ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৪৮
দ্য ফার্স্ট ম্যান
প্রথমত তারা খিলানগুলোর নিচে এবং ভেতরের উঠোনে ঘুরে বেড়াত এবং কিছুক্ষণ পরেই রুটি এবং চকলেটটা খেয়ে ফেলত। কারণ রুটিটাকে মনে হতো ঝামেলাপূর্ণ একটা জিনিস আর চকলেটটা গলে তাদের আঙুলে জড়িয়ে যেত।
এরপর তারা যুদ্ধপ্রবীণদের মুখোমুখি হতো। কারও একটা পা নেই। কারও একটা হাত নেই। কেউ সাইকেলের চাকা লাগানো ছোট গাড়িতে বসা। কারও চেহারা বিকৃত ছিল না। কেউ অন্ধও ছিলেন না। শুধু পঙ্গু ছিলেন তারা। তাদের পোশাক আশাকও ছিল পরিচ্ছন্ন। কারও গলায় ঝুলত পদক। শার্টের, জ্যাকেটের কিংবা পাজামার হাতা গুটিয়ে সেপটিপিন দিয়ে অবশিষ্ট অদৃশ্য কোনো অঙ্গের সঙ্গে বাঁধা থাকত, দেখতে তেমন একটা ভয়াবহ ছিল না। সংখ্যায় তারা অনেক। প্রথম দিন তাদের দেখার পর যেটুকু বিস্ময়বোধ জেগেছিল পিয়েরে এবং জ্যাকের মনে সেটা কাটিয়ে ওঠার পর নতুন কিছু আবিষ্কার করলে জগৎ সম্পর্কিত তাদের নিজস্ব দৃষ্টিতেই যেমন করে দেখে থাকত তেমন করেই দেখেছে ওই মানুষগুলোকেও। পিয়েরের মা তাদের বুঝিয়েছেন, ওই মানুষগুলো যুদ্ধে তাদের হাত কিংবা পা হারিয়েছেন এবং যেহেতু তাদের জগতেরই একটা অংশ ছিল যুদ্ধ এবং যুদ্ধ সম্পর্কে তারা যেহেতু সব সময় শুনে এসেছেন সেহেতু তাদের চারপাশের সবকিছুতেই যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে।
তাদের বুঝতে কোনো অসুবিধা হতো না, অন্য যেকোনো মানুষই যেকোনো সময় তাদের হাত কিংবা পা হারাতে পারে। অঙ্গ হারানোর সময়টাও অন্যান্য মুহূর্তের মতোই জীবনের একটা অংশ মাত্র। সে সব কারণেই পিয়েরে এবং জ্যাকের কাছে ওই পঙ্গু মানুষগুলোর জগৎ কখনও দুঃখের বলে মনে হয়নি। তাদের কেউ কেউ খুব চাপা এবং গম্ভীর স্বভাবের ছিলেন। তবে অনেকেই ছিলেন কম বয়সী, হাসিখুশি এমনকি নিজের পঙ্গুত্ব নিয়ে হাসি ঠাট্টা করতেও দ্বিধা করতেন না। শ্বেতকায় সোনালি চুলওয়ালা গোলগাল মুখের এবং উজ্জ্বল স্বাস্থ্যের অধিকারী একজন ছিলেন। তাকে মাঝে মধ্যে লন্ড্রির আশেপাশে প্রায়ই ঘুর ঘুর করতে দেখেছে পিয়েরে এবং জ্যাক। তিনি তাদের বলতেন, আমার একটা পা আছে মাত্র। কিন্তু আমি তোমাদের পাছায় কষে লাথি মারতে পারি। ডান হাত চেয়ারের বেতের উপর রেখে বাম হাত দিয়ে খিলানের পাঁচিল ধরে বেয়ে উঠে তাদের দিকে সত্যিই পা ঝেড়ে লাথি দেওয়ার চেষ্টা করতেন তিনি। তার ভঙ্গি দেখে পিয়েরে এবং জ্যাক হাসতে হাসতে যত দ্রুত সম্ভব তার নাগালের বাইরে দৌড়ে পালাত। মনে হতো, শুধু তারাই দৌড়ে পালাতে পারে। তারাই শুধু হাত পাগুলো ঠিক ঠিক ব্যবহার করতে পারে। একবার ফুটবল খেলতে গিয়ে জ্যাকের পা মচকে গেল। কয়েকদিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে হলো। তখন তার মনে হলো, বৃহস্পতিবারে দেখা মানুষগুলো সারা জীবনই দৌড়াতে, ট্রলিবাস ধরতে কিংবা ফুটবলে লাথি মারতে অক্ষম থেকে যাবেন। সে নিজেও ওই কয়েকদিন তাদের মতো অবস্থায় পড়ে গিয়েছিল। শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অলৌকিক কার্যকলাপের কথা তার মনের মধ্যে সদা জাগ্রত হয়ে রইল। অমূলক একটা ভয়ও মনের মধ্যে কাজ করতে লাগল। তার নিজেরও তো কখনও অঙ্গহানি ঘটতে পারে। পরে অবশ্য সে এসব ভুলে গেছে।
তারা প্রায়ই ঝাঁপবন্ধ খাবার ঘরের আশপাশে ঘুরে বেড়াত। বড় বড় টেবিল, গোটাটাই চকচকে দস্তায় মোড়ানো; রান্নাঘরে বড় বড় কড়াই এবং অন্যান্য বাসনপত্র। সেখান থেকে সব সময় রান্না করা মাংসের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ত। শেষ প্রান্তে তারা দেখত শোবার ঘর। সেখানে দুতিনটা বিছানা ধূসর রঙের চাদরে ঢাকা। পাশে কাঠের তৈরি আলমারি। সেখানে বেড়ানো হয়ে গেলে তারা বাগানের দিকে যাওয়ার কয়েকটা বহির্মুখী সিঁড়ি বেয়ে বের হয়ে পড়ত।
যুদ্ধাহত সৈনিকদের আশ্রমের চারপাশ ঘিরে রেখেছিল প্রায় পুরোপুরি অবহেলিত একটা পার্ক। বাসিন্দাদের কয়েকজন সেখানকার বাগানের ফুলতলা আর কয়েকটা গোলাপ ঝাড়ের দেখভাল করার স্বেচ্ছা দায়িত্ব পালন করতেন। বাগানে শুকনো নলখাগড়া আর আগাছার ঝোপঝাড় ঘেরা কিছু অংশে কয়েক পদের শাকসবজির গাছও ছিল। তবে এক সময় খুব চমৎকার চেহারা থাকলেও এখন আর এর বাইরে পার্কের অন্য কোনো জৌলুস নেই; পুরোপুরি প্রকৃতি নির্ভর হয়ে পড়েছে। বড় বড় ইউক্যালিপটাস গাছ, তালগাছ, নারকেলগাছ, মাটির গভীরে শিকড় গাড়া মোটা কাণ্ড আর নিচু হয়ে পড়া ডালপালাসহ রাবার গাছ মিলে গোলকধাঁধার মতো পরিবেশ তৈরি করেছে। ঘন ছায়া আর গভীর গোপনীয়তা এখানে সেখানে। ঘনপাতাওয়ালা মোটা মোটা সাইপ্রেস গাছ, বড় বড় কমলাগাছ, খুব লম্বা গোলাপি আর সাদা লরেলগাছ মিলে এখানকার জনমানবহীন পায়েচলা পথটা ঢেকে দিয়েছে। এখানে সুরকির পথকে গিলে ফেলেছে কাদামাটির আস্তরণ। পথের প্রান্ত ছুঁয়ে আছে সুবাসি সিমরিঙ্গার, জুঁই, বেগুনি বনলতাফুল, প্যাশনফুল, মধুমতি ফুলের ঝোপঝাড়। তবে সেগুলোকে মাটির কাছে ছেয়ে ফেলেছে তিনপাতাওয়ালা ঘাস, ওক্সালিস এবং সব বুনো ঘাসের পুরু আস্তরণ। সুবাসভরা বনজঙ্গলের ভেতর হাঁটা, হামাগুড়ি দিয়ে চলা, ঘাসের সঙ্গে মুখ ছোঁয়ানো, ছুরি হাতে ঘাসের মধ্যে দিয়ে পথ করে চলা, গায়ে মুখে কাদামাটি আর পানি নিয়ে ফিরে আসা এসবই পরমানন্দের বিষয়।
তবে ভয়ঙ্কর বিষের উৎপাদনও তাদের বিকালের অভিযানের একটা বড় অংশ ছিল। পার্কের একটা দেয়ালের গা ঘেঁষা বেঞ্চের নিচে অ্যাসপিরিনের কৌটা, ওষুধের বয়ম, পুরনো কালির দোয়াত, গামলার ভাঙা টুকরো, ভাঙা কাপের টুকরো ইত্যাদি জড়ো করে তাদের গবেষণাগার তৈরি করেছিল পিয়েরে এবং জ্যাক। সবার চোখের আড়ালে, পার্কের সবচেয়ে ঘন ছায়াময় ওই জায়গাটাতে তারা রহস্যজনক উপচার তৈরি করত। তাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল করবীগাছ। তারা লোকমুখে শুনেছিল করবী গাছের ছায়া খুব ভয়ঙ্কর; করবী গাছের ছায়ায় কোনো অর্বাচীন লোক ভুলবশত শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লে তার ঘুম কখনও ভাঙবে না। সুতরাং তারা করবী গাছের পাতা এবং ফুলের মৌসুমে করবী ফুল তুলে জড়ো করত অশুভ মণ্ড তৈরি করার জন্য। মণ্ডের চেহারা দেখলেই যে কোনো মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ওই মণ্ড তারা খোলা জায়গায় রেখে দিত যাতে রংধনুর মতো বিচিত্র রং ধারণ করে। ওই সময় তাদের একজন দৌড়ে বোতল ভরে পানি আনতে যেত। তখন সাইপ্রেস গাছের কাণ্ডের ত্রিভূজাকৃতির মুখগুলো বের হতো। তারা জানত সাইপ্রেস গাছ হলো কবরস্থানের গাছ; এর সঙ্গেও ভয়ের ব্যাপার স্যাপার জড়িয়ে আছে। তারা মাটিতে পড়ে থাকা ফল নিত না। গাছ থেকে ফল তুলে জড়ো করত। নিচে পড়ে থাকা ফলগুলো ভয়ঙ্কর রকমের সুস্বাদু চেহারা লাভ করত বলে সেগুলো তারা জড়ো করত না। তারপর দুটো মণ্ডের জলের সঙ্গে মিশিয়ে আরও পাতলা করা হতো। একটা ময়লা রুমালে ছাঁকা হতো সেটা। তরল পদার্থটার চেহারা হতো গাঢ় সবুজ। কোনো বিষাক্ত পদার্থ নিয়ে কাজ করার সময় মানুষ যেমন সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে তেমনি তারাও তরল পদার্থটা নাড়াচাড়া করার সময় খুব সতর্কতা অবলম্বন করত। তাদের কাছে জড়ো করা ওষুধের পাত্রগুলোর ভেতর তরল পদার্থটা ঢেলে মুখ আটকে দিত। তখনও খুব সাবধানে কাজ করত যাতে হাতে ছোঁয়া না লাগে। বাকি আর কোনো উপাদান থাকলে সেগুলোও অন্য কোনো ভয়াবহ বিষ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করত। সবগুলো এভাবে তৈরি হয়ে গেলে সতর্কতার সঙ্গে পাথরের তৈরি বেঞ্চের নিচে রেখে দিত সপ্তাহ খানেক যাতে বিষাক্ত পদার্থটা যথেষ্ট মাত্রায় গাঁজিয়ে উঠতে পারে এবং ভয়ঙ্কর চেহারা ধারণ করতে পারে। এরকম ভয়ঙ্কর কাজ শেষ হলে জ্যাক এবং পিয়েরে বেঞ্চের নিচে জড়ো করে রাখা পাত্রগুলোর সবুজাভ চেহারার দিকে নিবিষ্ট চিত্তে তাকিয়ে থাকত। কখনও কখনও পাত্রগুলো থেকে কটু গন্ধ নিত আনন্দের সঙ্গে। তারা অবশ্য সত্যি সত্যি কারও উপর প্রয়োগ করার জন্য ওই তরল পদার্থ তৈরি করত না। বরং শুধু কল্পনা করে দেখত তাদের ক্ষমতা কত দূর। তারা হিসাব নিকাশ করে দেখেছে, গোটা শহর জনশূন্য করে দেওয়ার মতো বিষ তারা উৎপাদন করে ফেলেছে। তবে তাদের কল্পনায় কখনও আসেনি, কোনো অপছন্দের সহপাঠী কিংবা শিক্ষককে ওই বিষ প্রয়োগে হত্যা করা যেতে পারে। আসলে তাদের অতি অপছন্দের কেউ ছিলই না। বড় হয়ে যে পৃথিবীতে বাস করতে হবে সেখানে তাদের কোনো কাজে বাধা সৃষ্টি করতে পারে তেমন কেউ ছিল না।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/