ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ৪৪
দ্য ফার্স্ট ম্যান
বাব আজুন ছিল মূলত একটা সরু রাস্তা। বিশাল গোলাকার সব থামের উপর তৈরি খিলানগুলোর কারণে রাস্তাটা আরও সরু হয়ে গিয়েছিল। সে কারণে অন্য কোম্পানি চালিত ট্রলিগুলো কোনো রকমে চলতে পারত মাত্র। ওই ট্রলিগুলোই শহরের উপরের এলাকার সঙ্গে ওই এলাকাটার সংযোগ তৈরি করেছিল। গরমের দিনে মাথার উপরের ঘন নীলাকাশ রাস্তার উপরে যেন সীসার বাষ্প ঝরাত। অবশ্য খিলানের ছায়ার নিচে কিছুটা ঠাণ্ডা আবহাওয়া বিরাজ করত। বৃষ্টি-বাদলার দিনে গোটা রাস্তা চকচকে ভেজা পাথরের গভীর পরিখার আকার ধারণ করত।
খিলানগুলোর নিচে বসত সারি সারি দোকানপাট। পাইকারি টেক্সটাইলের দোকান, দোকানের চেহারায় থাকত গাঢ় রঙের প্রলেপ। ছাউনির নিচে দোকানের হালকা রঙের কাপড়ের স্তুপগুলো হালকা জ্বলজ্বল করত। মুদির দোকান থেকে লবঙ্গ এবং কফির সুবাস ছড়াত। ছোট ছোট দোকানগুলোতে আরবের লোকেরা তেল আর মধু চোয়ানো পেস্ট্রি বিক্রি করত। অন্ধকারের গভীরে বসানো ক্যাফেগুলোতে কফির পাত্রে তরল ঢালত তারা। সন্ধ্যার সময় ঝলমলে আলোর বাতিতে ভরে উঠত জায়গাটা। লোকজনের কলকাকলিতে ভরা জায়গাটাতে মানুষজন মেঝের ধূলোবালি মাড়িয়ে পানশালায় ঢুকত। সেখানে পাওয়া যেত গ্লাসভরা বর্ণিল পানীয়, তশতরিতে থাকত বিচিত্র রঙের ফুল, হেরিংমাছ, টুকরো করে কাটা শাক, জলপাই, ভাজা পোনামাছ, পেস্তাবাদাম ইত্যাদি। এরপর আরও সব দোকান ছিল। সেগুলোতে প্রাচ্যের অদ্ভূতদর্শন সব মনোহারি দ্রব্য বেচাকেনা হতো। জানালার পাশে ঘূর্ণায়মান তাকে পোস্টকার্ডের সঙ্গে লাগিয়ে বিক্রি করা হতো সেগুলো। ক্যাটকেটে উজ্জ্বল রঙের মুরীয় দোপাট্টাও বিক্রি হতো সেখানে।
বাজারগুলোর একটা ছিল খিলানগুলোর মাঝখানে। সেটা চালাত একটা মোটা লোক। সে সব সময় জানালার পেছনে, খিলানের ছায়ায় অথবা বিদ্যুতের আলোর নিচে বসে থাকত। চকচকে চোখের লোকটা স্থূল হলেও তার গায়ের রং ছিল পাথরের নিচে চাপা পড়া ঘাসের মতো কিংবা বড় গাছের পুরনো গোড়ার মতো ফ্যাকাশে ধরনের। তার চেহারার সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হলো, তার মাথাটা পুরোপুরি টাক। তার মাথার ওই চেহারার কারণে লিসের ছাত্ররা তার ছদ্মনাম দিয়েছিল ‘মাছিদের স্কেটিং মেঝে’ এবং ‘মশাদের সাইকেল দৌড়ের ট্র্যাক’।
তারা বলত, মশা-মাছিগুলো তার মাথার খুলির ফাঁকা ময়দানের উপরে দৌড়ের সময় উল্টো ঘুরতে গিয়ে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলত। সন্ধ্যার সময় ছাত্ররা তার দোকানের সামনে দিয়ে নকলপটু পাখিদের ঝাঁকের মতো এদিক ওদিক দ্রুত ছুটে যাওয়ার সময় তার ছদ্মনাম উচ্চারণ করতে করতে মশা-মাছিদের মতো জ্্্্্জ্্্্্জ্্জ্্্্্জ্্্জ্্্্্জ্্্্্জ্্্্্জ্্ শব্দ করত। লোকটা তাদের উদ্দেশে গালিগালাজ ঝাড়ত। মাঝে মধ্যে তাদেরকে ধাওয়া করার চেষ্টাও করত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধরতে না পেরে রণে ভঙ্গ দিত। তারপর এক সময় লোকটা তাদের চিৎকার চেঁচামেচি আর উপহাসের বর্ষণের মুখে চুপ হয়ে গেলে এবং বাচ্চারা একদম তার মুখের উপর এসে উৎপাত করা পর্যন্ত কিছুই বলত না। তারপর এক সন্ধ্যায় কয়েকজন আরবলোক থামের আড়াল থেকে বের হয়ে এসে বাচ্চাদের ধাওয়া করে বসল। লোকটা সম্ভবত ওই লোকগুলোকে ভাড়া করে বাচ্চাদের দিকে লেলিয়ে দিয়েছিল। সেদিন জ্যাক এবং পিয়েরে শাস্তি থেকে রেহাই পেয়েছিল তাদের দ্রুত গতির কারণে। মাথার পেছনে একটা চাটি খেয়ে মুহূর্তখানেকের মধ্যে বিস্ময় কাটিয়ে উঠে ছুট লাগিয়েছিল জ্যাক। কিন্তু তাদের স্কুলের দুতিনজন বন্ধু ধরা পড়ে আচ্ছামতো পিটুনি খেয়েছিল। ছাত্ররা পরিকল্পনা করল, তারা দোকান লুটপাট করবে এবং মালিককে থেঁতলে দেবে। অবশ্য তারা তাদের কুপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেনি। তাদের শিকারকে বরং জ্বালাতন করাই ছেড়ে দিল তারা। দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রাস্তার অন্য পাশ দিয়ে দেবদূত হয়ে চলাফেরা করতে লাগল তারা।
জ্যাক একদিন তিক্তমুখে বলল, আমরা আসলে এমনিতেই ভড়কে গিয়েছিলাম।
পিয়েরে বলল, দোষ তো আসলে আমাদেরই ছিল।
জ্যাক বলল, দোষ আমাদের ছিল বলেই মারের ভয়ে সটকে পড়লাম।
অনেক দিন পরে যখন সে বুঝতে পেরেছে, মানুষ সত্যকে মেনে নেওয়ার ভান করে এবং বাধ্য না হলে হার মানে না তখন ওই ঘটনার কথা তার মনে পড়ে যায়। বাব আজুন পর্যন্ত যে রাস্তাটা চলে গেছে তার মাঝখানে রাস্তাটা বেশ চওড়া হয়ে গেছে এবং খিলানের একপাশে সেন্ট ভিক্টইরের গির্জার জন্য যেন জায়গা ছেড়ে দিয়েছে। ধ্বংস হয়ে যাওয়া একটা মসজিদের চত্বর জুড়ে ছিল গির্জাটা। গির্জাটাকে মনে হতো পূজা অর্পণের বিশেষ কোনো জায়গা। সব সময় ফুলের সমারোহ এবং সাদা রং করা বাইরের পাশটা বিচিত্র রকমের খোদাই শোভিত। বাচ্চারা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখত, ফুলের কারবারিরা খোলা ফুটপাথে দোকান সাজিয়ে বসেছে। মৌসুম অনুসারে তারা গোলাপফুল, শ্বেতদুর্বার ফুল, তারাফুল, কার্নেশন ইত্যাদি ফুল দিয়ে লম্বা টিনের কেনেস্তারা সাজিয়ে রেখেছে। সব সময় ফুলের উপরে পানি ছিটানোর কারণে কেনেস্তারাগুলোর গায়ে মরিচা পড়েছে। রাস্তার ওই একই পাশে একটা ছোট দোকান ছিল। সেখানে ফলের টুকরো, ডিম এবং তেলের মধ্যে তেলে ভাজা পিঠা বিক্রি করত আরবের লোকেরা। দোকানের পরিসর খুব ছোট ছিল। এক সঙ্গে তিন জন মানুষও ধারণ করার মতো নয়। এক কোণায় একটা চুলা তৈরি করা হয়েছিল। চুলার চারপাশে নীল এবং সাদা সব মাটির পাত্র সাজানো ছিল। মাঝখানে জ্বলত টগবগে ফুটন্ত তেলের বেসিন। চুলার পাাশে বাবু মেরে বসে কাজ করত একজন অদ্ভূতদর্শন লোক, পরনে আরব দেশের লোকদের মতোই পাজামা। গরমের দিনে এবং দিনের বেলার তাপের সময় গা অর্ধেক খোলা। অন্য সময় ইউরোপীয় জ্যাকেট পরত। গলার কাছে সেপটিপিন দিয়ে আটকানো। তার ন্যাড়া মাথা এবং পাতলা মুখের কারণে তাকে মনে হতো চশমা-ছাড়া গান্ধী। হাতে একটা চামচের মতো লাল ছাকনি নিয়ে সে ফুটন্ত তেলের মধ্যে ফলের টুকরোগুলোর বাদামি হয়ে যাওয়া পরোখ করত। পিঠার বাইরের পাশ সোনালি এবং ভেতরের লেই আলু ভাজার মতো স্বচ্ছ এবং মচমচে হয়ে গেলে সে ছাকনি দিয়ে দক্ষতার সঙ্গে পিঠাগুলো তেলের বাইরে তুলে এনে বেসিনের উপরে ছাকনি তিন চার বার ঝাঁকুনি দিয়ে কাচঘেরা একটা তাকে সারিবদ্ধ করে রাখত। তাকের একপাশে মধু জড়ানো লম্বা পিঠা রাখত। আরেক পাশে চ্যাপটা গোলাকার সাধারণ পিঠা রাখত। পিয়েরে এবং জ্যাক এই পিঠার জন্য পাগল ছিল। কালে ভদ্রে তাদের কারো কাছে সামান্য পয়সা থাকলে দোকানের সামনে একটুখানি থেমে সাধারণ পিঠাগুলোর দু-একটা কিনে নিত। দোকানি যে কাগজে করে পিঠা ধরিয়ে দিত সেটা তেলে ভিজে খুব তাড়াতাড়িই স্বচ্ছ হয়ে উঠত। কখনো লম্বা পিঠাও নিয়েছে তারা। তখন দোকানি চুলার পাশে একটা পাত্রের ভেতর রাখা মধুর মধ্যে পিঠাগুলো চুবিয়ে দিত। পিঠার ভাঙা টুকরোগুলো মধুর পাত্রে ভাসতে থাকত। এই অপূর্ব স্বাদের পিঠা হাতে লিসের দিকে দৌড়ে যেতে যেতে পিঠায় কামড় দিতে থাকত তারা। দৌড়ানোর সময় তাদের মাথা এবং মুখ থাকত সামনের দিকে ঝুঁকে যাতে পিঠার রস পড়ে জামা কাপড় নষ্ট না হয়ে যায়। স্কুল খোলার পর পরই প্রতি বছর সেইন্ট ভিক্টইরের গির্জার সামনে আবাবিল পাখিদের বিদায় পর্ব অনুষ্ঠিত হতো। বিদ্যুতের তার কিংবা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন তার ব্যবহার করা হতো ট্রলিবাস চালানোর জন্য। তবে বাস চলা বন্ধ থাকার সময়ও রাস্তাটা যেখানে প্রশস্ত হয়েছে সেখানকার তার নামানো হতো না।
আবাবিল পাখিগুলো পানির পাশের বীথিকার উপর দিয়ে উড়ে এসে লিসের সামনের চত্বরে কিংবা দারিদ্র পীড়িত এলাকার আকাশে চলে আসত। কখনো কখনো ডুমুর ফলের উপর কামড় দিতে দিতে কান ঝালাপালা করা কিচির মিচির শব্দে চারপাশ ভরিয়ে তুলত। দলের কোনো কোনো পাখির মুখে থাকত উড়ন্ত ময়লার টুকরো, কোনোটার মুখে জৈব সারের দলা থাকত। ওখানে কখনো তুষার পড়ত না। গরমের মাসগুলো শেষ হলে শীতের ভাবটা একটু একটু বোঝা যেত। যা হোক, শীতের শুরুতে পাখিগুলো একটা একটা করে রিউ বাব আজুনের করিডোরে এসে হাজির হতো। ট্রলিবাস লক্ষ করে নিচের দিকে উড়ে আসত। তারপর দিক পরিবর্তন করে আবার বাড়ি ঘরের উপরের আকাশের দিকে উড়ে যেত। একবার হঠাৎ করে হাজারে হাজারে আবাবিল পাখি সেইন্ট ভিক্টইরের চত্বরে এবং ঘরবাড়ির উপরে এসে জমায়েত হতে লাগল। একটার সঙ্গে আরেকটার গা ঘেঁষে বসা, সাদা আর কালো মেশানো রঙের ঘাড়ের উপরের মাথা দোলানো, লেজ নাচানো, নতুন কারো জন্য জায়গা করে দেওয়ার জন্য আস্তে আস্তে পা সরানো ইত্যাদি তাদের সাধারণ দৃশ্যের মধ্যে পড়তে লাগল। ফুটপাত ঢেকে গেল তাদের ছাইরঙা বিষ্ঠায়। সবগুলো একই সুরে কিচির মিচির করত। মাঝে মধ্যে হঠাৎ বিরতি দিত কককক শব্দে। মনে হতো, তাদের মধ্যে কোনো গোপন কথাবার্তা চলছে। সারাটা সকাল জুড়ে চলত এরকম।
বেলা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কান ঝালাপালা করে দিত তাদের কলরব। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাদের কলরব বাড়তেই থাকত। তখন ছেলেরা বাড়ি ফেরার ট্রলিবাস ধরার জন্য বের হতো। সে সময় হঠাৎ করে সব কলরব থেমে যেত কোনো এক আজানা নির্দেশে। হাজার হাজার ঘুমন্ত পাখি তাদের ছোট মাথাগুলো নিচু করে সাদা কালো লেজ দোলাত। আরও দুতিন দিন সেহেল কিংবা তার চেয়েও দূরবর্তী জায়গা থেকে উড়ে আসত পালকওয়ালা দল বেধে। আগে যারা এসেছে তাদের মধ্যে জায়গা করে নিত নতুনগুলো। এলাকার রাস্তার দুপাশের সব বাড়ি ঘরের কার্নিসে এসে জড়ো হতো পাখিগুলো। পথচারীদের কানে তালা লাগিয়ে দিত উচ্চ কলরবে। তারপর হঠাৎ কোনো সকালে দেখা যেত, রাস্তার আশপাশের এলাকা পুরোপুরি ফাঁকা। ভোর হওয়ার আগে পাখিগুলো দক্ষিণের দিকে কোথাও উড়ে গেছে। বাচ্চাদের জন্য সে সময়টা ছিল শীতের শুরু। কারণ সন্ধ্যার ঊষ্ণ আকাশে পাখিদের তীক্ষ্ণ কলরব ছাড়া কোনো গ্রীষ্ম তারা দেখেনি।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/