প্রতিবন্ধী নাগরিকরা সমঅধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুক
আমরা জানি, ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। তবে আমরা হয়ত অনেকেই জানি না, ২৩শে মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপুর্ণ দিন। এই দিনে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। এজন্য দিনটিকে আমরা পতাকা উত্তোলন দিবসও বলি, প্রতিরোধ দিবসও বলি। যদিও উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে এদিনটি লাহোর প্রস্তাব দিবস ।
১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ লাহোরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ সভায় শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এই উপমহাদেশে দুটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এনেছিলেন। তার একটি হবে উত্তর পূর্ব ভারতকে নিয়ে এবং বাংলাদেশ, অন্যটি পাকিস্তান। তবে নির্মম রাজনৈতিক ইতিহাস ঘটনা প্রবাহকে পাল্টে দেয়। দুটির জায়গায় একটি রাষ্ট্র হয়। মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান, ১৯৪৭ সালে। চব্বিশ বছরের বঞ্চনা, বৈষম্য নিপীড়ন, অত্যাচার, এমনকি আমাদের মাতৃভাষার উপরে যখন আঘাত এসবের বিরুদ্ধে আমাদের পর্যায়ক্রমে জবাব দিতে হয়েছে।
আমি একজন দৃস্টি প্রতিবন্ধী নাগরিক। এই দেশে কোনো প্রতিবন্ধী নাগরিকের, প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য কোনো রকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৯৫৬ সালে ঢাকায় চিকিৎসা শেষে আমার চক্ষু বিশেষজ্ঞ আমার মরহুম পিতা-মাতাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, আমার দুটি চোখেরই দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। কাজেই তখন আমি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী অর্থাৎ তখন সবাই বলতেন, অন্ধ হয়ে গেছে। তখন এদেশে আমার লেখা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকার পরিচালিত হচ্ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন। মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আতাউর রহমান খান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তখন এক তরুন তেজস্বী রাজনৈতিক নেতা এবং মন্ত্রী পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৭ সালের ২ এপ্রিল ঢাকায় রোটারি ক্লাব আয়োজন করে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে দৃস্টি প্রতিবন্ধীদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। যেহেতু এদেশে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগে ছিল না, কোনো শিক্ষক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়, তাই কলকাতা রোটারি ক্লাবের সহায়তায় একজন শিক্ষক প্রয়াত বিভূতি ভূষণকে নিয়ে আসা হয়। আর আমাকে সনাক্ত করা হয় প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্র হিসেবে।
১৯৫৭ সালের ২ এপ্রিল ৭ বছর বয়সে আমি আমার দ্বিতীয় যাত্রা শুরু করি। অর্থাৎ দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে আবারও লেখাপড়া করার জন্য আমার প্রথম স্কুলে যাওয়া। একটি ভাড়াটে বাড়িতে ১৭/৮ ওয়ারি র্যাংকিং স্ট্রিট, পুরোনো ঢাকায় আমার প্রথম স্কুল জীবন শুরু। এখনও মনে পড়ে মাস্টার বাবুর হাতে যখন আমার মা আমাকে নিয়ে গেলেন, তার আগে স্কুল উদ্বোধন হয়েছিল ১৫ই মার্চ। সেদিন অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, মাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, মিসেস চৌধুরী, আপনি মনসুরকে নিয়ে ভাববেন না। সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে বটে, কিন্তু আজ থেকে সে পড়ালেখা শিখবে। আমাদের হেড মাস্টার সাহেব তিনি আমাকে বাংলা ব্রেইল পদ্ধতির মাধ্যমে বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত করলেন। ইংরেজি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় করলেন। বললেন, প্রথমে ইংরেজি বর্ণমালা শিখবে। ছয়টি বিন্দু বা ডট দিয়ে নানানভাবে সাজানো হয়। সেভাবেই শিখলাম। তিন চার দিন সময় লাগল। তারপর বাংলা শেখানো হল। বিভিন্ন বস্তুর আকার প্রকার বোঝানোর জন্য বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আসা হল। পাতার যে ঘ্রাণশক্তি সেটি পরীক্ষা করার চেষ্টা চলল। তারপর দুপুরবেলা মাদুর পেতে সংগীত শিক্ষার ব্যবস্থাও করা হল। আজও সেই গানটির কথা মনে আছে, জীবনের গভীর অর্থ তখন বুঝি নাই। গানের কথাগুলো ছিল এরকম,
এই করেছ ভাল নিঠুর হে, নিঠুর হে
এই করেছ ভাল
এমনি করে হৃদয়ে মোর
তীব্র দহন জ্বালো
এই করেছ ভাল নিঠুর হে, নিঠুর হে
এই করেছ ভাল।
জীবনের এই প্রান্তে এসে রবীন্দ্রনাথের লেখা এই গানটি আমার মনে হয় যেন প্রতিদিনের প্রার্থনা সংগীত।
খুব মনে হচ্ছে, জাতির পিতা সম্পর্কে একটি কথা বলা উচিত। আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান, শুধুমাত্র তার কন্ঠস্বর শুনি নাই, তাকে স্পর্শ করেছি। তার সঙ্গে করমর্দন করেছি। সেটি প্রথম ঘটেছিল ১৯৬৯ সালে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। পাকিস্তান থেকে ছয়জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে বিশ্ব অন্ধ প্রতিবন্ধী সম্মেলনে কলম্বোতে যাবেন। পাকিস্তান থেকে আমরা তিনজন ছাত্র। সে উপলক্ষে ১৯৬৯ এর সেপ্টেম্বরের এক সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যাই। বঙ্গবন্ধু তার কয়েকজন বন্ধু ও সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমরা যাব তিনি জানতেন। খুব স্নেহ করলেন, আদর করলেন। বললেন, এই বয়সে তোমরা যাচ্ছ, নিজের দেশেকে তুলে ধরবে। তোমাদের সমস্যা নিয়ে কথা বলবে। তোমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সেদিন অনেক উৎসাহ অনেক প্রেরণার কথা শুনিয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার তার সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেটি ২৫শে জানুয়ারি ১৯৭২, পুরানো গণভবনে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী’র সঙ্গে আমাদের আগের দিন দেখা হয়। তিনি যেহেতু রোটারি ক্লাবের চেয়ারম্যান ছিলেন, সে কারণে শৈশব থেকেই আমাকে চিনতেন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তার সঙ্গে দৃষ্টি প্রতিবন্দ্বীদের সমস্যা নিয়ে আমরা আলাপ করতে গিয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তোমরা কাল দেখা করতে যাবে, আমি তোমাদের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। উনি প্রথমে ভুল বুঝেছিলেন। উনি ভেবেছিলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েছি। আমরা তাকে জানিয়েছিলাম, আমরা শৈশব থেকেই দৃষ্টি প্রতিবন্ধী। আমরা বলেছিলাম, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত। এটি কোনো কল্যাণজনক কিছু হতে পারে না। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষা মন্ত্রণালয়য়ের অধীনস্ত করা হোক। তিনি সহমত প্রকাশ করে বলেছিলেন, অত্যন্ত ভাল কথা। তিনি বললেন, ‘তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ সাহেবকে আমি এ ব্যাপারে বলে দেব। ‘আমাদের লিখিত স্মারকলিপি তিনি রাখলেন এবং অনেক উৎসাহ দিলেন। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হল, কিছু অনাহূত জটিলতার কারণে পরিশেষে সেটি আর বদল করা যায়নি। আজও এ দেশের প্রতিবন্দ্বীদের শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্ত। অথচ আমরা কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। অথচ আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে।
ফিরে আসি ১৯৭৪সালে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। যেমন প্রতিটি মহকুমার অধীন সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমন্বিত কার্যক্রমে ১০ জন করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। উনি এরকমই নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রক্রিয়াটি তিনি চালু করে দিয়ে গিয়েছিলেন। তার সেই অসম্পূর্ণ কাজ তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একুশ বছর পরে সেটি পুনরায় চালু করেছেন। বর্তমানে মেধাবি প্রতিবন্দী শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হয়। অস্বচ্ছল প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভাতা দেওয়া হয়।
ইতিহাস অনেক লম্বা। অনেক সময় পেরিয়ে গেছে, প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে কিছু কাজ নিশ্চয় হয়েছে। তবে দুঃখজনক হল, যতটুকু হয়েছে অথবা যেটুকু হবার কথা ছিল, তা খুব বেশি কিছু নয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধীসহ সকল প্রকার প্রতিবন্ধীদের নানা সমস্যা, যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেছে। শিক্ষাক্ষেত্র, শিক্ষা শেষে তার কর্মসংস্থান, মর্যাদার সঙ্গে চাকরি করে বেঁচে থাকার পরিবেশ এখনো হয়নি। রাজনৈতিক অঙ্গীকার থাকতে পারে, কিন্তু তাকে বাস্তবায়িত করতে হবে। এ কথা আবারও বলি যে, প্রতিবন্দ্বী মানুষের সমস্যা ব্যাপক। উন্নয়নশীল দেশে এই সমস্যা অনেক গভীর ও অনেক বেশি। আমরা সভ্যতার উষালগ্ন থেকে আজ অব্দি যেভাবে এগিয়ে চলেছি, একসময় প্রতিবন্ধীদের আইসোলেটেড করে রাখতাম, এখন ইনক্লুসিভ করা হয়েছে। এখন আমরা সমঅধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখি। আমার বিশ্বাস এই স্বাধীন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় হয়তো একদিন আমি থাকব না, আমি না থাকি, তাতে কি আসে যায়। এদেশের প্রতিবন্ধী নাগরিকেরা সমান অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকুক। আপনারা মনে রাখবেন, আমরা যারা প্রতিবন্ধী মানুষ, আমরা প্রথমে মানুষ, তারপর প্রতিবন্ধী।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি, ইমপ্যাক্ট ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ ও প্রতিবন্ধী বিষয়ক মানবাধিকার কর্মী