শিলংয়ের মাটিতে শুয়ে আছেন ৫২ পরিচয়হীন মুক্তিযোদ্ধা
মেঘ-পাহাড়ের দেশ মেঘালয় শিলংয়ের মাটিতে শুয়ে আছেন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। নাম পরিচয়হীন ৫২ জন মুক্তিযোদ্ধাকে শিলংয়ের মাটিতে দাফন করেন আহমেদ হোসেন ও তার ভাই আফজাল হোসেন এবং আরও কয়েকজন মিলে।
নাম পরিচয়হীন এ সকল মুক্তিযোদ্ধাদের দাফনের সেদিনের সেই ঘটনাগুলো বর্ণনা করতে গিয়ে বেদনাকাতর হয়ে পড়েন মেঘালয় শিলংয়ের বাসিন্দা আহমেদ হোসেন। যিনি পেশায় একজন ফটোগ্রাফার।
মুক্তিযুদ্ধসহ দক্ষিণ পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জায়গার প্রায় ৩০ হাজার ছবির নেগেটিভ তার সংগ্রহে রয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ২০১২ সালে আহমেদ হোসেন, আবজাল হোসেন ও তার বোন আশরাফী বেগম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে স্বাধীনতা পদক গ্রহণ করেন।
রবিবার (১৭ জুলাই) শিলংয়ের হোটেল পাইনউডে মিলিত হয়েছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। এই মিলনমেলায় মুক্তিযুদ্ধকালীন লড়াই-সংগ্রাম, দুঃখ-কষ্ট, আবেগ-অনুভূতির স্মৃতিচারণ করেন তারা। এ সময় আহমেদ হোসেন মুক্তিযুদ্ধের সময় তার স্মৃতিকথা তুলে ধরেন।
যুদ্ধদিনের ঘটনাগুলো বর্ণনা করে আহমেদ হোসেন বলেন, ঘটনাগুলো এত বিশদ যে, জীবনে বলে শেষ করা যায় না। সে সময় আমরা কয়েকজন প্রতিবাদ করতে আরম্ভ করেছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে আলাপ হলো। মিটিংগুলো সব আমাদের বাড়িতে হতো। তখন মিজানুর রহমান সাহেব, অগ্নিকন্যা যাকে বলা হয় মতিয়া চৌধুরী অনেকেই আমাদের বাড়িতে আসতেন। আমাদের বাড়িতে মিটিং হতো। আস্তে আস্তে কয়েস ভাই (কয়েস আহমেদ) আমাকে যুদ্ধক্ষেত্রে নিতে আরম্ভ করল। তখন আমরা ট্রেনিংয়ে যেতাম, তুমা বলে একটা জায়গা ছিল সেখানে ট্রেনিং হতো। বন্দুক ট্রেনিং, মেশিনগান ট্রেনিং। একদিন একটা ট্রেনিংয়ে আমাকে নিয়ে গেলেন। আমাকে বললেন আপনি ট্রেইনারের পাশে দাঁড়ান। আমি ট্রেইনারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি আর সমস্ত ছেলেরা সব নিচে দাঁড়িয়ে আছে। অপেক্ষা করছে ট্রেইনারের কথা শুনতে। আচমকা সেই ট্রেইনার হঠাৎ মেশিনগান চালিয়ে দিলেন। আমি এত হতবাক হয়ে গেলাম যে বলার মতো না। তখন চারদিকে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে গেল। ট্রেনিংয়ে সবাই বলতো আমাকে কবে যুদ্ধে পাঠাবেন, কবে যুদ্ধে পাঠাবেন। তখন বলল আমরা এই সাত জনকেই শুধু পাঠাব, তোমাদের যেতে হবে না।
যুদ্ধের সময় কীভাবে কোথায় ছিলেন সে বর্ণনা করে আহমেদ হোসেন বলেন, প্রথমে আমরা ডাউকি বাজারে থাকতাম, জঙ্গলে থাকতাম। আমি মূলত একজন ফটোজানালিস্ট। উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের কোনো স্টেট আমার বাদ নেই ছবি তোলার। আমার নেগেটিভের সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার। মুক্তিযুদ্ধের যে ছবিগুলো আছে সেই ছবিগুলো পাওয়া যাবে। অনেক ঘাত প্রতিঘাত বেদনাময় ঘটনা ঘটেছে। আমি তো কোনোদিন পরিপক্ক সৈন্য ছিলাম না।
তিনি আরও বলেন, আমরা ভারতের স্বাধীনতা খুব ছোটবেলায় দেখেছি। তখন বুঝতে পারিনি স্বাধীনতা কী ব্যাপার। কিন্তু যখন ১৬ ডিসেম্বর আমরা সিলেটে গিয়ে পৌঁছালাম। সিলেটে আমাকে ঢুকতে দেয়নি। খাদিমনগরে আটকে দিয়েছিল। বিএসএফের একজন ছিলেন কর্নেল গালিবকে বললাম ভাই আমাকে তো যেতেই হবে। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের আনন্দ কোনোদিন ভুলতে পারব না।
যুদ্ধে একটি বিষাদময় ঘটনা বর্ণনা করে বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু আহমেদ হোসেন বলেন, আগস্ট মাস ১৯৭১। আমাদের টিমের যারা ছিলেন তাদের মধ্যে একজন জার্নালিস্ট ছিলেন নীলকমল। একদিন আমাকে হঠাৎ আগস্ট মাসের মাঝামাঝি রাত দুটোর সময় ফোন করলেন তিনি আমাকে বড় সাহেব বলে ডাকতেন। বলেন বড় সাহেব, একটা কাজ করতে হবে। বলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছে তাকে মাটি দিতে হবে। তখন আমি বললাম ঠিক আছে কোনো সমস্যা নেই। আমার পূর্বপুরুষরা সেখানে একটা মসজিদ তৈরি করেছিলেন। সেই মসজিদটা পুলিশ বাজারে আছে, এখনো আছে। বংশ পরস্পরায় আমরা সেই মসজিদের খাদিম। আমি বলেছিলাম কোনো প্রবলেম নেই ইমাম সাহেব এটা করে দেবে। খুব চুপচাপ করেছিলাম। কারণ তখনো ইন্ডিয়া ভালোভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়নি। আমরা সেই ডেড বডি নিয়ে মসজিদে গেলাম। মসজিদে নিয়ে ডেড বডি খুলে অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম ১২-১৩ বছরের একটা ছেলে বুকে গুলি লেগে মারা গেছে। আমি এত কষ্ট পেয়েছিলাম যে সেটা বলার নয়। আমরা ৫-৭ জন মিলে তাকে মাটি দিয়েছিলাম। তখন আমাদের একটা গোপনীয়তা রক্ষা করতে হয়েছিল। এভাবে হতে হতে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি আমার ভাই আমরা মিলে ৫২ জন শহীদকে শিলংয়ের মাটিতে দাফন করেছি।
এসএম/এমএমএ/