ধারাবাহিক উপন্যাস: শেষ পর্ব
দ্য ফার্স্ট ম্যান
তার মনের ভেতরের অন্ধকার থেকে লাফিয়ে উঠত ক্ষুধায় মৃতপ্রায় আকূলতা, তার চিরসঙ্গী উন্মাদ জীবনাকাঙ্ক্ষা। সেই আকাঙ্ক্ষা এখনও তার সঙ্গেই আছে, অপরিবর্তনীয় অবস্থায় আছে। যে পরিবার সে পুনরাবিষ্কার করেছে সেখানে তিক্ততার কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং প্রায়ই তার ছেলেবেলার চিত্রকল্পের মুখোমুখি এসে যায় সেই আকাঙ্ক্ষা। সে বুঝতে পারে, তার ছেলেবেলার আকস্মিক অনভূতি একজন বিশেষ নারীর মতো নাগালের বাইরে চলে যায়। সেই নারীকে সে ভালোবেসেছে, হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা দিয়েছে। সে ভালোবাসায় তার শরীরও স্বর্গীয় পুলক লাভ করেছে। তার সঙ্গে ভালোবাসার অভিজ্ঞতায় জ্যাকের আকাঙ্ক্ষা ছিল গনগনে আগুনের মতো। তার সঙ্গে ভালোবাসার লীলায় রাগমোচনের মুহূর্তে জ্যাকের মধ্যে এক ধরনের নীরব কান্না চলে আসত। নিজের জগতের সঙ্গে তৈরি হতো এক গভীর ঐক্যের বন্ধন। জ্যাক তাকে ভালোবেসেছে তার সৌন্দর্যের জন্য, জীবনের প্রতি তার হতাশাভরা আকূলতার জন্যও। তার এমন মানসিকতার জন্য সময়ের চলে যাওয়ার বিষয়টা সে অস্বীকার করত। যদিও সে জানত, সময় ঠিক ওই মুহূর্তেও চলে যাচ্ছে। তবু সে চাইত সবাই তাকে সে এখনও অল্পবয়সী আছে না বলে বরং বলুক সে সব সময়ই অল্পবয়সী ছিল ও আছে।
হাসতে হাসতে একদিন জ্যাক তাকে বলেছিল, যৌবনকাল চলে যাচ্ছে। দিনগুলোও শেষ হয়ে যাচ্ছে। তখনই সে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। অশ্রুভরা চোখে সে বলেছিল, না, না। এ হয় না। আমি প্রেমের প্রেমে পড়েছি। অনেক দিক থেকেই সে বুদ্ধিমতি ছিল। সবার থেকে আলাদা ছিল। সে কারণেই হয়তো সে চারপাশের জগৎ যেমন আছে তেমনভাবে গ্রহণ করতে পারত না। যে বিদেশ বিভূইয়ে তার জন্ম সেখান থেকে স্বল্প সময়ের ভ্রমণ সেরে ফিরে আসার পরও এমন হতো। আগে কখনও কখনও বেড়াতে গেলে কোনো কোনো খালা ফুপুদের সম্পর্কে তাকে বলা হতো, এবারই তাকে শেষ দেখা, আর হয়তো দেখা নাও হতে পারে। পরে তাদেরই কারো দাফনের জন্য যেতে হতো। তাদের মায়াভরা মুখ, শরীর, ভেঙে যাওয়া চেহারা দেখে তার চিৎকার দিয়ে বের হয়ে আসতে ইচ্ছে হতো। কখনওবা আত্মীয় স্বজনদের পারিবারিক খাবারে অংশগ্রহণ করতে গেলে খাবার টেবিল ক্লথ দেখে মনে পড়ে যেত অনেক দিন আগে গত হয়ে যাওয়া কোনো দাদি, নানি কিংবা তাদের মায়ের কথা।
টেবিলে বসে হয়তো সে ছাড়া আর কেউ তখন ওই প্রিয় মানুষটির কথা ভাবত না। তার মনে পড়ে যেত তার নিজের মতোই তাদের অল্প বয়সের কথা, তাদের আনন্দের কথা, তাদের জীবনাকাঙ্ক্ষার কথা। তারাও যৌবনকালে তার মতোই অদ্ভূত সৌন্দর্যের অধিকারিনী ছিলেন। খাবার টেবিলে বসে অন্যরা তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করলে দেয়ালে সাজানো ছবিগুলোর মানুষের যৌবনের কথা মনে পড়ে যেত তার। তারাও এক সময় ফুটন্ত ফুলের মতোই ছিলেন। কেউ কেউ আর নেই; কেউ কেউ এখন চেহারায় ভেঙে পড়েছেন। তারপর তার রক্তে যেন আগুন লেগে যেত। পালিয়ে আসতে ইচ্ছে হতো এমন এক জায়গায় যেখানে কেউ বুড়িয়ে যায় না, যেখানে শরীরের সৌন্দর্য অক্ষয়, যেখানে জীবন থাকবে বুনো, থাকবে ঔজ্জ্বল্যে ভরা। কিন্তু জীবন তো সে রকম থাকে না, থাকেনি কখনও। এরকম মানসিকতায় ফিরে এসে জ্যাকের বাহু বেষ্টনে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠত। জ্যাক তাকে বেপরোয়া ভালোবাসায় ভরিয়ে দিত।
আর জ্যাকের অবস্থা তার চেয়েও শোচনীয়; যেখানে তার জন্ম সেখানে তার কোনো পুর্বপুরুষ ছিল না। ছিল না কোনো স্মৃতির উৎস। সেখানে তার পূর্বে যারা এসেছিল তাদের পরিপূর্ণ ধ্বংসই ছিল অনিবার্য। কোনো সভ্য সমাজে মানুষ যেভাবে সান্ত্বনা পেয়ে থাকে সেখানে বার্ধক্যে সান্ত্বনার তেমন কোনো সুযোগই ছিল না। একটা নিঃসঙ্গ ও ধারালো তরবারির মতো একটিমাত্র কোপে চিরতরে ভেঙে চুরমার হওয়ার নিয়তি ছিল তার। জীবনের প্রতি তার প্রবল ও অবিমিশ্র অনুভূতি সব সময় যেন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। আজ তার মনে হয় মানুষ, জীবন, যৌবন- সবই যেন তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কাউকে ধরে রাখতে পারছে না সে। এখন শুধু আছে তার একটি অন্ধ প্রত্যাশা এই অদৃশ্য শক্তিই এতগুলো বছর ধরে তাকে দৈনন্দিন গতানুগতিকতার ঊর্ধ্বে তুলে রেখেছে, তাকে পুষ্টি জুগিয়েছে উদারভাবে, সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও মাথা নত না করার ক্ষমতা দান করেছে। এই শক্তিই অশেষ উদারতায় তাকে বেঁচে থাকার সুবুদ্ধি দান করেছে। তেমনিভাবে কোনো রকম বিদ্রোহ ছাড়াই বার্ধক্যে পৌঁছে যাওয়া এবং মৃত্যুবরণ করার মতো কাণ্ডজ্ঞান সে লাভ করবে এই অদৃশ্য শক্তির কাছ থেকেই।
সমাপ্ত
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
দ্য ফার্স্ট ম্যান: পর্ব-৫৬
দ্য ফার্স্ট ম্যান: পর্ব-৫৫
এসএন