পেঁয়াজ-আদার ঝাঁজ আর বাঁশির সুর
রোদের তাপে পুড়ছে দেশ। বাজারের আগুনে পুড়ছে সাধারণ মানুষের সংসার। প্রকৃতিতে ছায়া নেই, কেটে ফেলেছে গাছ। বাজারেও ছায়া নেই। কে দেবে সেই ছায়া বা ভরসা? বাজারে যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে, তখন মন্ত্রীদের কাছ থেকে সমাধানমূলক কোনো বক্তব্যের পরিবর্তে মানুষ এমন কিছু শুনছেন যার ফলে তারা মনে করেন একি হচ্ছে? তারা ভাবছেন, একি সান্ত্বনা না কি শাস্তির পূর্বাভাস? মন্ত্রীরা একেকজন একেক রকম বক্তব্য দিচ্ছেন, যাতে সাধারণ মানুষ সান্ত্বনা এবং স্বস্তির পরিবর্তে বিভ্রান্তিতে পড়ে যান।
সম্প্রতি শিল্প প্রতিমন্ত্রী বাজেট সংক্রান্ত এক কর্মশালায় বলেছেন, ‘আমি দেখেছি, বাজার করতে গিয়ে অনেকে কাঁদছেন। কারণ, বাজারের যে অবস্থা, তাদের পকেটে সে টাকা নেই। এটার একমাত্র কারণ সিন্ডিকেট।’ সিন্ডিকেটের কথা বললেই ক্ষমতাসীন দলের কর্তাব্যক্তি এবং ব্যবসায়ী নেতারা সমস্বরে বলে উঠেন কোথায় সিন্ডিকেট? সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। বাজার চলে বাজারের নিয়মে। কিন্তু মানুষ দেখে একই সাথে সারা দেশে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। কার ইশারায় হয় তা দেখা যায় না কিন্তু দাম বেড়ে গেলে তার উত্তাপ ক্রেতার গায়ে লাগে। একে সিন্ডিকেটের কারসাজি বলে এই সিন্ডিকেট নিয়ে নানা কথা শোনা যাচ্ছিল, কিন্তু স্বীকার করছিলেন না দায়িত্বশীলরা। এবার তো মন্ত্রীর মুখেই শোনা গেল সিন্ডিকেটের কথা। এখানেই শেষ নয় শিল্প প্রতিমন্ত্রী আরও এক ধাপ এগিয়ে পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘মন্ত্রীদের মধ্যেও সিন্ডিকেট আছে।‘ তিনি সংকটের কারণ জানালেন ’ কিন্তু তিনি যদি সিন্ডিকেটধারী মন্ত্রীদের নাম জানাতেন তাহলে দেশবাসী বুঝতেন কারা এই মন্ত্রিত্বের চেয়ারে বসে সিন্ডিকেটের সুতা টানছেন। তাহলে হয়তো লোকলজ্জার ভয়েও তারা কিছুটা সংযত হতেন, বাজারে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আসতে পারতো। কিন্তু হায় এতো হবার নয়।
বাজারে যারা যান তারা জানেন যে, খুচরা ও পাইকারি—দুই বাজারেই পেঁয়াজ আদার দাম আরও বেড়ে গেছে এবং বাড়ছেই। অজুহাত ভারতে দাম বেড়েছে এবং আদা আর চীন বা ভারত থেকে নয় ইন্দোনেশিয়া থেকে আনতে হবে। অথচ মাস দুই আগে থেকেই পেঁয়াজ আমদানি না করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল এবার পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়েছে। আমদানি করলে কৃষকেরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হবেন। শুধু আমাদের দেশে নয় ভারতেও এবার রেকর্ড পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে। ভারতের পেঁয়াজ উৎপাদন তাদের চাহিদার চেয়েও বেশি ফলে রপ্তানি না হওয়ায় সেখানকার কৃষকেরা ন্যায্য দাম পাচ্ছে না এবং পেঁয়াজের দাম গিয়েছে কমে। জানা গেছে ভারতে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ রুপিতে (এক রুপি সমান ১ টাকা ২৯ পয়সা) অর্থাৎ বাংলাদেশি টাকায় ৩৮ টাকা থেকে ৪৫ টাকায়।
বাংলাদেশে পেঁয়াজের সংকট সাধারণত হয় সেপ্টেম্বর মাসের পর থেকে। তখন কৃষকের পিয়াজ শেষের দিকে এবং নতুন পেঁয়াজ উঠতে বাকি। এই সংকট প্রায় প্রতিবছর কিছুটা হয়ে থাকে। ফলে এবারের সংকটে এই প্রশ্ন করা কি স্বাভাবিক নয় যে, এখন পেঁয়াজের মৌসুম কেবল শেষ হয়েছে। মাঠ থেকে পেঁয়াজ এসেছে কৃষকের ঘরে, এখনই কি আমদানির এত প্রয়োজন দেখা দিল? দুই মাসে কী পেঁয়াজের মজুদ শেষ হয়ে গেলো যে পেঁয়াজের জন্য বাজারে হাহাকার দেখা দিয়েছে। তাহলে শিল্প প্রতিমন্ত্রীর কথা শুধু কথার কথা নয়। তার ভাষায় পেঁয়াজের বাজারেও সিন্ডিকেট ঢুকে পড়েছে? বাজার পরিস্থিতি দেখে তাহলে তো চাল, চিনি ও ভোজ্যতেলের বাজারের সিন্ডিকেটকেও অস্বীকার করা যাবে না।
পেঁয়াজের বাজার যখন এরকম অস্থির তখন বাণিজ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিতে গিয়ে হুমকি দিচ্ছেন যে মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে পেঁয়াজ আমদানি করা হবে। নজর কি শুধুই আমদানির দিকে থাকবে? যাচাই করে দেখা হবে না যে সত্যি আমাদের পেঁয়াজের ঘাটতি আছে, নাকি সিন্ডিকেটই কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছে।
যদি পেঁয়াজের ঘাটতি থেকে থাকে, তাহলে তো আমদানি করে তা মেটাতেই হবে। তার জন্য তো আগে থেকে সরকার কেন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সংকট দেখা দিলেই আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও সেই পেঁয়াজ বাজারে আসতে এবং দাম কমতে সময় লাগবে। এই সময়ে সিন্ডিকেট (শিল্প প্রতিমন্ত্রীর ভাষায় মন্ত্রীদের মধ্যেও আছেন) বসে থাকবে না। দাঁও মারবে এবং ফাউ মুনাফা লুটে নেবে। সরকারের কাজ কি হবে এ ধরনের সিন্ডিকেটকে বারবার বাড়তি ও অন্যায্য মুনাফা নেওয়ার পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া? সরকারের কাছে দেশে পেঁয়াজের চাহিদা কত ও উৎপাদনের কত হয়েছে তার একটা গ্রহণযোগ্য হিসাব থাকলে এমন হতে পারে কি? সামনে কোরবানির ঈদ আসছে, ফলে দাম বাড়ানোর অজুহাত শক্তিশালী হবে।
এতো গেল সংকটের কথা। কিন্তু পেঁয়াজ চাষিরা জানান, চাষিরা এবার দেশি পেঁয়াজের সঙ্গে আগাম জাতের হাইব্রিড পেঁয়াজ রোপণ করেছিলেন। আগাম জাতের হাইব্রিড পেঁয়াজের ফলন বেশ ভালো হয়েছে। গড়ে প্রতি বিঘা জমি থেকে পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ মণ পর্যন্ত। এটা অবশ্য হাইব্রিড পিঁয়াজের কথা। তবে দেরিতে লাগানো নাবি বা দেশি জাতের পেঁয়াজের উৎপাদন আগের মতই, প্রতি বিঘায় গড় ফলন হয়েছে ২০–২২ মণ। বীজ, সারসহ চাষাবাদের খরচ হিসেব করলে দেখা যায় প্রতি বিঘা জমিতে পেঁয়াজ উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয়েছে ৪০ থেকে ৪২ হাজার টাকা। কিন্তু পেঁয়াজ যখন উঠল বাজারে অর্থাৎ মৌসুমের শুরুতে বাজারে প্রতি মণ পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায়। এতে কৃষকের লোকসান হয়েছে। তবে এপ্রিলের শেষ বা ঈদের পর থেকে বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা ও দাম দুটিই বাড়তে শুরু করেছে। অস্থিতিশীল বর্তমান বাজারে প্রতি মণ পেঁয়াজ ১ হাজার ৬৫০ থেকে ১ হাজার ১৮০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে আন্তঃমন্ত্রণালয় তৎপরতাও শুরু হয়েছে। কৃষিসচিবকে পাঠানো চিঠিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম এক মাস আগেও ছিল ৩০ টাকা, এক সপ্তাহ আগে ছিল ৫০ টাকা আর বর্তমানে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। সরবরাহ বাড়িয়ে পেঁয়াজের দাম স্থিতিশীল করার উদ্যোগ নেওয়ার দরকার।’ চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, পেঁয়াজের বাজার স্থিতিশীল করার স্বার্থে জরুরিভিত্তিতে সীমিত পরিসরে আমদানির অনুমতি (আইপি) দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে কৃষি সচিব আবার এ কথাও জানান যে, ২৪ লাখ টন বার্ষিক চাহিদার বিপরীতে দেশে এবার ৩৪ লাখ টন পেঁয়াজ উৎপাদিত হয়েছে এবং গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজও উঠবে তাহলে উদ্বৃত্ত উৎপাদন সত্ত্বেও পেঁয়াজের বর্তমান দর কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়। এই হিসাব দেখলে তো ধাঁধা লাগে চোখে আর সন্দেহ জাগে। হিসাব সঠিক না কি কৃত্রিম বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ক্রেতার পকেটের সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শক্তিশালী?
অন্যদিকে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি বলেছেন, একটা কাজ করলেই পেঁয়াজের দাম কমে যাবে। আর সেটা হচ্ছে আমদানি অনুমতি। পেঁয়াজের পাশাপাশি চিনি ও সয়াবিনের দাম নিয়ে তিনি বলেন, ‘মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম বেঁধে দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। উচিত হচ্ছে সরবরাহ ব্যবস্থা ভালো রাখা ও প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। উভয় ক্ষেত্রেই ঘাটতি আছে। কয়েকজন ব্যবসায়ী মিলে এখানে যে সুরে বাঁশি বাজাচ্ছেন, সে সুরেই দাম ঠিক হচ্ছে।’ একটা কথা হরহামেশাই বলা হয় এসব নাকি অসাধু ব্যবসায়ীদের কর্ম। তাহলে সেই প্রশ্নই তো আবার জেগে উঠে, সাধু ব্যবসায়ী কারা? তারা কী করেন?
এসব কথার পরে তাহলে কী দাঁড়াল শেষমেশ? কৃষি মন্ত্রণালয় বলছে পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত, সংকট নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে সংকট সমাধানে আমদানির বিকল্প নেই। শিল্প প্রতিমন্ত্রী বলছেন, এসব সিন্ডিকেটের কারসাজি। সিন্ডিকেট খুব শক্তিশালী কারণ সেখানে মন্ত্রীরা যুক্ত থাকেন। ক্যাব সভাপতি বললেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণ কঠিন। এখানে দাম নির্ধারিত হয়ে ব্যবসায়ীদের বাঁশির সুরে। ফলে বাজারের নিয়ন্ত্রণ সরকারের হাতেও থাকতে হবে। এটা একটা সাময়িক সমাধান হতে পারে কিন্তু এখানেও তো ভয়। মন্ত্রীরা যদি সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করবে কে?
রাজেকুজ্জামান রতন: সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)।
এসএন