বঙ্গবন্ধুর পল্লী উন্নয়ন দর্শন: আমাদের বাস্তবতা
জল-জমি-জনতার দেশ, আমাদের এই বাংলাদেশ। অপার সম্ভাবনার এই দেশটিকে ঘিরে ছিল বঙ্গবন্ধুর হাজারো স্বপ্ন। দুঃখী, মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী মহাচিন্তাশীল ব্যক্তিত্ব। তিনি বলতেন, ‘আমার জীবনের একমাত্র বাসনা বাংলার মানুষ যেন পেট ভরে খেতে পায়,পরনে কাপড় পায়, উন্নত জীবনের অধিকারী হয়। আমাদের সংবিধানের ১৪ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পল্লীবাসীকে গুরুত্ব দিয়ে পল্লী প্রকৃতিতে লিখেছিলেন, ‘গ্রামবাসীর প্রতি অবহেলা গেঁয়ো ব্যবস্থা। শহরবাসীর অহমিকা যাতে মিলতে দেয় না, ভেদকে জাগিয়ে রাখে।’ নোবেল বিজয়ী সুলজের ভাষায়–একবার যদি বিনিয়োগ সুবিধা ও কার্যকরী উদ্দীপনার সুযোগ সৃষ্টি হয় তাহলে কৃষকেরা বালিকে সোনায় রূপান্তর করবে। কথাটি নিরেট সত্য। পল্লীর কৃষককে উজ্জীবিত করার অপূর্ব কথামালা সুলজের কথায় লুকিয়ে রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারি কর্মচারীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন–‘সরকারি কর্মচারীদের জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। তাঁরা জনগণের খাদেম, সেবক, ভাই। তাঁরা জনগণের বাপ, জনগণের ভাই, জনগণের সন্তান। তাদের এই মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙাল আমি। আমি সব হারাতে পারি, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না। সমস্ত সরকারি কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে তাদের সেবা করুন।’
বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের ১৩ (খ) অনুচ্ছেদে সম্পদের মালিকানার অন্যতম খাত হিসেবে সমবায়কে স্বীকৃতি দেয়া হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধুমাত্র সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়েই সমবায়কে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি পল্লী উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং শোষিত মানুষের নায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য দেশে প্রথম পষ্ণবার্ষিকী পরিকল্পনায় সমতাভিক্তিক উন্নয়ন দর্শনের আওতায় সমবায়কে অন্যতম কৌশলিক হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনার সুযোগ করে দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন অগ্রযাত্রা মিশে আছে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের পথ ধরে। বঙ্গবন্ধু দেশের পল্লী উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমাজতন্ত্রে উত্তরন ও বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠার বিপ্লবকে একসঙ্গে গ্রথিত করেছেন। সরকারের বিশেষ প্রকল্প একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত অসংখ্য অসহায়, নিঃস্ব পরিবার ঠিকানা পেয়েছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে দেশ আজ বহুদূর এগিয়ে। বঙ্গবন্ধুর দর্শন ছিল ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত, গ্রামবান্ধব স্বনির্ভর গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। তাঁর জীবন দর্শন ছিল এদেশের গণমানুষের সুখ সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্টায় এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকলেরই। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পল্লী উন্নয়নে বলিষ্ঠ ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
এবারের ডিসি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী টেকসই পল্লী উন্নয়নে আমার শহর আমার গ্রাম বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেন। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশে পদার্পনের লক্ষ্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গঠনে কাজ করছে সরকার। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার প্রত্যন্ত পল্লী এলাকায় নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বাচ্ছল্য পৌঁছে দেয়ার জন্য আমার গ্রাম আমার শহর এর যে ধারনা ব্যক্ত করেছে তা রুপায়নে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ কার্যকর ভূমিকা রাখবে এটা আশা করা যায়। জাতির পিতার এই সমবায়ভিক্তিক গ্রাম উন্নয়ন ভাবনায় সমবায় অধিদপ্তর কর্তৃক গ্রামের বৈশিষ্ট্য সমুন্নত রেখে গ্রামীণ সম্পদের সুষ্ঠু ও সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করে সকল শ্রেণি পেশার জনগণকে অন্তর্ভুক্ত করে সমবায় সমিতি গঠনের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রামে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সমবায়ভিক্তিক বঙ্গবন্ধু মডেল গ্রাম প্রতিষ্ঠার পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী এ দেশের কৃষি ও পল্লী উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর দর্শন লালন করে অংশগ্রহণমূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছেন। বাংলাদেশ আজ বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পল্লী উন্নয়নের পথ ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দিক নির্দেশনায় কাজ করে যাচ্ছে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সম্পদের যথাযথ ব্যবহার ও মানব সম্পদ উন্নয়নে গ্রামে একটি ছাতা প্রতিষ্ঠানের চিন্তা বার্ড শুরু করে। পল্লী উন্নয়নে বার্ডের গবেষণাও বহুল প্রশংসিত।
সমগ্র বিশ্ব আজ ভয়াবহ কোভিড-১৯ ভাইরাসজনিত মহামারির কবলে বিপর্যস্ত। ইতিমধ্যে আমাদের দেশে এর প্রকোপ অনেকটাই কমেছে। করোনা কমলেও এর ক্ষত এবং নেতিবাচক প্রভাব বয়ে চলবে বহুদিন। অর্থনেতিক ও সামাজিক প্রভাব ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। অর্থনেতিক ও সামাজিক অস্থিরতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ইতিমধ্যে লাগামহীন নিত্যপণ্যের দামের অস্থিরতা স্বাভাবিক জীবনকে দুর্বিষহ করেছে। নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির একবেলা পেটপুরে খাবার খাওয়া এখন যেন বিলাসিতায় রূপ নিয়েছে। করোনাকালে পল্লীর জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা প্রতিকূলতায় থাকায় তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়ন তেমনটা আশা করা যাচ্ছে না। দারিদ্র্য প্রবণ জেলাগুলোতে নিত্যপণ্যের চড়াদামের প্রভাবে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। তারপরও সরকার নানাভাবে আর্থিক প্রনোদনার মাধ্যমে সংকট কাটানোর চেষ্টা করছে।
বঙ্গবন্ধু প্রনয়ণ করেছিলেন বাংলাদেশ উপযোগী শোষিতের গণতন্ত্র, কোনো আমদানিকৃত সমাজতন্ত্র নয় অথচ আত্মনির্ভরশীলতার অর্থনীতির সোপানযাত্রা। ফিদেল ক্যাস্ত্রো ঠিকই এক মহান মানুষকে চিনেছিলেন তিনি দৃপ্তকন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, শেখ মুজিবকে দেখেছি। সাহস ও ব্যক্তিত্বে মানুষটি হিমাদ্রি সদৃশ।’ বঙ্গবন্ধুর পল্লী উন্নয়ন ভাবনার কেন্দ্রে ছিল কৃষি উৎপাদন, আয় বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান। তাঁর উন্নয়ন দর্শনের আলোকে নীতি কৌশল প্রণয়ন করা গেলে জাতি, সমাজ, রাষ্ট্র উপকৃত হবে। তিনি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, যা ছুঁয়েছে বর্তমান টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ঠে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন–কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে, অর্থনীতি হবে স্বনির্ভর। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত পল্লী এলাকা উন্নত ও সমৃদ্ধ হলে ২০৪১ সালে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন পূরণের তালিকায় যথাযোগ্য স্থান করে নিবে, এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: সহকারী সম্পাদক, ঢাকাপ্রকাশ; লেখক ও গবেষক
এসএ/