটা বিরজ করছে আর সূর্যের প্রখরতায় ধূলি পড়ার আগ পর্যন্ত রাস্তাটাও কিছুটা আর্দ্র। তারা চারজন প্রায় আধাঘণ্টা খানেক আগেই চলে এসেছে এবং তাদের শিক্ষক এম বার্নার্ডের চারপাশে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। এম বানার্ড তাদের কিছু বলার মতো খুঁজে না পেয়ে চুপচাপই ছিলেন। শেষে একটু পরেই ফিরে আসবেন বলে কোথায় যেন চলে গেলেন। আসলেই কয়েক মিনিট পর তারা দেখল, তিনি ফিরে আসছেন। পশমি টুপি আর স্প্যাট পরার কারণে তাকে বেশ রুচিবাগীশ দেখাচ্ছে। বিশেষ উপলক্ষে তিনি এই পোশাকগুলো পরেন। দুহাতে টিস্যু পেপারে মোড়ানো প্যাকেট। তৈলাক্ত আঠলো পদার্থে টিস্যু পেপারগুলো জায়গায় জায়গায় ভিজে উঠেছে। তার ছাত্রদের উদ্দেশে তিনি বললেন, এখানে কয়েকটা মিষ্টির রোল আছে। একটা করে খাও। দশটার সময় খাওয়ার জন্য একটা করে রেখে দাও। তারা এম বার্নার্ডকে ধন্যবাদ দিয়ে খাওয়া শুরু করল। ময়দার তাল দিয়ে তৈরি ভারী জিনিসটা চিবুতে পারলেও গিলতে বেশ বেগ পেতে হলো তাদের। এম বার্নার্ড বলতে থাকলেন, মাথা ঠিক রেখে লিখে যাবে। যে সমস্যাগুলো দেওয়া থাকবে সেগুলো খেয়াল করে পড়ে দেখবে। কম্পোজিশনের বিষয়বস্তু ভালো করে বুঝে নেবে। সবগুলো প্রশ্ন ভালো করে কয়েকবার পড়ে নেবে। হাতে সময় অনেক থাকবে। তারাও মনে মনে ঠিক করে নিল, তারা প্রশ্নগুলো কয়েকবার ভালো করে পড়ে নেবে। তার কথা তারা মেনে চলবে। জীবনে যতই বাধা থাকুক না কেন তিনি তাদের পথ প্রদর্শক হিসেবে থাকলে তারা সব বাধা পেরিয়ে যেতে পারবে। এবার ছোট দরজাটার পাশে হৈচৈ শুরু হয়ে গেল। প্রায় ষাটজনের মতো ছাত্র দরজার দিকে এগিয়ে গেল। একজন অ্যাটেন্ড্যান্ট দরজা খুলে দিয়ে ছাত্রদের নাম বলতে লাগল। প্রথম দিকেই জ্যাকের নাম শোনা গেল। নিজের নাম শোনামাত্র জ্যাক তার শিক্ষকের হাতটা চেপে ধরল। তিনি বললেন, যাও, বাবা। কম্পমান পদক্ষেপে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বার বার জ্যাক পেছনে এম বার্নার্ডের দিকে তাকাতে লাগল। জ্যাক দেখতে পেল তার দীর্ঘদেহী অবয়ব; তাকে ভরসা দেওয়ার জন্যই দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। জ্যাকের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসিতে ভরসার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি মাথা নাড়াতে লাগলেন।
দুপুরে এম বার্নার্ড তাদের বের হয়ে আসার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সবাই ফিরে এসে তাদের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দেখাল। শুধু সান্টিয়াগো একটা অঙ্কে ভুল করেছে। জ্যাকের দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তিনি বললেন তোমার কম্পোজিশনটা খুব ভালো হয়েছে। পরীক্ষা শেষে বেলা একটার সময় তাদের সঙ্গে এম বার্নার্ডের দেখা হলেও প্রায় চারটা পর্যন্ত তিনি ওখানেই পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে নানা আলোচনায় মেতে রইলেন। শেষে তিনি বললেন, চলো আমাদের ফিরতে হবে। ফলাফলের জন্য অপেক্ষা ছাড়া আর কোনো কাজ আপাতত নেই।
দুদিন পরে চার ছাত্র এবং এম বার্নার্ড ওই দরজার কাছে এসে হাজির হলেন বেলা দশটার দিকে। সেই অ্যাটেন্ড্যান্ট এসে দরজা খুলে নামের তালিকা পড়া শুরু করল। কৃতকার্য ছাত্রদের নামের তালিকা বেশ সংক্ষিপ্ত। ছাত্রদের হৈচৈয়ের কারণে জ্যাক কিছু শুনতে পায়নি। তবে এম বার্নার্ডের হাতের হালকা চাপড় অনুভব করে জ্যাক শুনতে পেল তিনি বলছেন, সাবাস, পন্ডিত! তুমি পাস করেছ।
শুধু সুদর্শন সান্টিয়াগো অকৃতকার্য হয়েছে। তারা সবাই সান্টিয়াগোর দিকে অন্যমনস্ক দুঃখি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এম বার্নার্ড তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ও কিছু না, বাছা। ও কিছু না।
সে মুহূর্তে কোথায় আছে, কী ঘটছে কিছুই স্পষ্ট টের পাচ্ছিল না জ্যাক। তারা ট্রলিবাসে বাড়ি ফিরছিল সবাই। এম বার্নার্ড বললেন, আমি তোমাদের সবার বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করে আসব। প্রথমে যাব জ্যাকের বাড়িতে। সবচেয়ে কাছের।
তাদের হত দরিদ্র খাবারের টেবিলের চারপাশে মহিলারা এসে ভীড় করেছেন। তার নানি, মা, রাজমিস্ত্রি বাড়ির মহিলারা, প্রতিবেশী মহিলারা সবাই। তার পরীক্ষার রেজাল্ট উপলক্ষে (?) তার মা ছুটি নিয়েছেন। শেষ বারের মতো কোলনের সুবাস নেওয়ার জন্য এম বার্নার্ডের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে জ্যাক। নানি উপস্থিত মহিলাদের সামনে আনন্দে জ্বল জ্বল করছেন। নানি বললেন, আপনাকে ধন্যবাদ, এম বার্নার্ড, অনেক ধন্যবাদ। এম বার্নার্ড জ্যাকের মাথায় আদরের হাত রাখলেন।
তিনি বললেন, আমাকে আর দরকার হবে না তোমার। এখন অনেক শিক্ষক পাবে। তারা আমার চেয়ে অনেক জানাশোনা। তবে তোমার তো জানাই থাকবে আমি এখানে আছি। যখন যে দরকার পড়বে চলে এসো। একথা বলেই এম বার্নার্ড বের হয়ে গেলেন। জ্যাক একাকী মহিলাদের মধ্যে পরিত্যক্ত হয়ে শেষে দৌড়ে জানালার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাতেই এম বার্নার্ডকে দেখতে পেল। তিনিও যেতে যেতে জ্যাকের দিকে ফিরে তাকিয়ে শেষ বারের মতো হাত নাড়াতে লাগলেন। জ্যাক বুঝতে পারল, তিনি তাকে একাকী রেখে চলে যাচ্ছেন। সফলতার আনন্দ যেন বিশাল এক বেদনায় বালক জ্যাকের হৃদয় মুচড়ে দিয়ে যাচ্ছে। সে আগেই বুঝতে পারছে তার এই সাফল্য দারিদ্রের বিচ্ছিন্ন দ্বীপ থেকে তার শিকড় উপড়ে ফেলছে। দারিদ্র তাদের জীবনে পরিবার আর সমাজেরই আরেক রূপ। সেখান থেকে তার এই সাফল্য তাকে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে অচেনা এক জগতে। সেখানেও শিক্ষক পাবে সে। তার বিশ্বাস তারা আরো বেশি জানাশোনা। কিন্তু এম বার্নার্ডের সর্বজ্ঞ হৃদয় তাদের কারও থাকবে না। তাকে এখন সবকিছু বুঝতে হবে, জানতে হবে একাকী। তাকে উদ্ধারকারী এম বার্নার্ডের মতো কারও সাহায্য সেখানে পাওয়া যাবে না। বড় হতে হবে একাকী, নিজেকে গড়ে তুলতে হবে একাকী এবং তার বিনিময়ে দিতে হবে সবচেয়ে বড় মূল্য।
চলবে...