টিপ পরা নিয়ে অসহিষ্ণুতা: ধর্ম ও সংস্কৃতি
রাজধানীর ফার্মগেটে কপালে টিপ পরায় এক শিক্ষিকাকে প্রকাশ্যে গালি দেওয়া এবং গায়ে মোটরবাইক উঠিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে থানায় মামলা হয়েছে এবং তদন্ত চলছে বলে জানা গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ ধরনের ধর্মীয় উগ্রতার সহিংস প্রকাশ উদ্বেগজনক। বলা হয়ে থাকে, ষাট, সত্তর, এমন কি আশির দশকেও রাজধানী ঢাকাসহ সারা বাংলাদেশে হিজাব, বোরকা পরার এত চল ছিল না। এখন যে কোনো আয়োজনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, রাস্তা-ঘাটে হিজাব ও বোরকার আধিক্য দেখা যায়। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না!
ভাষা আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মাধ্যমে এই দেশ স্বাধীন হবার স্বপ্ন দেখেছিল। আর স্বাধীনতার মূল ভিত্তি ছিল বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ। তাই এখানে ধর্মীয় গোঁড়ামি বেড়ে যাবার কারণ কী-তার আত্মনুসন্ধানের প্রয়োজন রয়েছে।
এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান তথা ইসলাম ধর্মালম্বী। তাদের বেশির ভাগই ইসলাম ধর্মের নানা অনুশাসন মেনে চলার চেষ্টা করেন। এমনও বলা হয়, ইসলাম ধর্মের জন্মস্থান আরবের মসুলমানরা যত না ধর্মকে ধারণ করে এদেশের মুসলমানরা তার চেয়ে বেশি সচেতন। তারপরও এদেশের মুসলমানকে আরও বেশি মুসলমান তথা প্রকৃত মুসলমান হবার জন্য প্রতিনিয়ত ওয়াজ, নসিহত, সবক দিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির কথিত আলেম, ধর্মান্ধ ব্যক্তি!
ধর্ম, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে শিক্ষা না থাকায় তাদের মনগড়া ও উদ্দেশ্যমূলক নানা বক্তব্য অনেককে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া মান্ধাতার আমলের মাদ্রাসা শিক্ষার মাধ্যমে যে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রতিবছর বিভিন্নভাবে কর্মজীবনে প্রবেশ করছে তাদের বেশীর ভাগই ধর্মীয় বিভ্রান্তির মধ্যে থাকে।
মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। টিপ পরা ইসলাম অনুমোদন করে না-এমনটাই বলা হচ্ছে। আর এটা আজ নয়, অনেকদিন থেকে মাঝে মধ্যে এ নিয়ে ঝাঁজালো বক্তব্য দেয় বা বিতর্ক তৈরি করে ইসলাম ধর্মের কথিত ধ্বজাধারীরা। কিন্তু তারা সৌদীসহ আরবের মুসলমানরা কেন হিন্দুদের মত উলুধ্বনি দেয় সে সেম্পর্কে কিছু বলে না!
আরবের মুসলমান নারীরা সাধারণত: বিয়ের অনুষ্ঠানে উলুধ্বনি দিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। এটা তাদের সংস্কৃতির অংশ। অন্যদিকে হিন্দু নারীরাও বিয়ের অনুষ্ঠানে উলুধ্বনি দেয় শুভ কাজ শুরুর সময়। এ ছাড়া তারা কোনো দুর্যোগেও উলুধ্বনি দেয় অশুভ শক্তিকে তাড়াতে।
তেমনিভাবে টিপ মহিলাদের সাজ-সজ্জার একটি উপকরণ মাত্র। এটা ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। যার কারণে প্রাচীন কাল থেকেই এই অঞ্চলে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে মহিলাদের কপালে টিপ পরার প্রথা প্রচলিত রয়েছে।
ধর্ম ও সংস্কৃতিকে পরস্পরবিরোধী না দেখে পরিপূরক হিসেবে দেখলে বিভ্রান্তি থাকে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ইন্দোনেশিয়া হলো হিন্দু সংস্কৃতিকে ধারণ করা সব চেয়ে বড় মুসলিম দেশ। ২৫ কোটিরও বেশি মানুষের এই দেশের ৯০ শতাংশ মসুলিম। মাত্র ৩ শতাংশ হিন্দু। কিন্তু এক সময় ইন্দোনেশিয়া মালয়শিয়া হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য ছিল। ইসলাম আসার পর তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রার্থনার উপায় বদলেছে, কিন্তু সংস্কৃতির পরিবর্তন হয়নি।
তাই সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে ইন্দোনেশিয়ার মুদ্রা ‘রূপাইয়ায়’ হিন্দু ধর্মের দেবতা গণেশের ছবি আছ। এ ছাড়া নানা সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও গণেশের প্রতিমূর্তি আছে। হিন্দু পুরানের পৌরাণিক পাখি গরুড় নামে ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় এয়ারলাইন্সে গারুড়া (গরুড়) ইন্দোনেশিয়া। সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার লোগো হলো ‘হনুমান’। বিদেশে ইন্দোনেশিয়ার দূতাবাসের সামনে আছে বিদ্যার দেবী স্বরসতীর মূর্তি। এখানকার সবকিছুতেই হিন্দু সংস্কৃতির ছাপ সহজেই চোখে পড়ে। মানুষ, স্কুল, রাস্তা, দোকানের নাম সংস্কৃতে রাখা হয়েছে।
অন্যদিক আরব দেশগুলোর মধ্যে অবগুণ্ঠন সরিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলছে। দুবাই ইতিমধ্যে অন্তর্জাতিক বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সৌদী আরবেও কনসার্ট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নানা বিধিনিষেধ শিথিল করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল, ২০১৩ সালের দিকে একবার বাহরাইন গিয়েছিলাম। সৌদী আরবের দাম্মাম প্রদেশের সঙ্গে বাহরাইনকে সংযুক্ত করা হয় আরব সাগরের উপর তৈরি করা ২৫ কিলোমিটারের একটি সেতুর মাধ্যমে। প্রতি বৃহস্পতিবার বিকাল থেকে সৌদী থেকে আসতে থাকে গাড়ির সারি । দুই দিনের সাপ্তাহিক ছুটির আনন্দ ফূর্তি শেষে আবার ফিরে যায় তারা। বাহরাইনের এক নাইট ক্লাবে দেখেছি, জোব্বা পরা তসবিহ হাতে কয়েকজন সৌদী ফিলিপিনো নর্তকীর সঙ্গে নৃত্য করছে! এ কথাগুলো এ জন্য বলা যে, আমাদের এখানে যারা কথায় কথায় ধর্মের দোহাই দেয়, তাদের কাছে আরব দেশ, আরব দেশের মানুষ নিয়ে অনেক ভুল ধারণা আছে!
সবশেষে বলি, একুশে ফেব্রুয়ারি ভোরে শহীদ মিনারে নগ্নপায়ে পদযাত্রা, ফুল দেওয়া আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে গিয়েছে। একইভাবে পহেলা বৈশাখও উদযাপিত হয়ে আসছে। এসব নিয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো অপব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ নেই!
ইব্রাহিম আজাদ: লেখক ও সাংবাদিক