ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৫০
দ্য ফার্স্ট ম্যান
বইটা কোন পদ্ধতিতে ছাপা হয়েছে তার উপর নির্ভর করে পাঠক আগেই বুঝতে পারত, ওই বই থেকে কী ধরনের এবং কতখানি আনন্দ লাভ করতে পারবে। জ্যাক এবং পিয়েরে বড় বড় অক্ষরে দুপাশে সুপরিসর মার্জিনঅলা বই পছন্দ করত না। মার্জিত রুচির পাঠকদের জন্য তেমন বই পছন্দ হলেও তাদের পছন্দ ছিল ছোট অক্ষরে টাইপ করা এবং পৃষ্ঠায় কম মার্জিন সংবলিত বই। শব্দ আর বাক্যে পুরোপুরি ঠাসা বই ছিল তাদের প্রিয়। বড় আকারের পুরনো গামলার মধ্যে অনেক পরিমাণ খাবার যেমন ভয়াবহ ক্ষুধা নিবৃত্ত করার পরও কিছু খাবার অবশিষ্ট থাকে তেমনভাবে বইয়ের মধ্যে অনেক কিছু থাকবে যা দিয়ে তাদের পড়ার ক্ষুধা নিবৃত্ত করা যায়। সুক্ষ ব্যাপার স্যাপার তাদের পছন্দ ছিল না। তারা যেহেতু কোনো কিছুই ভালো করে জানত না, তাদের সবকিছুই জানার দরকার ছিল। বইটা সুলিখিত না হলে, কিংবা ভালো বাঁধাই না থাকলেও তাতে তাদের কিছু যেত আসত না। লেখার বক্তব্য হওয়া চাই প্রাঞ্জল এবং পৃষ্ঠা ভরা থাকা চাই অত্তুগ্র ঘটনাবলী। তাহলে ওইসব বই তাদের স্বপ্নের ক্ষুধা মিটাতে পারত এবং ওইসব বই পড়ার মাধ্যমে তারা যেন একটা প্রবল ঘুমের ভেতর ডুবে যেতে পারত।
তা ছাড়া প্রত্যেক বইয়ের ছিল আলাদা আলাদা সুগন্ধ, যে কাগজের উপর ছাপা হতো অক্ষরগুলো সেই কাগজেরও গন্ধ থাকত। বইয়ের গন্ধ সব সময় খুব কোমল আর অনন্য। একেকটা বইয়ের নিজস্ব গন্ধ একেক রকম। চোখ বন্ধ করেই জ্যাক বলে দিতে পারত, বইটা নেলসন সিরিজের কি না। তখনকার দিনে নেলসন সিরিজের বই প্রকাশ করত ফাসকেল। পড়া শুরু করার আগেই একেকটা বই জ্যাককে প্রতিশ্রুতিভরা জগতে টেনে নিয়ে যেত। ওই গন্ধে জ্যাক নিজের অবস্থানের ঘরটা পর্যন্ত ভুলে যেত। বাড়ির আশপাশের এলাকা, এলাকার হৈচৈ, খোদ শহরটা এবং বাস্তবের গোটা জগৎই তার বোধ থেকে মুছে যেত। বুনো অবাধ একটা বোধ নিয়ে পড়া শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সামনের জগৎটা বিলীন হয়ে যেত। জ্যাক নিজেই অন্যরূপের ভেতর প্রবেশ করত। বার বার তাকে ডাকা হতো, জ্যাক, তৃতীয় বারের মতো টেবিল ঠিক কর। তবু তার চেতনা ফিরত না। আরও ডাকাডাকির পর সে টেবিল সাজাত ঠিকই, তবে তার দৃষ্টি থাকত বইয়ের দিকে। মনে হতো, সে মাতাল অবস্থায় আছে। টেবিলের কাজ সেরে বইয়ের কাছে আবার ফিরে আসত। মনে হতো, সে পড়া ছেড়ে ওঠেইনি। তারপর তাকে বলা হতো, জ্যাক খেতে বসো। খেতে বসলে তার মনে হতো খাবারগুলো বইয়ের কথাগুলোর চেয়ে ভারী, তবে অবাস্তব। খাবার শেষ করে টেবিল পরিষ্কার করে আবার পড়ায় ফিরে যেত সে। কখনো কখনো মা তার নিজস্ব জায়গায় বসতে যাওয়ার আগে তার কাছে আসতেন। মা বলতেন, লাইব্রেরি থেকে আনা। অবশ্য লাইব্রেরি কথাটা মা ঠিকমতো উচ্চারণ করতে পারতেন না। তিনি শুধু তার ছেলের মুখে লাইব্রেরি কথাটা উচ্চারিত হতে শুনেছেন। তার কাছে কথাটার নিজস্ব কোনো অর্থ ছিল না। তবে তিনি বইয়ের মলাটের চেহারাটা ঠিক ঠিক চিনতেন এবং তার কথার সুরে জ্যাক মায়ের দিকে না তাকিয়েই বলে উঠত, হ্যাঁ। মা জ্যাকের কাঁধের উপর ঝুঁকে থাকতেন। মা লেখার লাইনগুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে বইয়ের গন্ধ নিতেন। কখনো কখনো তার লন্ড্রির কাজ করে ফোলা আঙুল বইয়ের পাতার উপর ছুঁইয়ে যেতেন যেন বুঝতে চেষ্টা করছেন, বই জিনিসটা আসলে কেমন, যেন ওই রহস্যময় চিহ্নগুলোর আরও কাছে আসতে চাইছেন, দেখতে চাইছেন ওই দুর্বোধ্য চিহ্নগুলো কীভাবে তার ছেলেকে বার বার টেনে নিয়ে যায়। তার বোধের বাইরের এক জগতে ছেলে কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিচ্ছে। সেখান থেকে ফেরার সময় তার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন তিনি অচেনা কেউ। মায়ের খসখসে আঙুলগুলো মাঝে মাঝে জ্যাকের মাথায় আদর বুলিয়ে যেত। মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তার নিজের জায়গায় গিয়ে বসতেন, জ্যাকের থেকে বেশ দূরে। নানি পর পর বেশ কয়েকবার আদেশ দিতেন, জ্যাক, ঘুমোতে যা। না হলে কাল সকালে দেরি হয়ে যাবে। জ্যাক উঠে দাঁড়িয়ে পরের দিনের ক্লাসের বইপত্র ব্যাগে গোছাতে শুরু করত; তবে বইটা তার বগলে ধরাই থাকত। বিছানায় মাতালের মতো ধপাস করে শুয়ে বইটা আস্তে করে পাশবালিশের নিচে চালান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত।
সুতরাং বেশ কয়েক বছর জ্যাকের অস্তিত্ব দুটো জগতের মাঝে অসমভাবে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। ওই জগৎ দুটো সে কোনোভাবেই এক করে মেলাতে পারেনি। দিনের প্রায় বারো ঘণ্টার জন্য তাকে থাকতে হতো যে জগতে সেখানে ছিল ঢোলের বাজনা, ছাত্র-শিক্ষকদের আনাগোনা, খেলাধুলা এবং পড়াশোনা। অন্যদিকে প্রাত্যহিক জীবনের দুতিন ঘণ্টা থাকতে হতো বাড়িতে, বাড়ির আশপাশের জগতে, মায়ের সান্নিধ্যে। অবশ্য শুধু গরিব মানুষের ঘুম ছাড়া আর কোনোভাবে মায়ের জগতের সঙ্গে সে নিজেকে মেলাতে পারেনি। যদিও বাড়ির আশপাশের জগৎ ছিল তার জীবনের প্রথমভাগের অংশ, তার বর্তমান এবং ভবিষ্যত ছিল লিসে। সুতরাং তার বাড়ির জগৎটা মিশে থাকত তার রাত, ঘুম এবং স্বপ্নের সঙ্গে। যে রাতে সে সিমেন্টের ওপর পড়ে গিয়েছিল তখনো কি মরুভূমির মতো হয়ে যাওয়া বাড়ির প্রতিবেশ তার সঙ্গেই ছিল?
লিসেতে কারও সঙ্গে কোনো অবস্থাতেই জ্যাক তার মায়ের কথা কিংবা বাড়ির কথা বলতে পারত না। অন্যদিকে লিসের কথা বাড়ির কারও সঙ্গে বলার মতো ছিল না। প্রবেশিকা পরীক্ষার পূর্বে তার কোনো বন্ধু কিংবা কোনো শিক্ষক তার বাড়িতে কখনো আসেননি। বছরে শুধু একবার, জুলাই মাসের শুরুতে পুরস্কার প্রদানের সময় ছাড়া তার নানি এবং মা কখনো লিসেতে যাননি। সেদিন তারা লিসের বিশাল দরজা দিয়ে প্রবেশ করতেন পুরোদস্তুর পোশাকে সজ্জিত সব পিতামাতা এবং ছাত্রদের ভিড়ের মধ্যে। কখনো বাইরে যাবার সময় নানি সাধারণত কালো পোশাক এবং মাথায় ওড়না পরিহিত অবস্থায় যেতেন। লিসেতে যাওয়ার সময়ও সেই পোশাকই পড়তেন। বাদামী জাল আর কালো মোমের তৈরি আঙুরশোভিত হ্যাট, বাদামী রঙের গ্রীষ্মকালীন পোশাক এবং তার একমাত্র উঁচুতলাঅলা জুতা জোড়া পরে যেতেন মা। খোলা গলার কলারঅলা হাফহাতা সাদা শার্ট আর ট্রাউজার পরে যেত জ্যাক। দুটোই আগের রাতে মা খুব যত্ন করে ইস্ত্রি করে রাখতেন। তাদের দুজনের মাঝে হাঁটতে হাঁটতে জ্যাক তাদের লাল ট্রলিবাসের দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেত। দুপুর একটার দিকে তারা যাত্রা করত। বাসের মধ্যে নানি এবং মাকে সিটে বসিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত জ্যাক। মাঝখানের কাঁচের দেয়াল ভেদ করে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকত সে। মা মাঝে মাঝে জ্যাকের দিকে তাকিয়ে হাসতেন। কিছুক্ষণ পর পরই মা তার হ্যাটের কৌণিক অবস্থা পরীক্ষা করে দেখতেন, তার ঢিলা মোজা জোড়া নিচের দিকে নেমে যায় কি না দেখতেন এবং তার গলায় পরা পাতলা একটা মালার সঙ্গে মেরি মাতার ছোট সোনার একটা মেডেল পরোখ করে দেখতেন। দু গভার্নমেন্টে থেকে রিউ বাব আজুন পর্যন্ত পথটুকু জ্যাক তাদের দুজনের সঙ্গে বছরে একবার পাড়ি দিত। মা সেদিন একটা লোশন ব্যবহার করতেন? জ্যাক মায়ের গায়ের লোশনের সুগন্ধ নিতে নিতে হাঁটত। নানি মাথা উচু করে গর্বভরা পদক্ষেপে এগিয়ে যেতেন। পায়ে ব্যথা লাগছে বলে মা কিছু বললে নানি তাকে বকুনি দিয়ে বলতেন, কষ্ট হলেও তার বয়সের তুলনায় ছোট জুতা পড়ার অভ্যাসটা হয়ে যাচ্ছে আপাতত। তখন জ্যাক আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে দুপাশের দোকানপাট এমনকি দোকানিদেরও দেখিয়ে দিত নানি এবং মাকে। বুঝাতে চাইত, তার জীবনে এইসব চাকচিক্য এসেছে তার লিসেতে পড়াশোনা করার কল্যাণে। লিসেতে পৌঁছে দেখতে পেত বিশাল দরজা খোলা। সিঁড়ির উপর থেকে একেবারে নিচ পর্যন্ত টবের গাছ দিয়ে সাজানো হয়েছে। যেসব ছাত্র প্রথম ভর্তি হয়েছে তাদের বাবা মায়েরা প্রথম বারের মতো ওই সিঁড়ি দিয়ে প্রবেশ করবেন। রকমারি পরিবার অনুষ্ঠান শুরুর অনেক আগে এসে উপস্থিত হতো। গরিব লোকেরা সব সময় এ রকম করেই থাকে। কারণ, তাদের সামাজিক দায়দায়িত্ব এবং আনন্দের সুযোগ খুব কমই থাকে। কাজেই যে অল্প সংখ্যক সুযোগ পাওয়া যায় সেখানে যেন অনিয়মানুবর্তিতার ঘটনা না ঘটে। ভেতরের উঠোনের মতো জায়গাটাতে ঢুকে তারা পুরনো ছাত্র এবং অভিভাবকদের জন্য নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে বসে পড়ত। সারি সারি সুসজ্জিত অনেক চেয়ার। চেয়ারগুলো ভাড়া করা হতো নাচ এবং গানের অনুষ্ঠানের আয়োজক একটা প্রতিষ্ঠান থেকে। ঊঠোনের অন্য প্রান্তে বিশাল ঘড়িটার নিচে উঁচু জায়গার সবটুকু ফাঁকা জায়গা ভরে থাকত সাধারণ চেয়ার এবং হাতলঅলা চেয়ারে। ওই জায়গাটাও জাকজমকপূর্ণভাবে সাজানো থাকত সবুজ গাছপালার টব দিয়ে। আস্তে আস্তে বসার পুরো জায়গাটাই ভরে উঠত। বিচিত্র রকমের হালকা রঙের পোশাক পরা মানুষ, তাদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা বেশি। যারা আগে আসত তারা গাছের ছায়ার নিচে জায়গা নিয়ে বসত। অন্যরা আরব দেশের তৈরি বিনুনি করা খড়ের সঙ্গে প্রান্তভাগে লাল পশমী সুতোর টাসেলঅলা পাখা দিয়ে নিজেদের বাতাস করত। শ্রোতাদের যারা রোদে বসতে বাধ্য হতো তাদের মাথার উপরের সূর্য নীলাকাশটা আরও বেশি নীল করে জমাট বাধিয়ে দিতে থাকত আর নিচের দর্শকরা ভাজা এবং সিদ্ধ হতে থাকত।
চলবে...
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>