নজরদারি ও দক্ষতা দেশের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে

আমাদের দেশে স্বাধীনতা-উত্তর যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, সেটি ইতিবাচক। ভিন্ন ভিন্ন সেক্টরে বেশ ভালো উন্নয়ন হয়েছে। তবে একটি বিষয় এই উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন সেভাবে হয়নি। আমি তা মনে করি না। আমাদের দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যে উপকৃত হয়নি, তা কিন্তু না। দারিদ্র সীমার নিচে থাকা মানুষের আনুপাতিক হার কমেছে। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করত, সেটি এখন ২১ থেকে ২২ শতাংশে নেমে আসছে।
গত আট-দশ বছরে দারিদ্রসীমার নিচে মানুষের বাৎসরিক গড় হার অনেক কমে এসেছে। তবে এখানে দুটি সমস্যা আছে, যেদিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। এক. আঞ্চলিক বৈষম্য অনেক বেড়েছে। রংপুর বা বরিশাল ইত্যাদি জেলার দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এখনও ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মানুষ দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। দুই. সার্বিকভাবে আয় বৈষম্য বেড়ে গেছে। আয় বৈষম্য বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান। এসব বিষয় আমাদের নজরদারিতে রাখতে হবে এবং সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। দারিদ্রসীমার নিচে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি যাতে তরান্বিত হয় না, সেই চেষ্টা করতে হবে।
বৈষম্য বাড়ছে মানেই ধনিক শ্রেণি বেশি ধনী হচ্ছে। গরিব আরও গরিব হচ্ছে। এই বৈষম্য দূরীকরণ সহজ কোনো ব্যাপার নয়। সরকারের যে ট্যাক্স পলিসি, সেটি সঠিকভাবে তরান্বিত হওয়া উচিত। দরিদ্রদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও বাড়ানো দরকার। বেসরকারি সহযোগিতায় কর্মসংস্থান আরও বেশি পরিমাণে সৃষ্টি করা দরকার। যেখানে কাজ না হয়ে দুর্নীতি হয়, সেসব ক্ষেত্রে কঠোরতার প্রয়োজন আছে। তবে শুধু কঠোরতা দিয়ে আয় বৈষম্য দূর অথবা দারিদ্রসীমার হার কমানো সম্ভব নয়। কাজেই যে বিষয়গুলো আলোচনা হলো, সেগুলোর প্রতি দৃষ্টি দিতে হবে।
বর্তমানে যে উন্নয়ন দেখছি, সেটি সামগ্রিক উন্নয়নেরই অংশ। আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের প্রান্তিক জনগণ সেই উন্নয়নের সুফল এখনও ভোগ করতে পারেনি। প্রান্তিক জনগণ যেন সেই উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারে, সেজন্য কিছু পদক্ষেপ আমাদের গ্রহণ করতে হবে।
সারাদেশে ব্যাপকভাবে কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে। বেকারত্ব দূরীকরণে তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষাক্ষেত্র বাড়াতে হবে। এতে দেশের বেকারত্ব দূর হবে বহুলাংশে। বিভাগীয় জেলা শহরে শিল্প কারখানা স্থাপন করতে হবে।
নারী শিক্ষার উপর জোর দিতে হবে। কারণ নারীরা আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকাশক্তি। কাজেই তাদের আরও অধিকতর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করছি, দেশে নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা বাড়ছে। অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। নারীদের এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। যদিও দেশে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যা আশাব্যঞ্চক, তবে নারী উদ্যোক্তাদের এই সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। কুটিরশিল্পসহ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে টেকসই পল্লী উন্নয়নের দিকে দৃষ্টিপাত দেওয়া উচিত।
শিক্ষার প্রসার ঘটেছে। গরিব মানুষের সন্তানরাও পড়ালেখা শিখছে। হয়তো গুণগত মানে এখনো আরও উন্নয়ন দরকার। তবে চেষ্টা তো হচ্ছে। শিশু শিক্ষাবৃত্তি, মায়েদের আর্থিক সাহায্য প্রদানসহ অনেক কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। সরকারের নজরদারির সঙ্গে প্রশাসনিক দক্ষতা দেশের এই উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে বলে বিশ্বাস করি।
লেখক: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা
এসএ/
