ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব-৪১
দ্য ফার্স্ট ম্যান
সে বছর অক্টোবরের ১ তারিখে নতুন মোটা জুতা পরে টলোমলো পায়ে, খসখসে নতুন জামা পরে, বার্নিস আর চামড়ার গন্ধভরা ভারী ব্যাগ কাঁধে নুয়ে পড়ে যখন জ্যাক সামনে তাকাল দেখতে পেল, তার সামনে পিয়েরে এবং পিয়েরের সামনে বাঁকানো পিঠের চালক প্রথম গিয়ারের পাশে বসছে। ভারী মোটরযানটা বেলকোর্ট স্টপেজ পার হয়ে যাচ্ছে।
জ্যাক পেছনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে। তখন তার মা আর নানি কয়েক মিটার দূরে জানালার সঙ্গে হেলান দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। রহস্যময় ওই লিসের দিকে প্রথম যাত্রার সময় তাকে আরেকটু সঙ্গ দেওয়ার চেষ্টা করছেন তারা। কিন্তু জ্যাক তাদের ভালো করে দেখতে পেল না। কারণ তার সামনের লোকটা লা দিপিসে আলজিরিয়েনে পত্রিকার ভেতরের পাতা পড়ায় ব্যস্ত। সুতরাং সে সামনের দিকে ঘুরে দেখতে পেল, স্টিলের রেইলগুলো দৃষ্টির আড়ালে চলে যাচ্ছে, সেগুলোর উপরের ট্রলির তারগুলো সকালের ঠাণ্ডা হাওয়ার কাঁপছে।
বাড়ির দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে জ্যাক অনুভব করল, তার হৃদয়টা কেমন থমথমে হয়ে আছে। নিজের পাড়ার এই এলাকাটা ছেড়ে কখনও দূরে কোথাও যায়নি সে। বড়জোর শহরতলিতে গেলেও তারা বলত আলজিয়ার্সে যাচ্ছে। পিয়েরের ভ্রাতৃসুলভ কাঁধটা তার কাঁধের সঙ্গে লেগে আছে। তবু মনের আশঙ্কা দূর হচ্ছে না। নতুন জগত সম্পর্কে একাকীত্ব আর অস্বস্তির বোধটা লেগে আছে। নতুন জায়গায় কার সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে জানা নেই তার।
আসলে উপদেশ দেওয়ার মতো কেউ তাদের ছিলও না। পিয়েরে এবং সে খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারে, এখন তাদের নিজের মতো চলতে শিখতে হবে। এম বার্নার্ডকে জিজ্ঞেস করার মতো সাহসও তাদের হয়নি। কারণ লিসে সম্পর্কে তার নিজের কোনো কিছু জানা না থাকার কারণে তিনিও কিছু বলতে পারতেন না। আর বাড়িতে সবার মধ্যে অজ্ঞতার তো কোনো শেষ নেই।
জ্যাকের পরিবারের সবার কাছে ল্যাটিন বলে যে শব্দটা আছে তার কোনো অর্থই নেই। তাদের কাছে কল্পনায় প্রাচীনকাল বলতে যা বোঝায় সেটাই শুধু পরিষ্কার। কারণ তাদের মধ্যে কেউ ফরাসি ভাষাও বলতে পারে না। তাদের কাছে সভ্যতা কথাটারও কোনো অর্থ নেই। ভাষা আর আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে সভ্যতার ভেতরের মানুষরা একে অন্যের সঙ্গে এগিয়েছে সেরকম কোনো সত্য তাদের কাছে পৌঁছেনি। দৈনন্দিন কথাবার্তার মধ্য দিয়ে অর্জিত কোনো চিত্রকল্প, লিখিত কোনো জিনিস, মুখের কোনো কথা কিংবা সংস্কৃতির কোনো প্রলেপ— কোনোটাই তাদের কাছে পৌঁছেনি। বড় হয়ে জ্যাক কিনে নিয়ে আসার আগ পর্যন্ত তাদের বাড়িতে কোনো খবরের কাগজ আসত না। কোনো বইপত্র ছিল না। রেডিও ছিল না। সরাসরি কাজে লাগে এমন জিনিস ছাড়া আর কিছুই ছিল না তাদের বাড়িতে। নিকট আত্মীয়রা ছাড়া আর কেউ তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসত না। তাদের পর্যায়ের নিকট আত্মীয় ছাড়া তারাও অন্য কোথাও বেড়াতে যেত না। লিসে থেকে জ্যাক কিছু নিয়ে এলে বাড়ির অন্যরা সেটার কোনো অর্থ বুঝতে পারত না। সুতরাং সবার সঙ্গে তার দূরত্বও বাড়তে থাকে। লিসেতেও জ্যাক তার পরিবার সম্পর্কে কিছু বলতে পারত না। পরিবারের অদ্ভূত বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে মুখে কিছু না বলতে পারলেও সে ভেতরে ভেতরে ঠিকই বুঝতে পারত। এমন কি ওই দুর্লঙ্ঘ স্বল্পভাষিতাকে জয় করতে পারলেও পরিবারের বিষয়ে তার ঠোঁট যেন আটকা পড়েই থাকত।
যে জিনিসটা তাদের অন্যদের থেকে আলাদা করে রেখেছিল সেটা আসলে শ্রেণিগত পার্থক্য নয়। কল্পনা, দ্রুত সম্পদলাভ এবং নয়নাভিরাম পতনের এই দেশে শ্রেণিবৈষম্য ততটা সুস্পষ্ট ছিল না যতটা ছিল জাতিবৈষম্য। তাদের মধ্যে যারা আরবদের সন্তান তাদের অনুভূতি ছিল অন্যদের চেয়ে বেশি তিক্ত এবং বেদনাদায়ক। যদিও তাদের ক্লাসের বন্ধুদের অনেকেই আরব বংশোদ্ভূত ছিল লিসেতে তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। আর লিসেতে যারা আরব বংশের ছিল তারা প্রায় সবাই ছিল ধনী এবং নামকরা পরিবারের। ওখানে পিয়েরের অবস্থান থেকে জ্যাকের অবস্থানও আলাদা ছিল। কারণ তাদের পরিবারের অদ্ভূত পরিচিতি আরও বেশি প্রকট ছিল। প্রচলিত মূল্যবোধ আর গতানুগতিকতার সঙ্গে তার পরিবারকে মেলানো তার পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল। বছরের শুরুতে যে সব প্রশ্নের জবাব দিতে হতো সেগুলোর উত্তরে সে অবশ্য বলতে সক্ষম হয়েছিল, তার বাবা যুদ্ধে মারা গেছেন। সমাজে সেটা অবশ্য একটা মর্যাদার ব্যাপারই ছিল এবং সে সবাইকে বুঝিয়ে দিতে পারত, সে আসলে জাতির ছাত্র। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় আরও পরে। ছাপার একটা ফরম পুরণ করতে দেওয়া হয় তাদের। সেখানে একটা জায়গায় পিতামাতার পেশা বলে একটা জায়গা পূরণ করতে গিয়ে কী লিখবে বুঝতে পারে না জ্যাক। মায়ের পেশা উল্লেখ করতে গিয়ে প্রথমে জ্যাক লিখল ‘গৃহিনী’। আর পিয়েরে লিখল ‘পোস্ট অফিসের কর্মচারী’। পিয়েরে বুঝিয়ে বলল, গৃহিনী কোনো পেশার নাম হয় না; এতে বুঝায় তিনি নিজের বাড়িঘর দেখা শোনা করেন এবং নিজের বাড়ির কাজ করেন।
জ্যাক বলল, না। মা তো অন্য লোকের বাড়ির কাজ করেন, বিশেষ করে রাস্তার ওপারের দোকানদারের বাড়ির কাজ।
কিছুটা দ্বিধা নিয়ে পিয়েরে বলল, ঠিক আছে; তাহলে লিখতে পারো ‘গৃহকর্মী’।
এই কথাটা জ্যাকের মনেই আসেনি কখনও। কারণ তাদের বাড়িতে এই বিরল শব্দটা ব্যবহার করা হয়নি। কাজেই বাড়ির কারো মনেই হয়নি, তার মা অন্য লোকের বাড়িতে কাজ করছেন। তাদের মনে হয়েছে, তিনি প্রথমত তার সন্তানদের জন্য কাজ করছেন। জ্যাক প্রথমে ওই শব্দটাই লিখতে শুরু করল, তারপর থেমে গেল। হঠাৎ করেই লজ্জা কাকে বলে উপলব্ধি করতে পারল। লজ্জিত হওয়ার লজ্জা অনুভব করল জ্যাক।
কোনো শিশু তার নিজের পরিচয়ে পরিচিত নয়। তার বাবা মায়ের পরিচয়ে পরিচিত। তাদের মাধ্যমেই সে পৃথিবীর কাছে সংজ্ঞায়িত হয়ে থাকে। জ্যাকের মনে হতে থাকে, বাবা মায়ের মাধ্যমেই তার সত্যিকারের মূল্যায়ন হয়ে থাকে। এরকম মূল্যায়ন বিচারের মতো মনে হয়। সে বিচারের রায়ের বিরুদ্ধে কোনো রকম আবেদন করার সুযোগ থাকে না। চারপাশের জগত এরকম বিচার করতে পারে— এই প্রথম সে জানতে পারে। এই আবিষ্কারের পর তার মনে হতে থাকে, তার নিজের বিচারের সঙ্গে বাইরের জগতের এই বিচারের সাংঘর্ষিক একটা দ্বন্দ্ব রয়েছে। সে জানতে পারেনি, বড় হয়ে যাওয়ার পরে কেউ যদি এই অশুভ অনুভূতি চিনতে না পারে তাহলে তার দোষের কিছু থাকে না। কারণ বড় হয়ে যাওয়ার পরে পরিবারই তখন তার পরিচয়ে পরিচিত হয়ে থাকে।
কিন্তু জ্যাক ইতোমধ্যে যে সত্য আবিষ্কার করেছে সেটার কষ্ট থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে পবিত্রতার দিক থেকে বিরল এবং বীরত্বপূর্ণ একটা হৃদয় থাকা চাই। তার নিজের স্বভাব সম্পর্কে তার দুর্ভোগ তার কাছে যে সত্য আবিষ্কার করে ফেলেছে সে সত্যের প্রতি লজ্জা এবং ক্ষোভ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাতে যাওয়াটাই তার জন্য অসম্ভব রকমের এক অপমানের ব্যাপার হয়ে যাবে। এরকম কোনো গুণ তার মধ্যে নেই। বরং তার মধ্যে আছে একটা কঠিন এবং নিম্নস্তরের একগুঁয়েমি। তার ফলে সে ওই ফরমে মায়ের পেশা সম্পর্কে গৃহকর্মী কথাটা কঠিন হাতে লিখতে পারে এবং মনিটরের কাছে নিয়ে যেতে পারে। তবে তিনি জ্যাকের ফরমটার দিকে নজর দিয়েও দেখলেন না। এরকম পরিস্থিতিতে জ্যাকের একটুও মনে হয়নি, তার পরিবারের কিংবা তার নিজের জীবনের কোনো অবস্থা অন্য রকম হলে ভালো হতো। বরং তার মায়ের অবস্থান যেমন আছে তেমনটিই তার সবচেয়ে প্রিয়। জগৎজুড়ে আর কোনো কিছুই তার মায়ের প্রতি ভালোবাসার সমকক্ষ হতে পারে না। হোক না মায়ের প্রতি তার ভালোবাসায় অনেক হতাশা আছে, তাতে কী। তাছাড়া, কোনো শিশু ঈর্ষান্বিত না হয়ে মাঝে মধ্যে লজ্জিত বোধ করতে পারে—সে কথা কী করেই বা পরিষ্কার করে বোঝানো যায়?
চলবে…
আগের পর্বগুলো..