‘খেলাপি রোধে আইন আরও শক্তিশালী করতে হবে’
কয়েক মাস থেকে ডলারের সংকট ও যুদ্ধের অজুহাতে সিন্ডিকেটের কারসাজিতে নিত্যপণ্যের মূল্য সাধারণের নাগালের বাইরে। অপরদিকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণও হুহু করে বাড়ছে। সুযোগ পেলে কেউ কেউ ভুয়া কাগজে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে পাচার করছেন। এ সব কেন হচ্ছে? কীভাবে রোধ করা সম্ভব। এ সব বিষয়ে ঢাকাপ্রকাশ-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন সিপিডির সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান।
ঢাকাপ্রকাশ: অর্থনৈতিক সংকট কোনোভাবেই কাটছে না। নিত্যপণ্যের মূল্য একেবারে লাগামহীন। এভাবেই কী চলবে? আসলে বাস্তব অবস্থা কী?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: বিভিন্ন কারণে সম্প্রতি দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে আমাদের হাত আছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে নেই।
আন্তর্জাতিক কারণে কয়েকটি পণ্যের দাম একটু বেড়ে আবার কমতির দিকে। বাইরের এই পণ্যের ব্যাপারে আমাদের হাত নেই। বিভিন্ন কারণে রিজার্ভ পড়তির দিকে। এরফলে মুদ্রার সঙ্গে টাকার বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন হয়েছে। এটাতে আমাদের হাত দেওয়ার কিছু নেই। মুদ্রার উপরও হাত নেই।
তবে এই দুইটার বাইরের কারণগুলোর ক্ষেত্রে সরকারকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে প্রথমত পণ্যের মূল্য কমাতে শুল্ক সমন্বয় করতে হবে। স্থানীয় বাজারে যাতে পণ্যের মূল্য না বাড়ে। সেটা চেষ্টা করতে হবে। আমদানিস্তর থেকে ভোক্তাস্তরে বাজার কারসাজি, সিন্ডিকেটে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে যে মূল্য পার্থক্য হচ্ছে সেদিকে কঠোরভাবে নজর দিতে হবে। সরকারের হাতে পণ্য বাজারজাতকরণের যে সুযোগ রয়েছে ওএমএসের মাধ্যমে তার প্রভাব বিস্তার করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অবশ্যই কমেছে। সেটার নিরীক্ষে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। স্বল্প ও নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা বাড়াতে হবে। এর ভিত্তি ও প্রাপ্তি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
তৃতীয়ত, আমাদের উপাদন ব্যবস্থা যাতে কোনোক্রমেই ব্যাহত না হয় সেটার দিকে আমাদের নজরদারিতে রাখতে হবে। তা নাহলে সরবরাহ ও চাহিদার পার্থক্য হলে যে মূল্যবৃদ্ধি পাবে, তখন সামাল দেওয়া মুসকিল হবে।
ঢাকাপ্রকাশ: ভুয়া কাগজে ব্যাংক থেকে অনেকে অর্থ তুলে বিদেশে পাচার করছে। এরফলে খেলাপি ঋণ হুহু করে বাড়ছে। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক পাচারের সঠিক তথ্য দিতে পারছে না। সমস্যা কোথায়?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: আমার মনে হয় ব্যাংকিংখাতে খেলাপি ঋণের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, চলছে সেটা ক্রমান্বয়ে খারাপের দিকে যাচ্ছে। যথা সময়ে ও যথাযথভাবে এগুলোকে নিরসন ও প্রশমন করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। খেলাপি ঋণ পুঞ্জিভূত হতে হতে বর্তমানে এটা এমন একটা জায়গায় গেছে যে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের যে ক্ষমতা আছে তাতে শুধু দুদকের উপর নির্ভরশীল না থেকে, তার নিজস্ব যে ক্ষমতা আছে তা প্রয়োগ করতে হবে। তাদের কাছে যে তথ্য আছে সেগুলো বেশি বেশি জনগণের কাছে সরবরাহ করতে হবে।
ঢাকাপ্রকাশ: আইন আছে, অথচ অর্থ পাচার ঠেকানো যাচ্ছে না, কেন?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: খেলাপি ঋণ আদায়ে আইন আছে। তবে প্রয়োজনমতো দেওলিয়াসহ অন্যান্য যেসব আইন আছে তা শক্তিশালী করতে হবে। এগুলোর মাধ্যমে যদি শাস্তি দেওয়া যায় তাহলে যারা জনগণের গচ্ছিত টাকা নিয়ে দেশের বাইরে পাচার করছে, নিজেরা বিলাসবহুল জীবন যাপন করছে, সেটাকে কিছুটা হলেও আমরা প্রতিরোধ করতে পারব। আমরা আগেও বলেছি ব্যাংকিং কমিশন গঠনের কথা। তা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংককে এই মুহূর্তে মানুষের আস্থা ধরে রাখতে দেশের পক্ষ হয়ে, জনগণের পক্ষ হয়ে প্রয়োজনের নিরিখে পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ ব্যাংকিং ব্যবস্থা অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ। যারা এগুলো করছে তারা খুবই পরাক্রমশালী। দেশের স্বার্থে, গ্রাহকের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ঢাকাপ্রকাশ: বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিকখাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হলেও অর্থ পাচাররোধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে পারছে কেন? আইনের দুর্বলতাই কী এর কারণ?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: ব্যাংক কোম্পানি আইনের ব্যাপারে আমার বলার কিছু নেই। তবে আমি যেটা বলব খেলাপি ঋণ যেভাবে বাড়ছে এটার ব্যাপারে শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে পারছি না। এখানে আইনগত কোনো দুর্বলতা আছে কিনা তা দেখতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। গ্রাহকের আস্থা ধরে রাখতে তা দেখা দরকার। যারা শৃঙ্খলা ভঙ্গ করবে, আইনের ব্যত্যয় ঘটাবে, তাদের শান্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করতে হবে। এটার জন্য সংসদে নতুন আইনের বিধান দরকার হতে পারে বা আগের পুরাতন আইন সংশোধন করা যেতে পারে, তা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে হবে। এই পদক্ষেপ সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।
এনএইচবি/আরএ/