ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৪৯
দ্য ফার্স্ট ম্যান
তবে সবচেয়ে আনন্দ হতো প্রবল বাতাসের দিনগুলোতে। পার্কমুখী দালানটা শেষ হয়েছিল এক সময়ের একটা উঁচু চত্বরের গায়ে। আগে হয়ত চত্বরের চারপাশে পাথরের রেলিং দেওয়া ছিল। এখন সেগুলো সিমেন্টের উপরে লাল টালি বিছানো পৈঠার সামনে ঘাসের মধ্যে পড়ে আছে। তিন দিক খোলা চত্বরে দাঁড়ালে পার্কসহ পার্কের বাইরেও দৃষ্টি চলে যেত। একটা গিরিখাত সাহেলের একটা সমতলভূমি থেকে কুবার পাহাড়ি অঞ্চলকে বিছিন্ন করেছে।
আলজিয়ার্সের পূবের হাওয়া সব সময়ই খুব প্রবলভাবে বয়ে যেত। সেই হাওয়া শুরু হলে চত্বরের উপর দিয়ে চাবুক মারতে মারতে চলে যেত। বাচ্চারা বাতাসের তোড়ে বড় বড় তালগাছের সঙ্গে বাড়ি খেত। তালগাছগুলোর চারপাশে ছড়ানো ছিটানো থাকত অনেক দিনের শুকনো তালগাছের বড় বড় ডাল। তারা ডালের গায়ের কাঁটাগুলো কেটে মসৃণ করে রাখত যাতে দুহাতে ধরে রাখতে পারে। তারপর নিজেদের পেছনে ডালগুলো ধরে বাতাসের তোড়ে চত্বরের দিকে এগিয়ে যেত। প্রবল বাতাস ইউক্যালিপটাস গাছের উঁচু ডালে বাড়ি মারত আর শোঁ শোঁ শব্দ তৈরি হত। বাতাস তালগাছগুলোর মাথা এলোমেলো করে দিত এবং রাবার গাছের ডালে প্রবল বেগে বাড়ি মারলে মচমচ শব্দ তৈরি হত। তালগাছের ডালগুলো উঁচু করে বাতাসের ধাক্কায় চত্বরে উঠে আসার খেলার একটা বুদ্ধি কাজে লাগাত তারা। বাতাসের ধাক্কায় ডালগুলো পেছন থেকে তাদের গায়ের সঙ্গে লেগে যেত। খুব কাছে থেকে তারা শুকনো ডালগুলোর গায়ে নাক লাগিয়ে ধুলি আর শুকনো পাতার গন্ধ নিত। ডালগুলো উঁচু করে ধরে বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কে কতক্ষণ টিকে থাকতে পারে সেই চেষ্টা করত। যে সবার আগে হাতে ধরা ডালটা নিয়ে চত্বরে পৌঁছতে পারত সে হত বিজয়ী। তারপর সে ওখানে দাঁড়িয়ে ডালটা উঁচু করে ধরে প্রবল বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে যেত। পার্কের ধারে, গাছপালা বোঝাই সমতলভূমির সামনে এবং দ্রুত ধাবমান মেঘভরা আকাশের নিচে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে, জ্যাক সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করত দূর থেকে বয়ে আসা বাতাস। উপরের দিক থেকে বাতাস নেমে এসে গাছপালার ডালগুলোকে বাড়ি মারত আর জ্যাকের শরীরে বাতাসের ছোঁয়ায় প্রবল শক্তি তৈরি হত। আনন্দে অবিরাম চিৎকার করতে থাকত সে। এক সময় বাতাসের কাছে হার মেনে হাতে ধরা ডালটা সে ছেড়ে দিত। বাতাস ডালটাসহ তার চিৎকারকে দ্রুত উড়িয়ে নিয়ে যেত। বিকেল বেলা এরকম খেলা থেকে ফিরে রাতে যখন হালকা ঘুমন্ত মায়ের বিছানার পাশের বিছানায় ক্লান্তশ্রান্ত হয়ে শুয়ে চুপচাপ পড়ে থাকত তখনও যেন সে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ শুনতে পেত। মনে হত, আজীবন সেই অনুভূতি বয়ে বেড়াবে মনের কোণে।
বৃহস্পতিবারে জ্যাক এবং পিয়েরে পাবলিক লাইব্রেরিতেও যেত। হাতের কাছে যেকোনো ধরনের বই পেলেই জ্যাক গোগ্রাসে গেলার মতো করে পড়ে ফেলত। বেঁচে থাকার জন্য, খেলাধুলার জন্য এবং স্বপ্ন দেখার জন্য যে রকম ক্ষুধা ছিল তার মনে সে রকম ক্ষুধা নিয়েই বইপত্র হজম করত সে। তবে পড়াশোনার কারণে সে একটা নিষ্পাপ জগতে প্রবেশ করতে পারত। সে জগতে দারিদ্র এবং ধন-সম্পদ একই রকমের আন্দদায়ক ছিল। কারণ দুটোই ছিল চরমভাবে কাল্পনিক। লা ইন্ট্রেপিডে ছিল ছবিতে ভরা কাহিনীর সিরিজ। তারা সব বন্ধু ওই বইটা একজনের পড়া হয়ে গেলে তার হাত থেকে নিয়ে আরেকজন পড়ত। এভাবে পড়তে পড়তে তারা বইটার মলাটের বাঁধাই ক্ষয় করে ধূসর বানিয়ে ফেলে। পৃষ্ঠার কোণাগুলো ভাঁজ হয়ে ছিঁড়ে যায়। ওই বইটাই তাকে কমেডি কিংবা বীরত্বপূর্ণ জগতে নিয়ে যায়। সেখানেই তার আনন্দ এবং সাহসের পরিতৃপ্তি খুঁজে পায়। তারা গোয়েন্দা কাহিনীগুলো যেভাবে হজম করতে পেরেছিল এবং পারদাইলানের চরিত্রগুলোকে যেভাবে বাস্তবের প্রাত্যহিক জগতের মাঝে স্থাপন করেছিল তাতে সহজেই বলা যায়, তাদের দুজনের মধ্যেই বীরত্ব এবং বড়াইয়ের ভাব খুব প্রবল ছিল। তাদের প্রিয় লেখক ছিলেন মিশেল জেভাকো এবং তাদের প্রিয় জগৎ ছিল রেনেসাঁর সময়ের জগৎ, বিশেষ করে ইতালির। রোম কিংবা ফ্লোরেন্সের রাজপ্রাসাদের কিংবা পোপের জৌলুসপূর্ণ সময়ের পটভূমিতে লিখিত তরবারির এবং বিষের ব্যবহার থাকত ওইসব কাহিনীতে। তারা নিজেদের ওই চরিত্রদের মতোই অভিজাত মনে করত। ধূলিভরা যে রাস্তার কাছে পিয়েরে থাকত সে রাস্তায় প্রায়ই তাদের দুজনকে দেখা যেত একজন আরেকজনের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে কিংবা উচ্চ বেগে ময়লার ঝুড়িগুলোর মাঝে দ্বন্দ্বযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। তাদের আঙুলে দীর্ঘস্থায়ী দাগ পড়ে যেত। অন্য কোনো ধরনের বই তাদের আয়ত্বে ছিল না বললেই চলে। কারণ আশপাশের লোকেরা পড়াশোনার অভ্যাসের মধ্যেই ছিল না। যাদের পড়ার অভ্যাস ছিল তারাও নিজেরা বই কিনতে পারত না বললেই চলে। কালে ভদ্রে যদি কিনেই থাকত তাহলে দোকানে পড়ে থাকা সস্তা পুরনো বই ছাড়া অন্য কোনো ধরনের বই কিনতে পারত না।
তবে তারা যখন লিসেতে পড়াশোনা শুরু করে সে সময়েই তাদের এলাকায় একটা পাবলিক লাইব্রেরি চালু হয়। আলজিয়ার্সে দ্রুত বাড়তে পারে এমন সুবাসওয়ালা বৃক্ষ-ঘেরা বাড়িগুলোর অপেক্ষাকৃত অভিজাত এলাকার শুরু এবং জ্যাকের বাড়ির মাঝখানের রাস্তায় ওই লাইব্রেরিটা তৈরি হয়েছিল। সেইন্টে ওডিলে নামের একটা ধমীয় বোর্ডিং স্কুলের চারপাশে ছিল উদ্যানসোভিত ওইসব বাড়ি। ওই স্কুলটাতে শুধু মেয়েদের ভর্তি করা হত। ওই এলাকাটা তাদের বাড়ি থেকে খুব কাছে হলেও তাদের জন্য দূরের ছিল এবং ওখানেই তাদের গভীর আবেগের অভিজ্ঞতা লাভ হয়। তাদের এলাকাটা ছিল ধূলিময়, গাছপালাহীন। ফাঁকা জায়গা বলতে যা ছিল তার সবখানিই খরচ হয়ে গিয়েছিল মানুষ আর বসত বাড়ির দখলে। অন্য দিকে পাশের এলাকাটা গাছপালা আর ফলমুলের বিলাসবহুল সমারোহে ভরা। ওই দুই জগতের মাঝে বিভাজন হিসেবে ছিল প্রশস্ত প্রধান সড়ক এবং তার দুপাশে রোপিত বড় বড় গাছপালা। বিভাজনরেখার এক পাশে সারি সারি উদ্যানশোভিত বাড়ি। অন্য পাশে কম খরচে তৈরি বাড়িঘর। পাবলিক লাইব্রেরিটা ছিল ওই দুই এলাকার সীমান্তে অবস্থিত।
লাইব্রেরিটা বৃহস্পতিবারসহ সপ্তাহে তিন বার খোলা থাকত, কাজের শেষে সন্ধ্যায় এবং সকালে। অনাকর্ষণীয় চেহারার একজন শিক্ষক সপ্তাহে কয়েক ঘণ্টা স্বেচ্ছায় উপস্থিত থেকে কাজ করতেন। কাঠের একটা সাদা লম্বা টেবিলে বসে তিনি বই ধার দেওয়া ফেরত নেওয়ার কাজ করতেন। লাইব্রেরি ঘরটা বর্গাকার এবং এর দেয়াল সাদা তাক আর কালো মলাটে বাঁধানো বইয়ে পরিপূর্ণ। চারপাশে কয়েকটা চেয়ারওয়ালা একটা ছোট টেবিলও ছিল। যাদের খুব দ্রুত কোনো অভিধানের দরকার হত তাদের জন্য ছিল ওই টেবিলটা। কারণ লাইব্রেরিটা মূলত বই ধার দিত পাঠকদের। বর্ণনাক্রমিক কার্ডের একটা ক্যাটালগও ছিল। তবে জ্যাক এবং পিয়েরে কেউই সে ক্যাটালগের ভেতর কোনো দিন দৃষ্টি ফেলে দেখেনি। তাদের কাজ ছিল বইয়ের নাম দেখে কিংবা মাঝে মধ্যে লেখকের নাম দেখে তাকময় বই খুঁজে বেড়ানো। কাঙ্ক্ষিত বইটা পেয়ে গেলে একটা নীল চিরকুটে সেটার নাম লিখে জমা দিত ধার নেওয়ার জন্য। একটা রশিদ আর সামান্য অর্থের বিনিময়ে বই ধার নেওয়ার মতো সদস্য হওয়া যেত। ভাঁজ করা একটা মোটা কাগজে ধার নেওয়া বইটার নাম লেখা হত। আর দায়িত্বরত ওই শিক্ষকের কাছে একটা খাতা থাকত; সেখানেও বইটার নাম লেখা হত।
লাইব্রেরির বইগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ ছিল উপন্যাস। তবে অনেকগুলো বই আলাদা করা ছিল এবং সেগুলো পনের বছরের নিচের বয়সীদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ। আর পিয়েরে এবং জ্যাকের সজ্ঞামূলক পদ্ধতিতে যে বইগুলো পড়া বাদ ছিল সেগুলোর মধ্যে কোনো বাছাবাছির ব্যাপার ছিল না। তবে সংস্কৃতির ক্ষেত্রে হাতের কাছে কোনো কিছু পেয়ে যাওয়াটা সবচেয়ে খারাপ কোনো পদ্ধতি নয় এবং তাদের দুজনের মতো গোগ্রাসী পাঠক বাছবিচারহীন পড়ার কারণে সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে খারাপ উভয়কেই গলাধকরণ করেছে। পড়ার পরে সুস্পষ্টভাবে কোনো কিছু মনে আছে কি না সে বিষয়েও তাদের খেয়াল থাকেনি। তবে কোনো শক্তিশালী এবং অদ্ভূত আবেগ সপ্তাহ, মাস এবং বছরব্যাপী তাদের সঙ্গে সঙ্গে থেকেছে এবং স্মৃতি ও গোটা চিত্রকল্পের জগৎ তৈরি করেছে ও লালন করেছে। ওই স্মৃতি এবং চিত্রকল্পগুলো তাদের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতার কাছে হার মানেনি কখনও। আর তাদের বাস্তব জীবনও তাদের কাছে কম সন্নিকটস্থ ছিল না। তাদের স্বপ্ন যাপনের মধ্যে যতখানি প্রচণ্ডতা ছিল জীবনযাপনের মধ্যেও তার চেয়ে কম প্রচণ্ডতা ছিল না।
আসলে বইগুলোর মধ্যে উপস্থাপিত কথাগুলো তাদের কাছে বড় ছিল না। লাইব্রেরিতে প্রবেশ করেই তারা কালো মলাটের বই দেখতে পেত— তা নয়, লাইব্রেরির দরজা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নতুন নতুন অদ্ভূত সব জগৎ এবং বহুবিধ দিগন্ত খুলে যেত তাদের সামনে। চিরচেনা ভীড়ভাট্টার জগৎ ছেড়ে তারা চলে যেত অন্যখানে। তাদের কাছে বড় ছিল ওইসব জগৎ আর দিগন্ত। তারপর তাদের দুজনের জন্য দুটো বই বরাদ্দ হয়ে গেলে নিঃশব্দ পায়ে তারা নেমে আসত আসন্ন সন্ধ্যার হালকা আঁধার ঢাকা বিথিকার নিচে। ঘন ডালপালাঅলা গাছের নিচে পড়ে থাকা পাকা ফল বেখেয়ালে পায়ের তলায় পিষে ফেলে তারা হিসাব কষতে কষতে যেত কতটা আনন্দ পাবে নতুন বই থেকে। আগের সপ্তাহের বইয়ের সঙ্গেও তুলনা চলত মূল রাস্তায় ওঠা পর্যন্ত। রাস্তার আলো জ্বলে উঠলে সেই আলোর অনিশ্চয়তার মধ্যেই তারা নিজ নিজ বই খুলত। দু-একটা টুকরো কথা দেখতে পেত— যেমন, ‘অমুকের শক্তি ছিল অসাধারণ,’ ইত্যাদি। তাতেই তাদের আনন্দময় বিশাল আশা আরও সুবিস্তৃত হয়ে ছড়িয়ে পড়ত। খুব তাড়াতাড়িই একজন আরেকজনের কাছ থেকে নিজ নিজ বাড়িতে ঢুকে পড়ত। জ্যাক খাবার ঘরের টেবিলের উপরের বাতির নিচে পৌঁছেই বই খুলে ফেলত। বাঁধাইয়ের শুকনো আঠার একটা কড়া গন্ধ নাকে লাগত। অমসৃণ বাধাইয়ের খসখসে ছোঁয়াও লাগত হাতে।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/