ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৫৫
দ্য ফার্স্ট ম্যান
পরের দিন ম্যানেজার সব কর্মকর্তা কর্মচারীকে তার রুমে ডাকলেন হাতে হাতে বেতন দেওয়ার জন্য। জ্যাকের দিকে তাকিয়ে একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই নাও, বাছা। জ্যাক দ্বিধান্বিত হাত বাড়াল। তিনি হাসিমুখে বললেন, তোমার কাজ বেশ ভালো হচ্ছে। তোমার বাবা-মাকে জানিয়ে দিতে পারো।
জ্যাক ততক্ষণে কথা বলা শুরু করেছে এবং জানাতে থাকে, সে আর আসবে না। ম্যানেজার বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। তার খাম ধরা হাত তখনও জ্যাকের দিকে প্রসারিত। তিনি জিজ্ঞেস করেন, কেন? জ্যাককে তখন মিথ্যা বলতে হবে। কিন্তু মিথ্যা তার মুখ দিয়ে বের হবে না। জ্যাকের দুঃখী চাহনির দিকে তাকিয়ে থেকে ম্যানেজার বুঝতে পারেন এবং জিজ্ঞেস করেন— ও, তাহলে তুমি লিসেতে ফিরে যাবে?
হ্যাঁ, উত্তর দেয় জ্যাক। ভয় আর অসহায়ত্বের মধ্যে আকস্মিক স্বস্তির সম্ভাবনা তার চোখে জল নিয়ে আসে।
উত্তেজিত হয়ে ম্যানেজার দাঁড়িয়ে পড়লেন, তুমি যখন এখানে কাজ নিলে তখন তুমি জানতে তোমাকে ফিরে যেতে হবে। তোমার নানিও জানতেন নিশ্চয়ই! জ্যাক শুধু মাথা ঝাঁকিয়ে ইতিবাচক অর্থটাই প্রকাশ করতে পারে। ম্যানেজারের কণ্ঠ থেকে বজ্র নিনাদ ঝড়ে পড়ে। তিনি বুঝতে পারছেন, তারা অসৎ। তিনি অসততা পছন্দ করেন না। তিনি যদি জানতে পারতেন তার অধিকার আছে জ্যাককে বেতন না দেওয়ার, তিনি যদি জানতে পারতেন তাকে বোকা হতে হবে! না, তিনি বেতন দেবেন না। তার নানিকে আসতে হবে। তাকে সাদরে স্বাগত জানানো হবে। শুরুতে তারা যদি তাকে সত্য কথাটা বলত তবু হয়ত তিনি জ্যাককে কাজে নিতেন। কিন্তু কী ভয়ংকর কথা লিসেতে তার থাকার সাধ্য নেই, তারা খুব গরিব, তাকে কাজে নিতেই হবে!
বিমূঢ় জ্যাক শুধু বলতে পারে, শুধু ওই কারণেই।
কেন ওই কারণে?
কারণ আমরা গরিব। তারপর জ্যাক নীরব হয়ে যায়। তার দিকে তাকিয়ে ম্যানেজার বলতে থাকেন, ওই কারণেই তুমি এরকম একটা কাজ করতে পারলে? ওই কারণেই এরকম একটা কাহিনি ফাঁদলে? জ্যাক শক্ত মুঠিতে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকে। অন্তহীন নীরবতা ঘিরে ধরে। তারপর ম্যানেজার টেবিল থেকে খামটা নিয়ে জ্যাকের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলেন, নাও তোমার বেতন। এবার ভাগো এখান থেকে।
জ্যাক বলে, না।
এবার ম্যানেজার খামটা জ্যাকের পকেটের মধ্যে ঠেসে দিয়ে বলেন, ভাগো এখন!
রাস্তায় নেমে জ্যাক দৌড়তে থাকে। কাঁদতে কাঁদতে সে দুহাতে শার্টের কলার চেপে ধরে যাতে পকেটের টাকার সঙ্গে তার হাতের ছোঁয়া না লাগে।
ছুটি না কাটানোর অধিকারের জন্য মিথ্যা বলা, গ্রীষ্মের আকাশ এবং তার ভালোাবাসার সমুদ্র থেকে দূরে কাজ করা এবং লিসেতে ফিরে আসার উদ্দেশে কাজ ত্যাগ করতে গিয়ে মিথ্যা বলা— এসব অবিচার তাকে প্রচণ্ড দুঃখী করে তোলে। এসবের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ছিল মিথ্যা বলা। অবশ্য সে মিথ্যা বলতে পারত না এবং মিথ্যা বলতে হয়নি। আনন্দ-ফুর্তি করার ক্ষেত্রে সে মিথ্যা বলতে প্রস্তুত ছিল। কিন্তু প্রয়োজনের ক্ষেত্রে মিথ্যা বলা তার পক্ষে কঠিন। কাজ করার কারণে তার সবচেয়ে প্রিয় ছুটিটাই হারাতে হয়েছে, তার কাছ থেকে তার ছুটির অধিকার হরণ করা হয়েছে। এখন শুধু তাড়াহুড়ো করে শুরু হওয়া এবং দ্রুত ধাবমান বিষণ্ন দিনগুলো ছাড়া বছরের সামনের দিনগুলোতে আর কিছু নেই। দারিদ্রের মধ্যে থেকেও পেটুকের মতো করে যেসব রাজকীয় আনন্দ এবং অপূরণীয় সম্পদ উপভোগ করতে পারত সেগুলো হারাতে হয়েছে সামান্য কয়েকটা টাকা উপার্জনের জন্য, ওই কয়টা টাকা দিয়ে তার আনন্দের লক্ষ ভাগের এক ভাগও কেনা যাবে না। তবু সে বুঝতে পারে, ওই কাজটা না করলে তার উপায় ছিল না। কাজটা করার সময় সে অন্য সময়ের চেয়ে অনেকখানি বেশি বিদ্রোহী ছিল। কাজটা করার পরে তার গর্বও হয়েছে। মিথ্যা বলার অসহায়ত্বের ক্ষতিপূরণ সে প্রথম বেতনের দিনই পেয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে প্রথমেই খাবার ঘরে ঢুকে দেখতে পেল, তার নানি আলুর খোসা ছড়িয়ে বেসিনের পানির মধ্যে ছুড়ে মারছেন। আর্নেস্ট মামা বসে তার দুপায়ের মাঝে ধরে রাখা কুকুর ব্রিলিয়ান্টের গা থেকে মাছি তাড়ান। মা কিছুক্ষণ আগে ফিরেছেন এবং দেয়ালের পাশের ড্রয়ারের মতো জায়গাটা থেকে ধোয়ার জন্য এক স্তুপ কাপড় বের করছেন। জ্যাক সরাসরি এগিয়ে গিয়ে টেবিলের ওপর একশো ফ্রাঁ এবং একটা মুদ্রা রাখল। সারা পথ সে মুদ্রাটা হাতের মুঠোয় ধরে বাড়ি ফিরেছে। কোনো কথা না বলে নানি তার দিকে বিশ ফ্রাঁ এগিয়ে দিলেন এবং বাকিটা নিয়ে নিলেন। হাত দিয়ে ক্যাথরিন করমারির গা ছুঁয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললেন, তোর ছেলে একটা কাজের মতো কাজ করেছে।
মায়ের দুঃখী চাহনি ছেলেকে আদর করে দিল। মা মুখে বললেন, হ্যাঁ।
অর্নেস্ট মামার পায়ের মাঝখানে ধরা ব্রিলিয়ান্ট ভাবল, তার কঠিন পরীক্ষা শেষ। তবে মামা কুকুরটাকে পায়ের মধ্যে ধরে রেখই বলল, ভালো, ভালো। বড় হয়ে গেছ।
সে অবশ্যই বড় হয়ে গেছে, তার ঋণের খুব অল্প একটা অংশ হলেও সে শোধ করে দিতে পেরেছে। সামান্য ওই টাকা দিয়ে পরিবারের দারিদ্র কিছুটা কমাতে পেরেছে— এই ধারণাটা তার মনকে কিছুটা দুষ্ট অহংকারে ভরে তুলল। এরকম অহংবোধ মানুষের মনে এসে থাকে যখন সে স্বাধীনবোধ করে এবং বুঝতে পারে, কোনো কিছুর কাছে, কারো কাছে তাকে আর অধীন হয়ে থাকতে হবে না। পঞ্চম বর্ষের ক্লাস শুরুর প্রথম দিন লিসের চত্বরে পা রেখেই বুঝতে পারে, সে আগের মতো নেই; চার বছর আগে বেলকোর্ট ছেড়ে প্রথম যেদিন এসেছিল সেদিনের মতো অচেনা সে নয়। সেদিন পায়ের তলার পুরু তলিঅলা জুতা পরে কেমন যেন টলোমলো মনে হচ্ছিল। অচেনা যে জগৎ তার জন্য অপেক্ষা করছিল সে জগৎ সম্পর্কে তার মনের ভেতর অনেক অজানা আশঙ্কা ছিল। কিন্তু আজ তার সহপাঠীদের দিকে সে যে চাহনি নিয়ে তাকাচ্ছে সে চাহনির মধ্যে নিষ্পাপ ভাবটা অনেকখানি অনুপস্থিত। তা ছাড়া ওই সময়ের মধ্যে তাকে শৈশব থেকে অনেক কিছুই ওপরের দিকে টেনে নিয়ে গেছে। সেদিনের আগ পর্যন্ত সে নানির হাতের প্রচণ্ড মার খেয়ে এসেছে বিনা প্রতিবাদে যেন মার খাওয়া বাল্যবেলার একটা অপ্রতিরোধ্য বাধ্যবাধকতা। কিন্তু এখন জ্যাককে মারতে গেলে সে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে যদি তার হাত থেকে চামড়ার চাবুকটা কেড়ে নেয়— এই ভয়ে নানি একদিন নিজের রুমের দিকে ফিরে গিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদা শুরু করলেন। বুঝতে পারলেন, এতদিন ধরে এই অস্বাভাবিক শিশুকে বড় করেছেন। এটা তার দুর্ভাগ্য। তার আফসোসের আরও কারণ হলো, জ্যাককে তিনি আর কখনো মারতে পারবেন না। বাস্তবে অবশ্য তা-ই হয়েছিল, জ্যাককে আর মারতে পারেননি তিনি। কারণ, ততদিনে এই হালকা পাতলা পৌরুষদীপ্ত কিশোরের মধ্য থেকে আগের সেই বালকটি হারিয়ে গেছে। ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল এবং আগুনে চাহনির এই যুবক গ্রীষ্মের গোটা সময় কাজ করে পরিবারের জন্য উপার্জন করেছে। সে লিসের ফুটবল দলের প্রথম সারির গোল রক্ষক। দিন তিনেক আগে জীবনে প্রথমবারের মতো সে একটা মেয়ের ঠোঁটের কম্পমান স্পর্শও লাভ করে ফেলেছে।
হ্যাঁ, এই বালকের জীবন এরকমই ছিল। দারিদ্র-দ্বীপের প্রচণ্ড প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত প্রতিবেশের জীবন এরকমই ছিল। অজ্ঞ আর প্রতিবন্দ্বী পরিবারে উঠতি যুবা বয়সের টগবগে রক্তের বয়সে অজানা এক জগৎ তার জীবনের জন্য প্রচণ্ড ক্ষুধা, বশ না মানা ক্ষুধার্ত ধীশক্তি এবং সর্বদা আনন্দের উত্তুঙ্গ মানসকে প্রত্যাঘাতে ধরাশায়ী করতে চেষ্টা করেছে। মুহূর্তের জন্য সে লজ্জিত বোধ করেছে। আবার উঠে দাঁড়িয়েছে, শিখতে চেষ্টা করেছে এবং বুঝতে চেষ্টা করেছে এই অচেনা জগৎ। এই জগতৎ সে নিজের ভেতর ধারণ করার চেষ্টা করেছে। কারণ সে এই জগৎ নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ধরার চেষ্টা করেছে। সে সামনে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে। তবে নিজেকে ছোট করে নয় এবং শেষমেষ সে যে আত্মবিশ্বাস পায়নি তা নয়। হ্যাঁ, এক ধরনের নিশ্চয়তা সে পেয়েছে যেহেতু সে নিশ্চিত হতে পেরেছে, সে যা মনপ্রাণ দিয়ে চায় তা সে পাবে। যা কিছু এই জগতের এবং শুধুই এই জগতের সেসবের কোনো কিছুই তার কাছে অসম্ভব হয়ে থাকবে না। যে কোনোখানে একটুখানি ভরসার জায়গা পাওয়ার জন্য সে নিজেকে প্রস্তুত করছিল। ছেলেবেলার শূন্যতা নিয়েই সে নিজেকে প্রস্তুত করছিল। কারণ কোনো উচ্চাভিলাষী আসন সে চায়নি। সে শুধু চেয়েছে আনন্দ, মুক্ত প্রাণশক্তি, উদ্যম এবং জীবনে যা কিছু ভালো এবং পয়সার কাছে বিকিয়ে দিতে হয় না এমন কিছু। এমনকি দারিদ্রের বলই নিজেকে সে প্রস্তুত করতে থাকে, যাতে একদিন পয়সা না চেয়ে, পয়সার কাছে নতিস্বীকার না করে, পয়সা গ্রহণ করতে পারে, ঠিক এখন চল্লিশ বছর বয়সী জ্যাক যেমন অনেক দোদুল্যমান হয়েও অনেকখানি নিশ্চিত যে, অন্যসব মানুষের মধ্যে সবচেয়ে নিঃস্ব যারা তাদের চেয়েও নিঃস্ব সে, একমাত্র মা ছাড়া আর কেউ নেই তার। এভাবেই সে জীবন পার করেছে সমুদ্রের ধারে, ঝড়ো বাতাসের মধ্যে, খোলা রাস্তায়, গ্রীষ্মের খরতাপের নিচে, সংক্ষিপ্ত শীতের ভারী বর্ষণ-তলের খেলাধুলার মধ্যে। জীবন পার করেছে সে বাবা ছাড়া। উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো কিছুই পায়নি সে। জীবনে একটি বছরের জন্য বাবাকে খুব দরকার ছিল। চারপাশের মানুষজন আর বিভিন্ন বিষয় থেকে শিক্ষা লাভ করেছে। যে জ্ঞান তার কাছে নিজেই এসে হাজির হয়েছে সে জ্ঞান দিয়েই সে বুঝে নিয়েছে, কখন কোনো আচরণের আদব শিখতে হবে এবং নিজের উত্তরাধিকার নিজেই তৈরি করতে হবে। তার পরিস্থিতির জন্য কখনো যথেষ্ট মনে হয়েছে সেই আদব, কখনো বা পৃথিবীর ক্ষতের মুখোমুখি হলে পরবর্তীতে অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে।
চলবে…
আগের পর্বগুলো পড়ুন>>>
আরএ/