সকলেই নয়, ‘কেউ কেউ কবি’, ‘কেউ কেউ সাংবাদিক’!
‘সকলেই কবি নয়। কেউ কেউ কবি; কবি—কেননা তাদের হৃদয়ে কল্পনার এবং কল্পনার ভিতরে চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সারবত্তা রয়েছে, এবং তাদের পশ্চাতে অনেক বিগত শতাব্দী ধরে এবং তাদের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক জগতের নব নব কাব্যবিকীরণ তাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সকলকে সাহায্য করতে পারে না; যাদের হৃদয়ে কল্পনা ও কল্পনার ভিতরে অভিজ্ঞতা ও চিন্তার সারবত্তা রয়েছে তারাই সাহায্যপ্রাপ্ত হয়; নানারকম চরাচরের সম্পর্কে এসে তারা কবিতা সৃষ্টি করবার অবসর পায়।’
বাংলা ভাষার আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাশ ‘কবিতার কথা’ প্রবন্ধে এই অমোঘ সত্যটি উচারণ করে প্রকৃত কবিদের রক্ষা কবচ দিয়ে গেছেন বলা যায়! না হয়, এত অজস্র কবি-কবিতার গড্ডালিকা প্রবাহে ভালো কবিকে চিহ্নিত করা দূরুহ বটে। তেমনিভাবে অজস্র কথিত ’সাংবাদিক’-এর ভিড়ে প্রকৃত ’সাংবাদিক’কে রক্ষা করবে কে? কেউ কি বলবে বা বলা কি সম্ভব-’সকলেই সাংবাদিক নয়, কেউ কেউ সাংবাদিক’!
কোন পেশাতেই সহযোগি ছাড়া কাজ করা সম্ভব নয়। সে জন্য সবাইকে ইউনিয়নভুক্ত করার মানে নেই। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, প্রকৃত চিকিৎসকরাই মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন বা প্রকৃত আইনজীবিরাইি আইনজীবি সমিতির সদস্য হতে পারে। তাদের সহযোগিদের আলাদা সংগঠন আছে। মনে হয়, একমাত্র সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেস ক্লাবে এই পেশার সহযোগিরাও সদস্য হতে পারে। এর বাইরে নানা ফাঁক ফোঁকরে যোগ্যতা নেই এমন অনেকের বিরুদ্ধে সাংবাদিক ইউনিয়ন, প্রেস ক্লাবেরও সদস্য হয়ে যাবার অভিযাগ রয়েছে।
তাই ‘সাংবাদিক’-এর সংজ্ঞা নিয়ে নতুন করে ভাবলে বোধ’য় ভালো হবে। এই কথাটি আরো প্রাসঙ্গিক এজন্য যে, প্রায়ই রিপোর্টাররা বলে থাকে, কোন কোন অনুষ্ঠানে অতিথি বা অভ্যাগতের চেয়ে সাংবাদিকের সংখ্যাই বেশি হয়ে যায়! তখন মূল ধারার সাংবাদিকেরা কুণ্ঠিত হয়ে থাকেন, কখনো বসারও জায়গা পায় না! এতে আয়োজকদের বিড়ম্বনার শেষ নেই!
এজন্য এখন অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার সীমিত করে দিতে বাধ্য হয়েছে। ধরা যাক কোন একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভায় অতিথি ও আলোচকের সংখ্যা ১০০ জন। এতে দেশের ৩৮টি চ্যানেলের মধ্যে যদি ৩০টি চ্যানেলের ৩০ জন সাংবাদিক, ৩০ জন ক্যামেরাম্যান্ও যায় তাহলে সংখ্যা হয় ৬০। এর বাইরে নানা অনলাইন টিভির সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান ছাড়াও পত্রিকা, নিউজ পোর্টালের সাংবাদিক মিলিয়ে কত হতে পারে? হিসাব মেলানো যাবে না। ফলে খাবার বা গিফট প্যাকেট দেয়ার সময় হুড়োহুড়ি, কাড়াকাড়ির লজ্জাজনক ঘটনাও ঘটে!
ছোট কোন মফস্বল শহরে এতগুলো টিভি চ্যানেল, পত্রিকা, নানা ডিজিটাল মিডিয়ার প্রতিনিধি সাংবাদিকের সংখ্যা কত হতে পারে তা ধারণা করাও সম্ভব নয়! আর ঢাকা থেকে টাকার বিনিময়ে কোন কোন মিডিয়ার একাধিক প্রতিনিধি নিয়োগ নিয়েও নানা অভিযোগ আছে!
এমন অনেক কথিত সাংবাদিক আছেন, যারা প্রতিদিন কোন অনুষ্ঠানের গন্ধ খুঁজে থাকেন! আমন্ত্রণ থাক বা না থাক, ঠিকই হাজির হয়ে যান। কেউ কেউ নানা প্রয়োজনে সাংবাদিকদের সাথে গেট-টুগেদারের আয়োজন করে থাকে বিভিন্ন ক্লাবে বা হোটেলে। আর সেখানে ডিনারের সঙ্গে পানীয়ের ব্যবস্থা থাকলেতো কথাই নেই! কারো কারো কাছে সন্ধ্যার পর কোথায় বিনাপয়সায় মদ্যপান করা যাবে তার হদিস করাটাই মূখ্য! সেরকম কোন আয়োজনে গেলে অনেকের হুঁশও থাকেনা! একটার পর একটা ব্র্যান্ডের পানিয় পান করতে করতে বেসামালও হয়ে পরে! এ প্রসঙ্গে মনে পড়ল নীরদ সি চৌধুরীর বিখ্যাত উক্তি, মদকে আমি উপভোগ করব, মদ আমাকে নয়।
চট্টগ্রামের প্রয়াত জনপ্রিয় মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী অনেক সময় সাংবাদিকদের ‘হুজুর‘ বলে সম্বোধন করতেন। । তাই তাঁকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন তিনি ‘হুজুর’ বলছেন? স্মিত হেসে ঠাট্টার সুরে তিনি বলেছিলেন, হুজুর আর সাংবাদিক একই না!
পুনশ্চ: সংসদে উপস্থাপন করা গণমাধ্যম বিলটি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছে। এ অবস্থায় আশা করি, বিচার বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় সংশোধনের মাধ্যমে শুধু মালিকদের নয়, সাংবাদিক তথা গণমাধ্যম কর্মীদের কাছেও যাতে এটি গ্রহণযোগ্য হয় তার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লেখক: গণমাধ্যম কর্মী।