মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ত্যাগ বাঙালি আজীবন মনে রাখবে: শমসের মবিন চৌধুরী
স্মৃতিচারণ, গানবাজনা, নৃত্য, নৌ ভ্রমণের মধ্য দিয়ে সুন্দর একটি সন্ধ্যা পার করলেন আসামের গৌহাটতে সফররত বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় যোদ্ধারা। সেই অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শমসের মবিন চৌধুরী (বীর বিক্রম) বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত সরকার ও দেশটির জনগণ যেভাবে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে কঠিনতম সময়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় ভারত সরকার ও এর জনগণের কাছে বাংলাদেশ চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সেসময় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতও যে ত্যাগ স্বীকার করেছে তা বাঙালি জাতি আজীবন স্মরণ রাখবে।
সোমবার (১৮ জুলাই) রাতে ভারতের আসাম রাজ্যের গৌহাটিতে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সৌজন্যে অনুষ্ঠিত এক মিলন মেলায় এ কথা বলেন সাবেক এই কর্মকর্তা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে আসাম সফররত বীর মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও যুব প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে রয়েছেন তিনি।
ব্রহ্মপুত্র নদে ভাসমান জাহাজে সাংস্কৃতিক আয়োজনের শেষভাগে বক্তৃতায় শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তের অক্ষরে লেখা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও ভারত অভিন্ন লক্ষ্যে ত্যাগ স্বীকার করেছে, সেটা হলো স্বাধীনতা। এই রক্তের অক্ষরে লেখা সম্পর্ক আজ এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে এবং এটা আরও সমৃদ্ধি লাভ করতে থাকবে।
এসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সবশেষ বাংলাদেশ সফরে করা একটি মন্তব্য উল্লেখ করেন শমসের মবিন। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রী মোদী তখন বলেছিলেন, তার সফর আজ শেষ হলেও বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের যাত্রা শুরু হলো এখন।
এসময় মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিকে সহায়তা করতে ভারতের বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান নিয়ে ঢাকার আকাশে ঢুকে পড়ার কথা স্মরণ করে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, সেদিন ছিল ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর। আহত এবং বন্দি অবস্থায় দেখলাম বিমানবন্দরে (পুরনো) ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান নামছে। তারপরের ইতিহাস পাকিস্তানের পরাজয়। ১৬ ডিসেম্বর আমরা জানলাম, পাকিস্তান আত্মসমর্পণ করেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
শমসের মবিন চৌধুরী বলেন, সবচেয়ে কঠিনতম সময়ে এভাবে আমাদের পাশে দাঁড়ানোয় ভারত ও এর জনগণের প্রতি বাংলাদেশ চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। এটাই আমাদের সম্পর্ক, আমাদের সম্পর্কের অনন্য দিক।
স্বাধীনতার পর অনেক কিছু পরিবর্তন হচ্ছে, অনেক বিষয় বাস্তবিক হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের যোগাযোগ আরও বেড়েছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা (ভারতের বর্তমান পররাষ্ট্র সচিব) ঢাকায় হাইকমিশনার থাকাকালে ১২ হাজার বাংলাদেশির জন্য ভিসা ইস্যু করেছেন। বাংলাদেশে ভারতের ভিসা সেন্টারগুলো, যেটা যে কোনো দেশে যে কোনো কূটনৈতিক মিশনের রেকর্ড। এটাই আমাদের সম্পর্কের ধরন।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন আসাম সরকারের অ্যাক্ট ইস্ট পলিসি ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারি মানবেন্দ্র প্রতাপ সিং, গৌহাটিতে বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার ড. শাহ মো. তানভীর মনসুর, আসাম সরকারের জয়েন্ট সেক্রেটারি সাজ্জাদ আলম। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন দেবজ্যাতি দাশগুপ্ত।
মানবেন্দ্র প্রতাপ সিং বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছিলেন তাদের আসামে স্মৃতিচারণের সুযোগ দিতে পারা আমাদের জন্য সৌভাগ্যের। বাংলাদেশ ও ভারতের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ এবং মানুষে মানুষে যোগাযোগ এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই ধারা ক্রমেই সমৃদ্ধি লাভ করবে বলে আমরা আশাবাদী।
এর আগে ব্রহ্মপুত্রের তীরে আলফ্রেসকো গ্রান্ড জাহাজে উঠতেই অভ্যর্থনা জানানো হয় ২৫ জনের প্রতিনিধিদলকে। পরে জাহাজটি নদীতে যাত্রা শুরু করে, শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। প্রথমে আসামের পর্যটন ও জীবনযাত্রা নিয়ে নির্মিত একাধিক ভিডিওচিত্র দেখানো হয়। পরে ব্রহ্মপুত্র নদকে নিয়ে নির্মিত একটি সংগীতচিত্রও প্রদর্শিত হয় প্রজেক্টরে। এই গানে কণ্ঠ মেলান কিংবদন্তি অমিতাভ বচ্চন থেকে শুরু বিশাল দাদলানি, কৈলাশ খের, সনু নিগম, শ্রেয়া ঘোষাল, শান এমনকি এ প্রজন্মের অরিজিৎ সিং পর্যন্ত।
অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী আসামিজ সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ছিল, যেখানে একইসঙ্গে গান ও নৃত্য পরিবেশিত হয়। এরপর ডায়াস সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলে চমক দেখান বীর মুক্তিযোদ্ধা শমসের মবিন চৌধুরী। তিনি স্টেজে উঠে শোনান আসামের কিংবদন্তি গায়ক ভূপেন হাজারিকার গান ‘মানুষ মানুষের জন্য...’। ‘শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ্য মুজিবরের কণ্ঠ’ গেয়ে শোনান সহকারী হাইকমিশনার তানভীর মনসুর, মানবেন্দ্র প্রতাপ সিং শোনান 'চিরদিন ই তুমি যে আমার, আমি তোমার ই। এছাড়া আরও অনেকে গান গেয়ে শোনান।
মিলনায়তনে যখন চলছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, তখন অনেকে জাহাজের ছাদে উঠে উপভোগ করেন রাতের ব্রহ্মপুত্রের গা শীতল করা বাতাস। সাংস্কৃতিক আয়োজন ও বক্তৃতার পর আসাম সরকারের পক্ষ থেকে বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রতিনিধিদলের সদস্যদের উত্তরীয় পরিয়ে, ফুল ও শুভেচ্ছা স্মারক দিয়ে সম্মাননা জানানো হয়। সবাইকে উত্তরীয় পরিয়ে ফুল ও স্মারক উপহার দেন আসাম সরকারের সেক্রেটারি মানবেন্দ্র প্রতাপ সিং।
এসএম/এনএইচবি/এএজেড