নারী দিবসের ভাবনা
পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি

ছবি: ঢাকাপ্রকাশ
কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের প্রতিবাদে এবং ন্যায়সংগত দাবি আদায়ে রাজপথে নেমেছিলেন নারী শ্রমিকেরা। এই শ্রম আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দীর্ঘ পথপরিক্রমায় চালু হয় ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’।
গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি দিবসটি জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়। এই স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ বিশ্বরূপ পায়।
‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ এখন নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিকসহ সব ধরনের অর্জন উদ্যাপনের একটি বৈশ্বিক দিন। একই সঙ্গে দিবসটি লৈঙ্গিক সমতার বিষয়টিও তুলে ধরে। নারীর উন্নয়ন-অগ্রযাত্রাকে আরও এগিয়ে নিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের ডাক দেয়।
নারী দিবস বিশ্বব্যাপী নারী অধিকার ও ক্ষমতায়নের প্রতীক হিসেবে পালিত হয়। তবে বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষত ধর্ষণের ঘটনা, একটি গভীর সামাজিক সমস্যা।
বিষয়টিকে নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, পিতৃতান্ত্রিকতা হলো এমন একটি সামাজিক কাঠামো, যেখানে পুরুষেরা ক্ষমতা, সম্পদ এবং সামাজিক নিয়ন্ত্রণের শীর্ষে অবস্থান করে। এই কাঠামো নারীদের অধস্তন হিসেবে চিহ্নিত করে এবং তাদের কেবলমাত্র যৌন বস্তু, পরিবারের দায়িত্বশীল বা সন্তানের জন্মদানের ভূমিকা পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রাখে। কভলাস্কির মতো নৃবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, সমাজের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামো নারীর অধিকারকে সীমিত করে রাখে। এই দৃষ্টিভঙ্গি ধর্ষণের মতো অপরাধকে সমাজে একটি ‘ক্ষমতার প্রদর্শনী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ক্রমবর্ধমান। ২০২৩ সালের একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা রয়েছেন। নারীদের বিরুদ্ধে এমন অপরাধের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:
১. ক্ষমতা এবং নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার:
ধর্ষণকে নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে এটি কেবল যৌন আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখেন না; এটি মূলত ক্ষমতা ও আধিপত্য বজায় রাখার একটি হাতিয়ার। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে ধর্ষণ পুরুষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার একটি চূড়ান্ত রূপ। এটি নারীর উপর পুরুষের শারীরিক ও সামাজিক ক্ষমতার প্রকাশ ঘটায়।
২. সামাজিক শ্রেণি এবং নারীর অবস্থান:
নৃবিজ্ঞানী পেগি স্যান্ডে এবং প্যাট্রিসিয়া ড্রেপারের গবেষণায় উঠে এসেছে, যেসব সমাজে নারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে স্বাধীন, সেখানে ধর্ষণের ঘটনা তুলনামূলক কম। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর স্বাধিকার হ্রাস করার জন্য ধর্ষণকে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
৩.যৌন সহিংসতার বৈধতা ও সংস্কৃতি:
পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোতে ‘ধর্ষণ সংস্কৃতি’ একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। সমাজ নারীদের পোশাক, চলাফেরা বা আচরণকে ধর্ষণের জন্য দায়ী করে। নৃবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো তৈরি করে, যা ধর্ষণের ঘটনার জন্য অপরাধীকে দায়মুক্তি দেয়।
এই ধর্ষণের হার কেবলমাত্র আইনি ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে নয়, বরং এটি সাংস্কৃতিকভাবে গঠিত। অনেক সমাজে ধর্ষণকে একটি ‘নিন্দনীয় অপরাধ’ হিসেবে দেখা হলেও নারীর মর্যাদা সেখানেও অবহেলিত থাকে। উদাহরণস্বরূপ:
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর কৌমার্য বা শুদ্ধতা মূল্যায়িত হয়, এবং ধর্ষণকে নারীর ‘‘সম্মানহানির’’ কারণ হিসেবে দেখা হয়, যা নারীর জন্য দ্বিগুণ শাস্তি বয়ে আনে। সমাজে নারীকে ‘ভুক্তভোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করে, যা তাদের অধিকারের পক্ষে কথা বলার ক্ষমতাকে আরও দুর্বল করে। নারী দিবস নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ তৈরি করে। এই দিনটিতে নারীদের প্রতি সহিংসতার বিরুদ্ধে সচেতনতা বাড়ানো এবং পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তনে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
লেখক: সালমা আক্তার
শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
