উন্নয়ন প্রকল্পে গলদ-২
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশও যেখানে উপেক্ষিত
চিকিৎসক ও নার্সদের বসবাসের জন্য নির্মিত ২১টি ভবনে বসত গেড়েছে ঝোপঝাড় আর বটগাছ। এসব ভবন নির্মাণে সরকারের অর্থ খরচ হয়েছে ১৩৯ কোটি টাকা। কিন্তু সাত বছরেও চিকিৎসক-নার্সের দেখা পায়নি ভবনগুলো। ভবনগুলো হস্তান্তরও করা হয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ উপেক্ষা করে নির্ধারিত সময়ের আগেই ২৬ কোটি টাকার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। সেগুলো এখন অকেজো। আড়াই কোটি টাকার আসবাবপত্রও পরিণত হয়েছে ময়লা আবর্জনার স্তুপে।
উপরের এই চিত্র উঠে এসেছে গোপালগঞ্জ শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৩০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই হাসপাতালের উদ্বোধন করেন। এরপর এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ রোগী চোখের চিকিৎসা নিয়েছেন।
প্রান্তিক পর্যায়ে চক্ষু সেবা নিশ্চিত করতে ১৭৭ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে সমাপ্ত এই প্রকল্পের কাজ কতোটা কার্যকর হয়েছে- তা জানতে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আওতায় বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রভাব মূল্যায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করে। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুযায়ী প্রকল্প কার্যক্রম হয়েছে কি না সেই চিত্র এই প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদনে।
এই প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে জানতে চাইলে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বিভাগের সচিব প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, ‘প্রকল্প অনুমোদনের সময় প্রধানমন্ত্রী ভালোভাবে সব কিছু দেখে থাকেন। এসময় কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে অনুশাসন দিয়ে থাকেন। কাজেই সব মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
কিন্তু শেখ ফজিলাতুন্নেছা চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন প্রকল্পে সেটা মানা হয়েছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ‘শুনেছি এই প্রকল্পে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে। চূড়ান্ত রিপোর্ট পেলে কেউ জড়িত থাকলে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘সব মন্ত্রণালয়কেই প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ মেনে কাজ করা উচিত।’
প্রতিবেদনে যত অনিয়ম উঠে এসেছে
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষ হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন প্রকল্পে অসংখ্য অনিয়ম পেয়েছে আইএমইডি। এরমধ্যে একটি হচ্ছে বিশেষায়িত এই হাসপাতালটিতে এখনো সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়নি। ফলে জেনারেল অ্যানেস্থেসিয়া কার্যক্রম চালু করা যায়নি। ফলে মুমূর্ষু রোগী ও শিশুদের চক্ষু রোগের অপারেশন জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
এই হাসপাতালে আজও সমাজসেবা অধিদপ্তরের কোনো কার্যক্রম শুরু করা যায়নি। ফলে হতদরিদ্র ও প্রতিবন্ধী রোগীরা বিনা পয়সার চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। প্রকল্প প্রণয়নের সময় কোনো এক্সিট প্লান প্রস্তুত করা হয়নি।
প্রতিবেদনে একটি বড় সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে। হাসপাতালের মূল ভবনের ছাদে পানি জমে স্থাপত্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সোলার প্যানেলগুলো অকেজো হয়ে গেছে। অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) নার্সদের টয়লেট ও চেঞ্জ রুমের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। বহি:বিভাগের টয়লেটের কমোড ও বেসিন ভেঙে পড়ায় ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে এগুলো এখন তালাবদ্ধ। হাসপাতাল ভবনের লাইব্রেরিটিও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা যায়নি।
দেশের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোর মানুষকে সেবা দেওয়া তো বটে, রাজধানী ঢাকার চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের উপরও চাপ কমাতে সরকার বিশেষায়িত এই হাসপাতালটি নির্মাণ করে। কিন্তু এখানেও চিকিৎসক সংকট। ৯১টি পদের বিপরীতে কর্মরত চিকিৎসকের সংখ্যা মাত্র ২৮ জন। পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও নার্স না থাকায় রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
অপরদিকে, চিকিৎসক ও নার্সদের জন্য ১৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ২১টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। দুই বছর পরপর ওই ভবনগুলো রক্ষণাবেক্ষণের কথা। অথচ ২০টি ভবন-ই এখনো হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
এসব ভবনের মধ্যে সিনিয়র চিকিৎসকদের জন্য ১৫০০ বর্গফুট, ১২৫০ বর্গফুট ও ১০০০ বর্গফুটের আবাসিক ভবন করার পর সাত বছর পার হয়ে গেছে। কিন্তু ভবনগুলো কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। ভবনের ছাদে পানি জমে জলছাদ নষ্ট হয়ে গেছে। ১২৫০ বর্ঘফুটের অফিসার্স কোয়াটারটির আশপাশ এখন পরিণত হয়েছে বন-জঙ্গলে। ভবনের ছাদে গজিয়েছে বট গাছ। সব মিলিয়ে ভবনগুলো ব্যবহারের আগেই ব্যবহার অনুপোযোগি হয়ে গেছে।
একই অবস্থা সিনিয়র নার্সদের জন্য কোয়ার্টার ভবনটির। দীর্ঘ দিন অব্যবহৃত থাকায় বিভিন্ন স্থানে রং নষ্ট হয়ে গেছে। আশপাশ জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। দেখা দিয়েছে সাপের উপদ্রব। আর ভবনের নিচে সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্তের।
এ ছাড়া পুরুষ ও মহিলা স্টুডেন্ট হোস্টেল দুটিও হস্তান্তর না হওয়ায় উইপোকা বাসা বেধেছে। কয়েকটি অংশে পরেস্তরা খসে পড়েছে ও রং নষ্ট গয়ে গেছে। এ কারণে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভবন দুটি।
শুধু বিভিন্ন ভবনই নয়, বিদ্যুৎ সবররাহের জন্য নির্মাণ করা সাব-স্টেশন ভবনটিও হস্তান্তর করা হয়নি।
যন্ত্রপাতি কেনা হয় দুই বছর আগে
বিশেষায়িত এই হাসপাতালে রোগীদের সেবা দেওয়ার জন্য নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্রকল্পের আওতায় কেনা হয়েছে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুশাসন দিয়েছিলেন নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার পর যন্ত্রপাতি ও আবসাবপত্র যেন কেনা হয়। কিন্তু কে শুনে কার কথা। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মত অবস্থা হয়েছে শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতালের ক্ষেত্রে।
প্রকল্পের কাজ শেষ হয় ২০১৫ সালের জুনে। অথচ কাজ শেষ হওয়ার তিন বছর তিন মাস আগে ২০১২ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে হাসপাতালের জন্য ১২৬টি যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। কিন্তু এগুলো ব্যবহার করা যায়নি। কারণ এগুলোর ওয়ারেন্টি পিরিয়ড শেষ হয়ে গেছে। আর ৫৯টি অচল হয়ে গেছে। এতে সরকারি অর্থের অপচয় হয়েছে। রোগীরাও বঞ্চিত হচ্ছেন সেবা থেকে। তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গোপালগঞ্জ জেলার বিভিন্ন ক্লিনিকে যেতে হচ্ছে।
প্রকল্প শেষ হয়নি যথাসময়ে
প্রান্তিক পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে সরকার গোপালগঞ্জে একটি ১০০ শয্যার বিশেষায়িত চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। ২০১০ সালের ১১ মে ১৮৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন’ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। ডিপিপি অনুযায়ি ২০১৩ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় ডিপিপি সংশোধন করে সময় বাড়ানো হয় ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। ১৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৬২ হাজার ৩৬৫ বর্গমিটারের ২১টি ভবন এর অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে।
গাড়ি গেল কোথায়?
এই হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজের সুবিধার্থে তিনটি গাড়ি কেনা হয়েছিল। প্রকল্প পরিচালক ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ২০১১ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রকল্পের আওতায় গাড়িগুলো কেনা হয় এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে। এসব গাড়ির জন্য গ্যাস ও জ্বালানিতে ব্যয় করা হয়েছে ২১ লাখ টাকা। কিন্তু প্রকল্পের কাজ শেষ হয়ে গেলেও গাড়িগুলো এখন পর্যন্ত সরকারি পরিবহনপুলে জমা হয়নি।
প্রকল্পের প্রভাব মূল্যায়ন প্রতিবেদেন আরও উঠে এসেছে, নার্স প্যারামেডিক্যাল ও ডাক্তারদের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়নের কথা বলা হলেও ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত কোনো প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়নি। নেই চক্ষু সংক্রান্ত রোগের বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রমও।
গোপালগঞ্জ জেলা সদরে প্রায় ৪৫ বিঘা জমিতে গড়ে উঠা এই হাসপাতালটির আরও অনেক সমস্যার কথা উঠে এসেছে আইএমইডি’র প্রতিবেদনে।
জেএ/এনএইচবি/আরএ/