নতুন বাজেট বাস্তবায়নেই শঙ্কা
করোনার ধকল না কাটতেই বৈশ্বিক রাজনীতি ও অর্থনীতি নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি। এর প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে। নিত্যপণ্যের চড়া দামে সাধারণ মানুষের ত্রাহি অবস্থা। মূল্যস্ফীতির পাগলা ঘোড়ার দৌড়ে ব্যয় কুলাতে পারছে না জনগণ। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বৃহম্পতিবার ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য প্রায় পৌনে সাত লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছে। এতে আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা।
তারমধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে আয় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতি দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা। বিশাল এই ঘাটতি পূরণে বিদেশি ও দেশের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজেটে অর্থের জোগান থেকে শুরু করে বাস্তবায়নে শঙ্কা রয়েছে।
বাজেটের রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ে স্বচ্ছতা নিয়ে শুরু হয়েছে টানাহ্যাচড়া। কারণ আমদানি ব্যয় মেটাতে টাকা অবমূল্যায়ন সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ডলারের দাম ৯২ টাকা হয়েছে। রিজার্ভ কমে ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে গেছে। বাজার সামলাতে ব্যাংকের কাছে প্রায় প্রতিদিন ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারপরও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে, রাজস্ব বাড়াতে তাগিদ দেওয়া হলেও ব্যক্তির করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো হয়নি। যা খুবই দরকার ছিল বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডলারের সংকট দুর করতে ও আমদানি ব্যয় মেটাতে সরকার বাজেটে বিভিন্ন সময়ে পাচার করা টাকা আনতে জোড়ালোভাবে পদক্ষেপ নিয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ‘বিভিন্ন সংস্থা অর্থ পাচাররোধে কাজ করছে। তাই বাইরে থেকে টাকা ফেরতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যারাই দেশে টাকা ফেরত আনবে তাদের ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। আইন করেই তাদের সেই সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে। বাজেটে তা ঘোষণা করা হয়েছে। কাজেই যারা দেশে টাকা পাঠাবে তাদের ভয়ের কিছু নেই। গোপনীয়তা মানা হবে। এটা দেশের জন্য করা হচ্ছে। এ কাজে কেউ বাধা দেবেন না।’
তারপরও অর্থনীতিবিদ এবং শীর্ষ ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, এই প্রক্রিয়া অনৈতিক। শুধু তাই নয়, এটা কোনোভাবেই সমর্থন যোগ্যও নয়।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, ‘পাচার করা টাকা কর দিয়ে দেশে আনার যে সুযোগ দেওয়া হয়েছে, এতে সৎ করদাতাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। এটা অনৈতিক। এটা থেকে কোনো অর্থ আসবে না। কারণ যারা দেশের বাইরে টাকা পাচার করে, তারা দেশে ফিরে আসার জন্য টাকা পাচার করে না।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনও বলেছেন, ‘৭ শতাংশ কর পরিশোধের মাধ্যমে বিদেশ থেকে পাচার করা টাকা ফেরত আনার প্রস্তাব অনৈতিক ও বেআইনি। এসব অর্থ বৈধ হয়ে গেলে এর বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারবে না আয়কর কর্তৃপক্ষসহ কোনো কর্তৃপক্ষ।’
শুধু তাই নয়, ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিনও বলেছেন, ‘ব্যবসায়ীরা ২৭ শতাংশ ভ্যাট দিয়ে ব্যবসা করে। এ ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়। আর কেউ বিদেশে টাকা পাচার করেছে, সে টাকা দেশে আনা হলে সৎ ব্যবসায়ীরা উৎসাহ হারাবে। ডলারের সংকট দূর করতে সরকার হয়ত পাচার করা টাকা আনার কথা বলছে। কিন্তু আমরা এটা সমর্থন করি না। কারণ পাচার করা অর্থ দেশে আনা হলে ভালো ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হবেন।’
আবার করোনার ধকল সামলে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের তাপে দেশের মূল্যস্ফীতি সবাইকে দগ্ধ করে তুলেছে। সংশ্লিষ্টরা প্রত্যাশা করলেও পরিত্রাণের ইতিবাচক দিক এখনও অস্পষ্ট। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কমানো হয়নি অনেক নিত্যপণ্যের দাম। এ ছাড়া বাজেট ঘোষণার দিনই সয়াবিন তেলের দাম লিটারে ৭ টাকা বাড়িয়ে ২০৫ টাকা লিটার করা হয়েছে। বিভিন্ন খাতে বেশি করে ব্যয় করতে গিয়ে দেশি-বিদেশি যে ঋণের সুদ আসবে সেটি পরিশোধেই সর্বোচ্চ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি। যা মোট ব্যয়ের ১৯ দশমিক দুই শতাংশ।
কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দেশীয় শিল্পকে রক্ষায় অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে আমদানিকৃত পণ্যের উপর। এমনকি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য থাকলেও ল্যাপটপ আমদানিতেও কর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এ সব কারণে আগামীর বাজেট ব্যবসাবান্ধব হলেও জনবান্ধব নয় বলে স্পষ্ট জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা।
কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি ও দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেছেন, ‘বাজেটে কোথাও বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে আবার কোথাও কমানো হয়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে আমরা যে সংকটকালীন অবস্থায় আছি, সেই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কোনো ইনোভেটিভ প্রস্তাব এই বাজেটে আসেনি। বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থচিন্তা করে বাজেট তৈরি হয়েছে। জনস্বার্থ রক্ষা করা হয়নি।
করোনার প্রভাবে অনেকে বেকার ও কর্মহীন হয়ে পড়েছে। দরিদ্র ও অতিদরিদ্রের হার ২০ দশমিক পাঁচ শতাংশ এবং ১০ দশমিক পাঁচ শতাংশ থেকে বেড়ে গেছে। অথচ সামাজিক নিরাপত্তাখাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ দশমিক আট শতাংশ। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ভর্তুকি ও প্রণোদনায় ৮২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ব্যয় করার প্রস্তাব করেছেন। যা চলতি অর্থবছরে ছিল ৫৩ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এটা এক বছরের ব্যবধানে বাড়লেও তা আশানুরুপ নয়। কারণ করোনায় বেকারত্ব অনেক বেড়ে গেছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেকে।
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, এ বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুশাসন। যথাযথ মনিটরিং, বিনিয়োগ ও উৎপাদন বৃদ্ধি এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আদায় করতে হবে। ব্যক্তি করমুক্ত আয়সীমা আগের মতোই তিন লাখ টাকা প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। তা বাড়ানো দরকার।’
কোভিভ-১৯ পরিস্থিতি এবং রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি, খাদ্যপণ্য, পণ্যের কাঁচামালের মূল্য এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় সব ধরনের দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ অবস্থায় আগামী বাজেট বাস্তবায়নের বড় চ্যালেঞ্জ হবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা।
কঠিন সময়েও বাজেটের আকার রেকর্ড পরিমান বাড়ানো হয়েছে। ৬ লাখ সাড়ে তিন হাজার কোটি থেকে বাড়িয়ে ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। কিন্তু এই ব্যয়ের মধ্যে আড়াই লাখ কোটি টাকাই খরচ হবে উন্নয়ন খাতে। তাই এই ব্যয়ের ক্ষেত্রে দক্ষদের যুক্ত করার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কারণ উন্নয়ন ব্যয়ের নামে এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তারা হরিলুট করছে। অযথা বিদেশ ভ্রমন, শিক্ষা সফরের নামে ব্যয় করছে। যেসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড হচ্ছে সেগুলোতে অনিয়ম-দুর্নীতি হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে হাওড়ে বাঁধ নির্মাণেও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এই অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধের উপর জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।
সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান বলেছেন, ‘নাগরিকদের আর্থ-সামাজিক সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রবৃদ্ধি সচল রাখতে হবে। ঢালাওভাবে সব কোম্পানির জন্য উৎসে কর বাড়ানো, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ ও ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের উপর কর বৃদ্ধি, এবং পাচার করা টাকা দেশে ফিরিয়ে আনার সুযোগ রাখার যে প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে সেগুলো অবশ্যই পুনর্বিবেচনা করতে হবে’।
ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) এর প্রেসিডেন্ট মো. মামুনুর রশিদ বলেন, ‘৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে ৬ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এতে ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি থাকছে। করোনা পরবর্তী সময়ে এ বিশাল বাজেট অর্জন সরকারের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ। বাজেট বাস্তবায়নে প্রফেশনালদের সম্পৃক্ততা আব্যশক। ব্যক্তিশ্রেণির সর্বোচ্চ করমুক্ত আয়সীমা ৪ লাখ টাকা করা দরকার।’
জেডএ/এনএইচবি/আরএ/