বিশেষ সাক্ষাৎকার
'দুঃখজনক হলেও সত্য সংসদ ভবন অঙ্গনে স্বাধীনতাবিরোধীর কবর আছে'
বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা, মহিয়সী বীরাঙ্গনা মা-বোনসহ অগণিত মানুষের অসামান্য আত্মত্যাগ ও ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের সোনার বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অমূল্য সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য রক্ষার নিরিখে বর্তমানে জীবিত মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম এক সংগঠন 'রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা ৭১'। বিশেষ এক সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগঠনটির মূল আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী সংগঠনটির কাঠামো, আদর্শ ও পরিকল্পনার বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য দিক আলোকপাত করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। যা তাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে।
প্রশ্ন: আপনারা কবে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই প্রেক্ষাপট সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করবেন কী?
উত্তর: ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পূর্ণভাবে ভুলুণ্ঠিত হয়। দেশ ফিরে যায় পাকিস্তানি ভাবধারায়। আমাদের একটা দীর্ঘ দুঃসময় গেছে যখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দেওয়া ছিল দুঃসাধ্য। সেই অবস্থা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ও সেই মর্মে দেশের ইতিহাসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে আসছেন।
করোনা মহামারিকালে আমিসহ কয়েকজন সহযোদ্ধা হাতিয়া বিএলএফ কমান্ডার রফিকুল আলম, নৌ কমান্ডো মোশাররফ হোসেন, মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরের আবদুল হালিম খান, যুদ্ধাহত আবদুর রাজ্জাক, ফেনীর রফিকুল আলম একটি সংগঠন শুরুর পরিকল্পনা করি। গত ২২ জানুয়ারি রফিকুল আলমের সভাপতিত্বে করোনা মহামারির মধ্যে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতিতে সংগঠনের খসড়া ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করি।
ঘোষণাপত্রে সংগঠনের আদর্শ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়। ঘোষণাপত্রের আলোচনায় অনেক সহযোদ্ধা অংশ নেন এবং তাদের মূল্যবান পরামর্শ তুলে ধরেন। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়, করোনা মহামারি সহনীয় পর্যায়ে আসলে ও রমজানের পর বড় আকারে সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় সাধারণ সভায় সংগঠনের পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়া পর্যন্ত রাজজাকুল হায়দার চৌধুরীকে আহ্বায়ক, মোশাররফ হোসেন ও আবদুল হালিম খানকে যুগ্ম আহ্বায়ক এবং শামসুল আলম শামসকে সদস্য সচিব করে ১৫ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়।
এরপর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযোদ্ধাদের উপস্থিতিতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেক্টরস কমান্ডারস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক হারুন হাবিব, বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন কবি জাহিদুল হক, প্রবীণ সাংবাদিক শামীম আক্তার চৌধুরী।
প্রশ্ন: আপনাদের সংগঠনের মাসিক ও সাপ্তাহিক কোনো আয়োজন বিষয়ক পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিবেন কী?
উত্তর: আমাদের এই সংগঠন শুরুর পর থেকে আমরা প্রতিমাসে আলোচনা সভা আয়োজনের চেষ্টা করছি। যেন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসহ মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন বাস্তবভিত্তিক বিষয়গুলো আলোচিত হয়।
প্রশ্ন: আপনারা সংগঠনটি পরিচালনা করতে কী কী প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন?
উত্তর: স্বাভাবিকভাবেই একটা সংগঠন পরিচালনা করা খুব সহজ নয়। বিশেষ করে তা কিছুটা কঠিন হয় প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। আমরা অনেকেই বয়সের ভারে বেশ ন্যুব্জ। ইতোমধ্যে অনেক সহযোদ্ধা মারা গেছেন। বাকিদের মধ্যে অনেকেই চলাচল শক্তি হারিয়ে ফেলেছেন। তবে এই সমস্যা থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি সভায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার উপস্থিতি দেশপ্রেমের বিশুদ্ধ আদর্শে লালিত আশাব্যঞ্জক দিকগুলো তুলে ধরে।
প্রশ্ন: বর্তমানে আপনাদের সংগঠনের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের বিষয়ে কিছু বলবেন কী?
আমাদের সংগঠনের মূল উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর দর্শন, প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া। আমরা ইতোমধ্যে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে মতবিনিময় ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সম্বলিত গল্প বলা শুরু করেছি। এটাকে দেশব্যাপী বিস্তৃত করার কাজ শুরু হয়েছে। আর আমরা সহযোদ্ধারা অবিরতভাবে সেই চেষ্টা চালিয়ে যাব। দেশব্যাপী অনেক মুক্তিযোদ্ধার অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্বাসন সংক্রান্ত বাস্তবভিত্তিক অনেক কাজ অপূর্ণ আছে।
প্রশ্ন: আপনাদের সাংগঠনিক-অর্থনৈতিক দিকগুলো কীভাবে পরিচালিত হয়? আপনাদের সদস্য কত? মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া স্কল মুক্তিযোদ্ধা কি এতে অংশ নিতে পারেন?
উত্তর: আমাদের সকল সদস্যদের ব্যক্তিগত অবদানের মাধ্যমে এই সংগঠনের বিভিন্ন ব্যয়ভার পরিচালিত হয়। বর্তমানে সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ২০০। সদস্যদের জন্য একটি অন্যতম শর্ত হলো মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে বিশ্বাসী এবং বঙ্গবন্ধুর দর্শন ধারণ। অন্যথায় তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেও আমাদের সদস্য হতে পারবেন না।
আলোচনার শেষপর্যায়ে রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী বেশ দুঃখ মিশ্রিত স্বরে বলেন, 'একটি দুঃখজনক হলেও সত্য দিক হলো আমাদের জাতীয় সংসদ ভবন অঙ্গনে কয়েকজন বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী নেতার কবর আছে। আন্তর্জাতিক স্থপতি লুই কানের নকশা অনুযায়ী সংসদ ভবন অঙ্গনে কোনো কবর থাকার প্রশ্নই উঠে না, রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরোধীদের করব তো নয়ই। এসব কবর সরানোর জন্য আমরা মুক্তিযোদ্ধা, নতুন প্রজন্ম ও প্রগতিশীল শক্তিকে এক করে একটা ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলব।
মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করেছেন, যাদের অসামান্য ও রক্তক্ষয়ী আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের সোনার বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ চিত্র, আমাদের স্বাধীনতা। তাদের সবার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম সংগঠন 'রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধা ৭১' বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস বিনির্মাণে আগামীর সফল অগ্রযাত্রায় আমার আন্তরিক শুভকামনা।'
এসজি