‘ট্রাফিক পুলিশকে জনবান্ধব করতে কাউন্সেলিং জরুরি’
মাঝে মধ্যেই কতিপয় পুলিশ সদস্যের উগ্র আচরণ, নিরাপত্তার বদলে সাধারণ মানুষকে আরও নিরাপত্তাহীনতায় ফেলে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক পুলিশের আচরণগত বেশ কিছু ঘটনার তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাফিক পুলিশকে জনবান্ধব করতে হলে যথাযথ কাউন্সেলিং প্রয়োজন। অন্যথায় জটিলতা আরও বাড়তে পারে। রাস্তায় দায়িত্ব পালনের সময় তাদের কথা কম বলতে হবে এবং চালকদের সঙ্গে কৌশলে ভালো ব্যবহার করে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর ও পল্লবী থানা এলাকার পাঁচটি ট্রাফিক পুলিশ বক্সে অটোরিকশা চালকদের (ব্যাটারিচালিত রিকশা) হামলার ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে ট্রাফিক পুলিশ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ট্রাফিক পুলিশের বেশ কিছু সদস্য মাঝে মাঝে মানুষের সঙ্গে অস্বাভাবিক আচরণ করে। মানুষের মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষার সাধারণ মানদণ্ডও তারা মানে না।
জানা যায়, পুলিশ প্রথমে প্রতিবন্ধী এক রিকশাচালককে মারধর করে। এই ঘটনা প্রচার হওয়ার কিছু সময় পর অটোরিকশা চালকেরা সংগঠিত হয়ে ট্রাফিক পুলিশের উপর হামলা করে। এতে মিজানুর রহমান নামে এক পুলিশ কনস্টেবল আহত হন। অবশ্য মিরপুর ও পল্লবী ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী অটোরিকশা সড়কে নিষিদ্ধ। সে জন্য নিয়মিত অভিযানে দুটি অটোরিকশা জব্দ করা হয়। এরপর কতিপয় অটোরিকশা চালক একত্রিত হয়ে এই হামলা করেন।
সমাজ বিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্রাফিক পুলিশকে জনবান্ধব করতে হলে তাদের মানুষের সঙ্গে কীভাবে আচরণ করতে হবে এ নিয়ে কাউন্সেলিং করা দরকার। বিভিন্ন সময় তাদেরকে নিয়ে সেমিনারসহ অন্যান্য কোর্স চালু রাখা দরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ হলো সাধারণ মানুষের বন্ধু, সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশ কেন খারাপ আচরণ করবে বা মানুষ কেন তাদের প্রতি খারাপ ধারণা নিবে। এসব থেকে সাধারণ মানুষ এবং পুলিশকে বের হয়ে আসতে হবে। সবাই যদি এ বিষয়ে সচেতন হয় তাহলে এ ধরনের অপ্রিতিকর ঘটনা কমে আসবে।
মিরপুর পুলিশ বক্সে হামলার বিষয়ে জানতে চাইলে ডিবি পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, পাঁচটি ট্রাফিক বক্সে হামলার ঘটনা পরিকল্পিত ভাবে করা হয়েছে। এ ঘটনায় ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘পুলিশের মনোবল ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশে এবং পরিকল্পিতভাবে এ হামলা করা হয়েছে। ওই এলাকার কিছু মানুষের ইন্ধনে তারা এ হামলায় অংশ নেয়। পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট, মনোবল ভাঙা এবং সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এই হামলা করা হয়েছে। এখানে ট্রাফিক পুলিশের আচারণগত কোনো সমস্যা নেই।’
রাইড শেয়ারিং চালক মুজিবুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ অনেক সময় আমাদের উপর অত্যাচার করে এবং জোর করে মামলা দেয়, খারাপ ব্যবহার করে। তাদের আচরণের কাউন্সেলিং করা দরকার।’
পাঠাও চালক জয়নাল মিয়া বলেন, ‘আমাদের মতো শ্রমিক, দিন মজুরদের উপর মাঝে মাঝে ট্রাফিক পুলিশ অত্যাচার করে। তারা বিনা কারণে মামলা দেয় এবং খারাপ খারাপ কথা বলে, ২-৩ ঘণ্টা ধরে রাস্তায় আটকে রাখে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, ‘আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে আইন না মানার প্রবণতা বেশি। সাধারণ চালক ও ট্রাফিকের মধ্যে মাঝে মাঝে ঘুষের কিছু ঘটনা ঘটে। এসব থেকে স্বার্থ কেন্দ্রিক অনেক সময় বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। পুলিশকে পুরোপুরি জনবান্ধব হিসেবে তৈরি করতে হলে তাদের বিভিন্ন সেমিনার, কোর্স এবং কাউন্সেলিং চলমান রাখা উচিত। কারণ, মিরপুরের ঘটনাটি কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। উভয় পক্ষের মধ্যে কিছু না কিছু ত্রুটি ছিল যার কারণে হয়তো এসব ঘটনা ঘটেছে।’
তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ প্রতিদিন অনেক মানুষকে ফেস করে সেখান থেকে অনেক ধরনের কথা শুনতে হয় তাদের। অনেক সময় তারা বিষয়টি স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না, যার কারণে মানুষের সঙ্গে তাদের ঝগড়া বা বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। পুলিশকে মনে রাখতে হবে তারা জনগনের সেবক। পুলিশকে দায়িত্বরত অবস্থায় কথা কম বলতে হবে এবং কৌশলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘তা ছাড়া, সাধারণ মানুষ রাস্তায় চলাচলের সময় আইন মেনে চললে এবং পুলিশের নির্দেশনা মেনে চললেই বিভিন্ন ধরনের অপ্রিতিকর ঘটনা এড়িয়ে চলা সম্ভব।’
কাউন্সেলিং বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, থানা থেকে শুরু করে পুলিশ লাইন, পুলিশ ক্যাম্প,ট্রাফিক বিভাগ সবখানেই কাউন্সেলিং চলছে। দিনের শুরুতে পুলিশ সদস্যদের হাজিরা নেওয়ার সময় সবাইকে একসঙ্গে করে সিনিয়র অফিসাররা এই কাউন্সেলিং করে থাকেন। বিশেষ করে যানবাহন তল্লাশি বা চেক করার নামে সাধারণ মানুষকে যাতে হয়রানি করা না হয় সেই ট্রেনিং তাদের দেওয়া হয়।
কাউন্সেলিংয়ে পুলিশ সদস্যদের কী বলা হয় বা হয়ে থাকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোনো তল্লাশি চালাতে হলে কী নিয়ম মানতে হবে, কী ধরনের আচরণ করতে হবে সেটা বলে দেওয়া হয়। সাধারণ মানুষকে যেনো সম্মান দেওয়া হয়, তাদের প্রতি যেনো ভদ্র আচরণ করা হয়, সেগুলো তাদের বলা হচ্ছে। সম্প্রতি কিছু ঘটনায় পুলিশের প্রতি সাধারণ মানুষের বিরূপ ধারণা হওয়ার আশঙ্কায় এই কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা চলমান রয়েছে এবং এটি নেওয়া হয়। মানবাধিকারের বিষয়টিও থাকছে কাউন্সেলিংয়ে।’
জানতে চাইলে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের মানসিক চিকিৎসক ফারহানা আক্তার বলেন, ট্রাফিক পুলিশকে কেবল মনস্তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণ দিলে হবে না। রাষ্ট্র যদি জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার ব্যবস্থা না করে সেখানে কেবল কাউন্সেলিং দিয়ে হবে না। ট্রাফিক পুলিশ বা অন্যান্য দায়িত্বে থাকা পুলিশের পেশাগত কাজের মানোন্নয়নে রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। কারণ,পুলিশ হচ্ছে রাষ্ট্রের একটি দায়িত্বশীল অঙ্গ।
জানতে চাইলে চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের আইনজীবী ফেরদাউস সুলতানা বলেন, পুলিশকে মানবিক এবং দায়িত্বশীল হতে হবে। সেই সঙ্গে চালক বা সাধারণ মানুষ যাতে তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট না হয় সেদিকে নজর রেখে কৌশলে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।
এনএইচবি/এমএমএ/