ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৫৪
দ্য ফার্স্ট ম্যান
কিন্তু জ্যাকের অফিসের কাজের উৎস এবং গন্তব্য দুটোই অলীক মনে হয়েছে তার কাছে। বেচা আর কেনা সবকিছু এই অতি সাধারণ, তুচ্ছ কাজে এসে ঠেকেছে।
অফিসের কাজ করার পূর্ব পর্যন্ত সে দারিদ্রের মধ্যে বসবাস করলেও অফিসের কাজ করতে গিয়ে জ্যাক আবিষ্কার করল তুচ্ছ জাগতিকতা কাকে বলে। আলোর দেখা পাওয়ার জন্য তার কান্না ঝরতে থাকে। যে অনুভূতির কারণে জ্যাক নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছিল তার জন্য তার সহকর্মীরা দায়ী ছিল তা নয়। তারা জ্যাকের প্রতি সদয়ই ছিল। তারা কখনো কোনো কাজ করার জন্য কড়া আদেশ দেয়নি। এমনকি কড়া চেহারার রাসলিন বেগমও তার দিকে মাঝে মধ্যে হাসি মুখে তাকিয়েছে। সহকর্মীদের মধ্যে কথাবার্তাই হতো খুব কম। তার মধ্যেও আলজেরিয়াবাসীদের স্বভাবগত হাসিখুশি ভাবটা ছিল। অফিসে অন্য সবাই আসার পনেরো মিনিটের মতো পরে আসতেন ম্যানেজার। কোনো কাজের আদেশ দেওয়ার জন্য কিংবা কোনো চালান পরীক্ষা করে দেখার জন্য তিনি তার রুম থেকে সহকর্মীদের রুমে আসতেন। বিশেষ জরুরি প্রয়োজনে তিনি বয়স্ক হিসাবরক্ষক কিংবা তার রুমের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারীকে ডেকে পাঠাতেন। সেসব সময়ে তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেত। মনে হতো, কর্তৃপক্ষীয় আদেশ পালন ছাড়া তাদের কোনো কিছুই প্রকাশ করার নেই। প্রধান হিসাবরক্ষক ছিলেন সৌজন্যহীন এবং স্বাধীনচেতা। রাসলিন বেগম কঠোর দিবাস্বপ্নে বিভোর। সহকারী হিসাবরক্ষক লোকটার স্বাধীনতা বোধ বলতে কিছু ছিল না। দিনের বাকি সময়টা তারা তাদের নিজ নিজ খোলসে ঢুকে কাটাতেন। জ্যাক তার নিজের চেয়ারে বসে অপেক্ষা করত কখন তার কাজের আদেশ আসে। তখন তাকে তড়িঘড়ি করে কিছু কাজ করতে হতো যেগুলোর কোনো মূল্য আছে বলে মনে হতো না তার। আর নানি ওই সব অকাট্য বাজে জিনিসগুলোকেই কাজ বলতেন।
যখন ওই পরিবেশ একদম অসহ্য মনে হতো, যখন চেয়ারে বসে অধৈর্যের যন্ত্রণায় ফুটতে থাকত, তখন জ্যাক চেয়ার থেকে উঠে দোকানের পেছনে উঠোনে নেমে যেত। সেখানকার সিমেন্টের দেয়ালের আড়ালে স্বল্পালোকিত তুর্কি টয়লেটে ঢুকে পড়ে লুকিয়ে থাকত কিছুক্ষণ। নাকে সর্বগ্রাসী মূত্রের গন্ধ লাগত। আবছা অন্ধকারে পরিচিত দুর্গন্ধের মধ্যে চোখ বন্ধ করে স্বপ্নের জগতে চলে যেত জ্যাক। ধরাছোঁয়া যায় না এমন কিছু কিংবা কতিপয় অযৌক্তিক বিষয় জেগে উঠত মনের ভেতর। তার রক্তের ভেতর, তার প্রবৃত্তির ভেতর কোনো কোনো দৃশ্য জীবন্ত হয়ে দেখা দিত। রাসলিন বেগমের পা দেখার দৃশ্যটা সেরকমই একটা। সেদিন রাসলিন বেগমের টেবিলের সামনে একটা পিনের বাক্স তার পায়ের ধাক্কায় পড়ে গেলে পিনগুলো তোলার জন্য জ্যাক নিচু হয়েছিল। বসা অবস্থায় চোখ তুলে টেবিলের তলায় তাকিয়ে রাসলিনের খোলা হাটু আর উন্মুক্ত উরুর উপরে স্কাটের্র তলায় ফিতা দিয়ে বাধা অন্তর্বাস দেখে ফেলেছিল জ্যাক। কোনো নারী স্কার্টের নিচে কী পরিধান করে জ্যাক তার আগে কখনো দেখেনি। হঠাৎ দেখা দৃশ্যে জ্যাকের মুখের ভেতরের লালা শুকিয়ে যায়। সমস্ত শরীর ভয়ঙ্কর রকমের কাঁপতে থাকে। অভিজ্ঞতার অনেক রহস্য অনুন্মোচিত ছিল তার কাছে। তেমনি একটা রহস্য তার কাছে তখন উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছিল।
দুপুরে একবার, ছটার সময় একবার, দিনে দুবার ট্রলি বাস ধরার জন্য জ্যাককে ঢালু রাস্তায় দৌড়ে বের হতে হত। যাত্রীদের ভিড়ের মধ্যে অপেক্ষমান ট্রলিবাসে উঠতে হত। বাসের দাঁড়িয়ে থাকাটা বেশিক্ষণ পাওয়া যেত না। আস্তে আস্তে চলা শুরু করলে চলন্ত বাসের পাদানিতে ভর করে লাফ দিয়ে উঠে পড়তে হত। বিভিন্ন জায়গার কাজ থেকে তাদের পাড়ার দিকে শ্রমিকরা রওনা হত ট্রলিবাসে উঠে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যে একে অন্যে গা ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকত সবাই। ছোট বড় সবার দৃষ্টি মনের ভেতরে ভেসে ওঠা বাড়ির দিকে। বাড়ি তাদের ডাকছে। নীরবে দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে প্রাণহীন চাকরি আর কষ্টকর ট্রলিবাসের যাত্রার মধ্যে বিভক্ত হয়ে চলত জ্যাকের তখনকার অস্তিত্ব। সবশেষে বাড়ি ফিরে যেন হঠাৎ ঘুম পেয়ে বসত। কোনো কোনো সন্ধ্যায় ওই জীবনের ভাবনা জ্যাককে বিষণ্ন করে ফেলত। চাকরির আগে সে শুধু বিত্ত আর দারিদ্রের আনন্দের কথাই জানত। আর এখন তাকে তাপ, একঘেয়েমি আর ক্লান্তির অভিশাপ দেখতে হচ্ছে। কাজের ধরন এমনই বেকুবমার্কা যে, জ্যাকের মতো কর্মীকে মাঝে মাঝে কাঁদিয়ে দিতে পারত। শেষ না হওয়ার মতো একঘেয়ে কাজ কর্মদিবসকে করে দিত দীর্ঘতর, জীবনকে করত সংক্ষিপ্ত।
জাহাজের দালালের ওখানে কাজ করার সময় গ্রীষ্মকালটা তুলনামূলক আরামদায়ক ছিল। কারণ অফিসের মুখেই ছিল প্রধান সড়ক ফ্রন্ট-ডে-মের। আর বিশেষ কারণ হলো, তাকে বেশিরভাগ সময় কাজ করতে হতো বন্দরে। আলজিয়ার্সের বন্দরে আসা সব জাহাজে উঠে যেতে হত জ্যাককে। কোঁকড়া চুলের গোলাপী চেহারার সুদর্শন দালাল লোকটা বিভিন্ন সরকারি অফিসের হয়ে কাজ করতেন। জ্যাক জাহাজগুলোর কাগজপত্র অফিসে নিয়ে আসত। অফিসে সেসব কাগজপত্র অনুবাদ করা হত। এক সপ্তাহ পর সে নিজেও সরবরাহ এবং বিভিন্ন মালের তালিকার অনুবাদের কাজে লেগে গেল। সবগুলো ইংরেজিতে লেখা হয়ে গেলে শুল্ক কর্তৃপক্ষ কিংবা ওইসব জাহাজের পণ্যের আমদানীকারক প্রতিষ্ঠানের ঠিকানায় পাঠিনো হত। সুতরাং জ্যাককে প্রায়ই আঘা বাণিজ্যিক বন্দরে যেতে হতো কাগজপত্র আনার জন্য। গ্রীষ্মের খরতাপ পুড়িয়ে ছারখার করে দিত বন্দরের দিকে নেমে যাওয়া রাস্তাগুলো। রাস্তার ধারে পেটা লোহার তৈরি হাতলগুলো এমন গরম থাকত যে, হাত দিলে হাত পুড়ে যেত। শুধু নোঙর করা জাহাজের পাশ ছাড়া জাহাজ থেকে নামার বিশাল কাঠামোর ওপরে তাপ এক ধরনের শূন্যতা তৈরি করত। সেখানে খালাসিরা ব্যতিব্যস্ত থাকত সিমেন্ট কিংবা কয়লার বস্তা অথবা চোখা কোণার প্যাকেট নামানোর কাজে। খালাসিদের পরনে থাকত নীল রঙের পায়ের গুল পর্যন্ত গোটানো পাজামা। সারা কবন্ধ খালি। মাথায় থাকত তোয়ালে ধরনের এক খণ্ড কাপড়; সেটা তাদের পিঠ থেকে কোমর পর্যন্ত ঢেকে রাখত। জাহাজের পাটাতন থেকে নামার কাঠামো পর্যন্ত ঢালু হয়ে নেমে আসা তক্তার সিঁড়ির ওপর দিয়ে তারা ওঠা নামা করত কিংবা সরাসরি জাহাজের খোলের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ত। সেখান থেকে নামার কাঠামো পর্যন্ত পথে অবিরত চলাচল করত। জাহাজের পাটাতন আর নামার কাঠামোর তাপদগ্ধ ধূলি এবং রোদের গন্ধ ছাড়াও জ্যাক প্রতিটা জাহাজের আলাদা আলাদা গন্ধ চিনতে পারত। নরওয়ের জাহাজগুলো থেকে কাঠের গন্ধ পেত; ডাকার কিংবা ব্রাজিল থেকে আসা জাহাজ থেকে পাওয়া যেত কফি এবং মসলার গন্ধ; জার্মান জাহাজ থেকে আসত তেলের গন্ধ। আর ইংরেজ জাহাজগুলো থেকে পেত লোহার গন্ধ। তক্তার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গিয়ে কোনো নাবিককে জ্যাক তার দালালের কার্ড দেখাত। নাবিকরা সাধারণত কার্ডের লেখা বুঝতে পারত না। তারপর মাঝখানের পথ দিয়ে কোনো অফিসার কিংবা ক্যাপ্টেনের রুম পর্যন্ত যেত। মাঝখানের পথটায় ছায়া থাকলেও সেখানেও প্রচণ্ড তাপ অনুভব করত সে। পথের দুপাশের সরু এবং ফাঁকা কেবিনগুলোর দিকে জ্যাক লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকাত: তার মতে, পৌরুষদীপ্ত জীবনযাপনের উদাহরণ ছিল ওই সব কেবিনে। কেবিনগুলো সবচেয়ে বিলাসবহুল আবাসস্থলের চেয়েও আকর্ষণীয় মনে হত। জ্যাককে তারা মহানুভবতা দেখিয়েই স্বাগত জানাত। কারণ জ্যাক নিজেও তাদের সঙ্গে হাসি মুখে কথা বলত। তাদের কঠিন আকৃতির মুখ এবং একাকী থাকার কারণে যেরকম চেহারা তৈরি হত সেই চেহারাও তার পছন্দের ছিল। তাদের জীবন যাপন প্রণালী যে তার খুব পছন্দ হতো সেটাও জ্যাক বুঝিয়ে দিত। মাঝে মধ্যে তাদের কেউ কেউ ফরাসি ভাষায় তার সম্পর্কে টুকটাক কিছু জানতে চাইত। তারপর উৎফুল্ল চিত্তে তাপে ফুটন্ত কাঠামোর দিকে হাঁটা দিত জ্যাক। সেখান থেকে রাস্তার জ্বলন্ত হাতলে, তারপর অফিসে পৌঁছে আবার কাজে মগ্ন হয়ে যেত। প্রচণ্ড তাপের মধ্যে ঘুরে ওইসব ফাইফরমাস খাটতে হত বলে তার শরীর অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়ত। রাতে প্রচণ্ড ঘুম হত। সেপ্টেম্বরে ক্লাসে ফিরে যাওয়ার সময় আসতে আসতে জ্যাক হয়ে যেত শারীরিক দিক থেকে অনেক বেশি পলকা এবং মানসিক দিক থেকে খুব বেশি অস্থির।
লিসেতে আবার দিনে ১২ ঘণ্টা কাটানো যাবে এমন সময় সামনে চলে আসছে ভেবে জ্যাক মনে মনে খুশি হয়। কিন্তু বিব্রত বোধ করে যখনই মনে পড়ে যায়, লিসেতে ফিরে যাওয়ার আগে চাকরি দাতাদেরকে তার চাকরি ছাড়ার কথা জানিয়ে দিতে হবে। যন্ত্রপাতির দোকানে চাকরি ছাড়ার বিষয়টা জানানো তার জন্য কঠিন হয়ে দেখা দেয়। সে ভীরু মনে ঠিক করে, তার চাকরি ছাড়ার যে ব্যাখ্যাই তাদের দিতে হোক না কেন, সেটা যেন নানি গিয়ে তাদের জানিয়ে আসেন। সে নিজে যেতে চায় না। কিন্তু নানি মনে করেন, অতসব আনুষ্ঠানিকতার দরকারটা কী। তার সিদ্ধান্ত হলো, জ্যাক তার বেতনটা তুলে নিয়ে এসে আর অফিসে যাবে না। তাতেই সব চুকেবুকে গেল। আর এতো ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার নেই তো। জ্যাক মনে করে, ম্যানেজারের হম্বিতম্বির মুখোমুখি হওয়ার জন্য নানিকে পাঠানোই সঙ্গত। এই পরিস্থিতি এবং মিথ্যে বলার জন্য নানিই তো দায়ী। তবু কোনোরকম ব্যাখ্য না দিয়ে চাকরি থেকে অনুপস্থিত থাকার বিষয়টার কথা ভেবে জ্যাক রুষ্ট হয় এবং নানির সঙ্গে মীমাংসায় না আসার জন্য সে যুক্তি দেখায়, সেরকম কিছু করলে বস তো আমার কাছে কাউকে পাঠাতে পারেন।
নানি নতুন করে প্যাঁচ কষতে থাকেন, পাঠালে পাঠবে; তাতে কী? তুই বলবি তুই আর ওদের কাজ করবি না। তোর মামার কারখানায় কাজ করবি। ব্যস; হয়ে গেল। মনের মধ্যে অভিশাপ নিয়ে জ্যাক বের হয়ে যাওয়ার সময় নানি আবার বললেন, অথবা বেতনটা তোলার পর ম্যানেজারকে বুঝিয়ে বললেই তো পারিস।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/