বিএনপির পুনর্গঠনে বড় বাধা অন্তর্কোন্দল আর হস্তক্ষেপ
অভ্যন্তরীণ কোন্দল, কমিটি গঠনে আর্থিক লেনদেনের অভিযোগ, প্রভাবশালী নেতাদের হস্তক্ষেপ, নেতাদের পছন্দের লোককে কমিটিতে স্থান দেওয়াসহ নানা কারণে মাঠপর্যায়ে বিএনপির পুনর্গঠন কার্যক্রম মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ঘোষণা দিয়েও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ করতে পারছে না দলটির হাইকমান্ড।
বেশকয়েকটি জেলায় সম্মেলন করা গেলেও কোথাও কোথাও কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। এসব কারণে কমিটি গঠন না করেই কেন্দ্রীয় নেতাদের ঢাকায় ফিরতে হয়েছে। পরবর্তীতে কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষণা করতে দেখা গেছে। কিন্তু কেন্দ্র থেকে ঘোষিত কমিটিগুলো নিয়ে দলটির ভেতরে-বাইরে অসন্তোষ দেখা গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, ‘পকেট-কমিটি’ গঠনের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে যোগ্য ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের বঞ্চিত করার। ফলে দলীয় কার্যক্রমে গতি না এসে উল্টো স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনেকে পদ ছেড়ে দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বদানের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় দলের পুনর্গঠন কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
দলটির অধিকাংশ জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও সেগুলোর নতুন কমিটি গঠন না হওয়ায় তৃণমূলে বাড়ছে ক্ষোভ ও হতাশা। যোগ্য ও ত্যাগী নেতা-কর্মীদের দিয়ে দ্রুত পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় ইতি টানতে ব্যর্থ হলে সরকার পতন আন্দোলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এমনটাই মনে করছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। তবে এসব অভিযোগ মানতে নারাজ দলের নীতিনির্ধারকরা। তারা বলছেন, সংগঠনকে শক্তিশালী করতে এবং সরকার পতনের আন্দোলনকে বেগবান করতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন।
এদিকে বিএনপির সর্বশেষ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। তারপর ছয় বছর পার হয়ে গেলেও কাউন্সিল অনুষ্ঠানের কোনো উদ্যোগই নিতে দেখা যায়নি।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে যাওয়া এবং আদালত কর্তৃক রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকার শর্ত দেওয়ার পর কাউন্সিলের আয়োজন করতে বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব অনেকটা ব্যর্থ হয়েছে। যদিও বেশ কয়েকবার সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে কার্যত সফলতার মুখ দেখেনি দলটি। বরং তৃণমূল পর্যায়ে কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণের কারণে সাংগঠনিক অবস্থা আরও দুর্বল ও ভঙ্গুর হয়েছে। এ কারণে ও স্থবির হয়ে পড়ছে বিএনপির সাংগঠনিক কার্যক্রম।
এসব বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘দল পুনর্গঠন চলমান প্রক্রিয়া। অনির্বাচিত সরকারের নানা প্রতিবন্ধকতায় বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে তা শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু তৃণমূলে গতি আনতে পুনর্গঠনের অবশিষ্ট কাজ দ্রুত শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা অগ্রসর হচ্ছি। আশা করছি- দ্রুত সময়ের মধ্যে দাবি আদায়ে আন্দোলনের জন্য দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে পুনর্গঠনের কাজ শেষ করতে পারব।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দ্বন্দ্ব, বিভক্তি, বিভাজন আর ‘ভাইয়া সিন্ডিকেট’র কাছে অসহায় বিভিন্ন ইউনিট, ওয়ার্ড ও থানা বিএনপির নেতা-কর্মীরা। বাদ যায়নি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির রাজনীতিও। নির্দিষ্ট সময়েও দলীয় পরিচয় পাচ্ছেন না নেতা-কর্মীরা। কিছুটা অভিমান ও ক্ষোভে নিষ্ক্রিয় দুঃসময়-দুর্দিনের পরীক্ষিত নেতা-কর্মীরা।
সম্প্রতি রাজধানীর উত্তরায় নেতা-কর্মীদের ক্ষোভের মুখে পড়তে দেখা গেছে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি সদস্য সচিব আমিনুল হককে। ফলশ্রুতিতে তাকে কমিটি গঠন না করে বিক্ষোভের মুখে ফেরত আসতে হয়েছে। যদিও ব্যর্থতা ঢাকতে সরকারের দমন-পীড়ন, করোনা মহামারিকে দায়ী করছেন নগর বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘প্রতিটি ওয়ার্ডের ইউনিট কমিটিগুলো কাউন্সিলের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ করা হচ্ছে। ওয়ার্ড ও ইউনিট কমিটি শেষে থানা কমিটির কাউন্সিলের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বড় দলে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকাটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে কিছু সমস্যা থাকে, যা চাইলেই অস্বীকার করা যায় না। একটি কথা স্পষ্ট- অতীতে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তারা বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে যথাসাধ্য অবদান রেখেছেন। তবে কতটুকু অবদান রাখতে পেরেছেন, সেটা সবাই অবগত।
যদিও মহানগর বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, সরকার পতনের আন্দোলনে যাওয়ার আগেই কমিটি পুনর্গঠনের মাধ্যমে সাংগঠনিকভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। অন্যথায় মাঠের রাজনীতিতে কার্যত কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা। তারা বলছেন, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে নানান বিভক্তি ও বিভাজন বিরাজ করছে। ফলে সময় যতই গড়াচ্ছে কেন্দ্রের নেতাদের সঙ্গে কর্মীদের দূরত্ব ততোই বাড়ছে। সাংগঠনিকভাবে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে মহানগর বিএনপি নেতৃত্বকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এক সময় সেটা বুমেরাং হয়ে দেখা দেওয়ার শঙ্কা থাকছে।
অবশ্য দল পুনর্গঠনের সঙ্গে জড়িত নেতারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরেই দলের বিভিন্ন ইউনিট ও ওয়ার্ডের সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা। কেন্দ্রীয় নির্দেশনা বাস্তবায়নে তারা কাজ করছেন। তবে সম্মেলনের মধ্যে দিয়ে যে সমস্ত কমিটি গঠন হচ্ছে তাতে কমিটি গঠনে অর্থের লেনদেন বা কমিটিতে অনুপ্রবেশকারী ঢোকার সুযোগ নেই।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালাম ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘নগর বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে কাজ হচ্ছে। যেসব ওয়ার্ড-ইউনিটের সম্মেলন শেষ হয়েছে সেখানে কমিটি গঠনে কোনো ধরনের অনিয়ম হচ্ছে না। কারণ কখনো আলোচনায়, কখনো তৃণমূল নেতা-কর্মীদের প্রত্যক্ষ ভোটে পুনর্গঠন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। কমিটি গঠন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন মহানগর দক্ষিণ বিএনপির এ নেতা।
তিনি বলেন, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা আছে। কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে কোন্দল বা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বলতে যা বুঝায় তা মহানগর বিএনপির রাজনীতিতে নেই।
বিএনপির দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বিএনপির ৮২টি সাংগঠনিক ইউনিট রয়েছে। এরমধ্যে পাঁচটি জেলায় কাউন্সিল সম্পন্ন হয়েছে। ৩০টি পূর্ণাঙ্গ কমিটির মধ্যে ৬টির মেয়াদ আছে। ৫১টি আহ্বায়ক কমিটির প্রায় সবগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ।এগুলোর আহ্বায়ক কমিটি গঠন হয়েছিল ২০১৪ ও ২০১৬ সালে। আর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন হয়েছিল ২০০৯ সালে।
অথচ দলের গঠণতন্ত্র অনুযায়ী প্রত্যেক জেলা ও মহানগর কমিটির মেয়াদ দুই বছর। মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাসের মধ্যে কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।এতে ব্যর্থ হলে যুক্তিসংগত কারণ দেখিয়ে আরও তিন মাস সময় নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ সময়েও কমিটি গঠনে ব্যর্থ হলে পূর্ববর্তী কমিটি বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে। এরপর কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠনের শর্তে তিন মাসের জন্য কেন্দ্র থেকে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে দেওয়া হবে। আর আহ্বায়ক কমিটিও ব্যর্থ হলে কেন্দ্র থেকে কমিটি গঠন করে দেওয়ার নিয়ম রয়েছে গঠনতন্ত্রে। কিন্তু এসব নিয়মের কোনো কিছুই মানা হচ্ছে না।
ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমান উল্লাহ আমান ঢাকাপ্রকাশ-কে, বলেন, ‘প্রথমে ইউনিট কমিটি থেকে শুরু করেছি, ধারাবাহিকভাবে ওয়ার্ড ও থানা কমিটির কাউন্সিল শেষ করব। এরপর মহানগর কমিটিকে সংগঠিত করব যেন আগামী দিনের আন্দোলন সংগ্রামের উপযোগী করে গড়ে তোলা যায়। সেই লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘আমরা মহানগরের তৃণমূল থেকে সংগঠনকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি ওই সাংগঠনিক শক্তির মাধ্যমে অনির্বাচিত এ সরকারের পতন ঘটিয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হব। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে, দেশে গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরে আসবে। জবাবদিহি ও জনপ্রতিনিধিত্বের সরকার দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হবে।
এনএইচবি/এসএন