ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ২৭
দ্য ফাস্ট ম্যান
এই মানুষটি জ্যাকের বাবাকে চিনতেন না। তবে জ্যাকের সঙ্গে তিনি জ্যাকের বাবার সম্পর্কে পুরাণের অলৌকিক কাহিনীর মতো কথা বলতেন। একটা ক্রান্তিলগ্নে কীভাবে বাবার ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে তিনি জানতেন। সে কারণেই জ্যাক তাকে কখনও ভোলেনি। চোখে না দেখা বাবার প্রকৃত অভাব বুঝতে না পেরে যেন প্রথমত বালক বয়সে এবং পরবর্তীতে জীবনের বাকি সময়টাতে অবচেতনে জ্যাক বাবার দুপর্বেই সুচিন্তিত এবং সঙ্কটময় ভূমিকা বুঝতে পারে। ওই বিষয়টি বালক বয়সে জ্যাকের জীবনের ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। সার্টিফিকাট দে এতুদেস-এ পড়ার সময়ে তার শিক্ষক এম বার্নার্ড একটা বিশেষ সময়ে তার তত্বাবধানের এই শিশুটির ওপরে তার সমস্ত প্রভাব বিস্তার করে তার নিয়তি বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং আসলেই বদলে দিয়েছেন।
রোভিগোর আঁকাবাকা রাস্তার ধারে কাশবাহর একদম পাদদেশে অবস্থিত তার নিজের বাসভবনে এম বার্নার্ড এখন জ্যাকের সামনে। এই এলাকা থেকে শহরের অনেখখানি দেখা যায়, সমুদ্রও দেখা যায়। এখানকার অনেখকানি জায়গা জুড়ে আছে সব জাতি-ধর্মের লোকদের ছোট ছোট দোকানপাট। এখানকার বাড়িগুলো থেকে পাওয়া যায় মসলা আর দারিদ্রের গন্ধ। এম বার্নার্ড এখন বুড়িয়ে গেছেন। মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে। গণ্ডদেশ আর হাতের উজ্জ্বল কোষগুলোতে বার্ধক্যের দাগ জমা হয়েছে। চালচলনে আগের দিনের চেয়ে অনেক বেশি ধীর স্থির হয়ে গেছেন। দোকান সমৃদ্ধ রাস্তার দিকে মুখ করা জানালার পাশে হাতলঅলা রত্তন চেয়ারে ঠিক হয়ে বসতে পেরে তিনি যেন খুশি হয়েছেন। বয়স তার ব্যক্তিত্বে আরো কোমলতা দান করেছে। নিজের আবেগ বের হয়ে আসতে দিলেন তিনি। আগে অবশ্য আবেগ এতটা প্রকাশ করতেন না। শরীর এখনও তার ঋজু আছে। কণ্ঠস্বর আগের মতোই ভরাট এবং দৃঢ়। এরকম কণ্ঠেই তিনি ছাত্রছাত্রীদের সামনে দাঁড়িয়ে বলতেন, দুজন করে লাইনে দাঁড়াও, দুজন করে। তার কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের হৈচৈ ঠেলাঠেলি থেমে যেত। ছাত্রছাত্রীরা তাকে ভক্তি করত, সমীহও করত। ক্লাসরুমের বাইরে দ্বিতীয় তলার করিডোরের দেয়ালের পাশ ঘেঁষে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যেত সবাই। অবশেষে তাদের সারি সোজা হয়ে গেলে এবং হৈচৈ থেমে গেলে এম বার্নার্ডের ভরাট কণ্ঠ শোনা যেত, ত্রামুসেসে’র দল, এখন ভেতরে চলে এসো। তখন তারা কিছুটা মুক্তি পেত এবং তিনি সামনে চলার ইঙ্গিত দিতেন, তবে ধীর এবং মাপা পদক্ষেপে। সুঠাম দেহের, রুচি-সম্মত পোশাক পরিহিত, চকচকে কোমল চুলের শোভায় শোভিত সুগঠিত মুখের আদল এবং কলোনের সুগন্ধ সমৃদ্ধ এম বার্নার্ড প্রশান্ত স্থিরতায় তাকিয়ে দেখতেন তাদের।
পুরনো বসতিপূর্ণ এলাকার অপেক্ষাকৃত নতুন অংশে ছিল স্কুলটা। ১৮৭০ সালের যুদ্ধের কাছাকাছি সময়ে নির্মিত বাড়িঘর বেশিরভাগই দোতলা তিনতলা। জ্যাকের বাড়ি যে এলাকায় সে এলাকার প্রধান রাস্তাগুলোতে অভ্যন্তরের পোতাশ্রয় এবং কয়লার জাহাজঘাটার মাঝের সংযোগ হিসেবে ছিল সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি কতিপয় গুদামঘর। চার বছর বয়সে যে ভবনে জ্যাক নার্সারি স্কুল শুরু করেছিল সেখানে দিনে দুবার পায়ে হেঁটে যেতে হতো। সে সময়ের তেমন কিছুই মনে নেই, শুধু কালো পাথরের তৈরি একটা শৌচাগারের কথা মনে আছে: মাঠের এক পাশের অনেকখানি জুড়ে ছিল সেটার অবস্থান। একদিন ওখানে প্রবেশ করতে গিয়ে তার চোখের ভ্রুর ওপরে কেটে রক্ত বের হয়েছিল। সে সময়ই ডাক্তারদের সেলাইয়ের সঙ্গে জ্যাকের প্রথম পরিচয় ঘটে। প্রথম সেলাইয়ের পরে তাকে আবারো ভ্রুর আরেক পাশে সেলাইয়ের অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয়। বাড়িতে জ্যাককে হ্যাট এবং কোট পরা শিখিয়ে দিয়েছিল তার ভাই। হ্যাটটা পরলে সামনে কিছুই দেখা যেত না। আর পুরনো কোটটা পরলে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হতো। কাজেই মাথার ওপরের একটা আলগা টালির সঙ্গে ঠোকা লেগে দ্বিতীয়বার ভ্রু কেটে যায়। তবে পরে নার্সারি স্কুলে যাওয়ার সঙ্গী হিসেবে পায় পিয়েরেকে। পিয়েরে জ্যাকের চেয়ে বছর খানেকের মতো বড় ছিল। পাশেরই একটা রাস্তায় ছিল ওদের বাড়ি। পিয়েরের পরিবারে ছিলেন ওর মা, তিনিও একজন যুদ্ধ-বিধবা। পোস্ট অফিসে কাজ করতেন। ওদের পরিবারে আর ছিল রেলওয়েতে কর্মরত ওর দুজন মামা। তাদের পরিবারের মধ্যে মোটামুাট বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। পাড়ায় ওইরকম অবস্থানের লোকদের যেমনটা হয়ে থাকে আর কী। তারা একে অপরের মতামতকে গুরুত্ব দিত।
তবে বাড়িতে গিয়ে দেখা সাক্ষাৎ করার তেমন প্রচলন ছিল না। যে কোনো প্রয়োজনীয় মুহূর্তে একে অপরকে সাহায্যের মানসিকতাও ছিল তাদের। অবশ্য বাস্তবে তেমন একটা পরিস্থিতি আসেনি বললেই চলে। শুধু বাচ্চারাই একে অন্যের আসল বন্ধু হতে পেরেছে। যেমন নার্সারি স্কুলে যাওয়ার প্রথম দিন থেকেই জ্যাকের অদ্ভূত পোশাকসহ পিয়েরে জ্যাকের ট্রাউজারের ধরন সম্পর্কে সচেতন থেকেই তার দায়িত্ব নিয়ে নেয় যেহেতু সে জ্যাকের চেয়ে একটু বড়। সেদিন থেকেই তারা এক সঙ্গে স্কুলে যেতে থাকে। সার্টিফিকাট দ্য এতুদেস পর্যন্ত প্রতি ক্লাসেই তারা এক সঙ্গে যাতায়াত করেছে। জ্যাক ওই ক্লাসে ওঠে নয় বছর বয়সে। পাঁচ বছর ধরে তারা একই রাস্তায় দিনে চারবার করে যাওয়া আসা করেছে। একজনের চুল উজ্জ্বল বর্ণের, আরেকজনের বাদামী। একজন শান্ত প্রকৃতির, আরেকজন তপ্ত টগবগে। দুজনই ভালো ছাত্র এবং খেলার মাঠে অক্লান্ত। এরকম দুজনই যেন বন্ধু হওয়ার জন্য নিয়তি নির্ধারিত ছিল। কোনো কোনো বিষয়ে জ্যকের মেধা বেশি মাত্রায় ঝিলিক দিয়ে উঠত। তবে তার সার্বিক আচরণ, তার অস্থিরতা এবং নিজেকে বেশি মাত্রায় প্রকাশ করার প্রবণতার কারণে জ্যাক যতোসব বোকামিপূর্ণ কাজের দিকে ধাবিত হয়েছে। আর এ কারণে শান্ত প্রকৃতির পিয়েরের কাছেই যেন ফিরে গেছে সফলতার সুযোগসমূহ। সুতরাং দুজনই পালাক্রমে প্রথম হয়েছে। তবে পরিবারের লোকেরা কখনও কখনও গর্ব করার নজির দেখালেও তাদের মধ্যে কখনওই এ নিয়ে মাথাব্যথা দেখা যায়নি। তাদের আনন্দ ছিল ভিন্ন ধরনের। প্রতিদিন সকালে বাড়ির বাইরে পিয়েরের জন্য অপেক্ষা করত জ্যাক। ময়লা কুড়ানিদের আসার আগেই তারা রওনা হয়ে যেত। ময়লা কুড়ানি বলতে তারা প্রথমত বুঝত এক আরব বৃদ্ধ চালিত হাঁটুভাঙা একটা ঘোড়ায় টানা গাড়ি। ফুটপাতে তখনও রাতের আর্দ্রতা লেগে আছে; বাতাসে সমুদ্রের গন্ধ। পিয়েরের রাস্তার পাশে ময়লার ঝুড়িগুলো এতটাই বেশি সংখ্যক চোখে পড়ত যে, দূর থেকে মনে হতো রাস্তাটা একটা পটভূমি; তার ওপরের ময়লার ঝুড়িগুলো ছোট ছোট ফোঁটা। সেগুলোর বেশিরভাগই উল্টানো থাকত।
কারণ কোনো আরব, মুর কিংবা স্পেনীয় এসে ঘাঁটাঘাটি করে দেখেছে আরো কিছু পাওয়া যায় কি না। গরীব মানুষেরাও কোনো কোনো জিনিস অপছন্দ করে ফেলে দিয়ে থাকতে পারে। বেশিরভাগ ঝুড়ির ঢাকনা খুলে পড়ে থাকায় সকালবেলা পাড়ার হালকা পাতলা তবে তেজস্বী বিড়ালেরা ন্যাকড়াপরা লোকদের জায়গার দখল নিয়ে নিত। জ্যাক এবং পিয়েরের মাথায় একটা বুদ্ধি আসে: ময়লার ঝুড়ির কাছে একদম নিঃশব্দে চুপিচুপি এগিয়ে গিয়ে ঢাকনাটা তুলে খুব দ্রুত ঝুড়ির মুখে লাগিয়ে দিতে হবে। বিড়ালটা ভেতরে আটকা পড়ে যাবে। তবে বুদ্ধিটা বাস্তবায়ন করা অতো সোজা ছিল না। অন্য যে কোনো প্রাণি টিকে থাকার জন্য লড়াই করতে যতটা ক্ষিপ্র এবং সতর্ক হতে পারে হতদরিদ্র পাড়ায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠার কারণে বিড়ালগুলোও ঠিক ততটাই ক্ষিপ্র এবং সতর্ক ছিল। তবে কখনও কখনও আবর্জনার স্তুপের মধ্যে কোনো সুস্বাদু এবং ক্ষুধা চাগিয়ে দেওয়ার মতো খাদ্যবস্তু পেয়ে যেত বিড়ালগুলো। সেটাকে স্তুপের ভেতর থেকে কিছুতেই বিচ্ছিন্ন করতে না পারলে তখন আটকা পড়েই যেত। ময়লার ঝুড়ির ঢাকনাটা সশব্দে আটকে যেতে বিড়ালটা ভয়ার্ত একটা চিৎকার দিয়ে পিঠ বাঁকিয়ে থাবাসহ জোরসে একটা ধাক্কা দিত ওপরের দিকে। ওপরের দস্তার জেলখানার ছাদ যেত খুলে; তখন ভয়ে গায়ের লোম খাড়া করে পড়িমরি করে দৌড় দিত বিড়ালটা যেন পেছন থেকে শিকারি কুকুরের দল তাড়া করেছে তাকে। নিজেদের নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে সামান্যতম অবগত না হয়ে বিড়ালকে নির্যাতনকারীরা তখন উচ্চ হাসিতে ফেটে পড়ত।
তবে এরাই কিন্তু আবার বিপরীতধর্মী মনোভাবের পরিচয়ও দিত: তাদের ঘৃণার প্রবাহ বর্ষিত হতো কুকুর শিকারির ওপরে। পাড়ার ছেলেরা কুকুর শিকারিকে গ্যালুফা নামের একটা স্প্যানিস শব্দের ছদ্মনাম দিয়েছিল। ওই পৌরকর্মী তার অভিযান চালাত সাধারণত সকালবেলাতে। তবে প্রয়োজনবোধে বিকেল বেলাতেও আসত মাঝে মধ্যে। নির্বিকার একজন বৃদ্ধ আরব-চালিত দুই ঘোড়ায় টানা একটা অদ্ভূত গাড়ির পেছন পাশে চড়ে আসত ওই কুকুর শিকারি।
সেও একজন আরব। তবে তার পোশাক ইউরোপীয়দের মতো। কাঠের তৈরি গাড়িটার চেহারা ছিল ঘনক্ষেত্রাকৃতির: গাড়ির দুপাশে তার দিয়ে ঘেরা দুসারি খাঁচা সেট করা ছিল। মোট ষোলটা খাঁচা ছিল। প্রত্যেকটাতে একটা করে কুকুর রাখতে পারত। ওখানে ঢোকালে কুকুরটা ওপরের তার আর খাঁচার পেছনের অংশের সংক্ষিপ্ত জায়গায় চ্যাপটা হয়ে যেত। গাড়ির পেছনে একটা আলগা তক্তার ওপরে বসে আসত বলে শিকারির নাক থাকত খাঁচাগুলোর মাথা সমান এবং সহজেই সে সামনের দিকে তার শিকারের এলাকাটা পরিষ্কার দেখতে পেত। সকালের ভেজা রাস্তায় গাড়িটা খুব আস্তে ধীরে চলত। তখন স্কুলগামী বাচ্চারা রাস্তায় বের হয়েছে মাত্র। অতিমাত্রায় উজ্জ্বল ফুল সজ্জিত ফ্লানেলের মতো সুতি কোটপরা মহিলারা দুধ কিংবা রুটি আনতে যাচ্ছে। আরব ফেরিঅলারা বাজারের দিকে ফিরে যাচ্ছে। এক কাধে ভাঁজ করা স্ট্যান্ড, আরেক হাতে পাকানো খড়ের তৈরি বিশাল ঝুড়ি। ঝুড়ির মধ্যে থাকত তাদের বিক্রির পণ্যদ্রব্য। হঠাৎ করেই শিকারির সংক্ষিপ্ত একটা কথাতেই গাড়োয়ান লাগামে টান দিলে গাড়িটা থেমে যেত। শিকারি হয়তো কোনো একটা শিকারকে চোখের সামনে দেখতে পেয়েছে, ময়লার পাত্রে অস্থিরভাবে ঘাঁটাঘাঁটি করছে আর বার বার একই বিরতিতে পেছনে তাকাচ্ছে, কিংবা রাস্তার পাশের কোনো দেয়াল ঘেঁষে দ্রæত পায়ে দৌড়ে চলেছে উদ্বিগ্ন দৃষ্টির অপুষ্টির শিকার কোনো কুকুরের আকারে। গ্যালুফা তখন গাড়ির ওপর থেকে চামড়ায় মোড়ানো লাঠি বের করত। লাঠির সঙ্গে বাঁধা একটা শিকল একটা আংটার ভেতর দিয়ে লাঠিটার হাতলে গিয়ে ঠেকেছে। খুব দ্রæত তবে নিঃশব্দ পায়ে জন্তুটার দিকে এগিয়ে যেত শিকারি। কাছাকাছি গিয়ে যদি দেখতে পেত, কুকুরটার গলায় কোনো ভালো পরিবারের পরিচয়বাহী কোনো চিহ্ন নেই তাহলে আকস্মিক দ্রæততায় দৌড়ে গিয়ে কুকুরের গলায় তার অস্ত্রটা প্রয়োগ করত যাতে সেটা লোহার এবং চামড়ার লাসোর মতো কাজ করতে পারে। গলায় ফাঁস লাগার সঙ্গে সঙ্গে কুকুরটা দুর্বোধ্য আর্তচিৎকার দিতে দিতে হিংস্র প্রচেষ্টা চালাত ছুটে যাওয়ার জন্য। কিন্তু লোকটা কুকুরটাকে টানতে টানতে গাড়ির কাছে নিয়ে এসে খাঁচার মুখ খুলে কুকুরটাকে ওপরে তুলে গলার ফাঁসে আরো খানিকটা চাপ প্রয়োগ করে খাঁচার ভেতরে ফেলে দিত। লাসোর হাতলটা খাঁচার তারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিতেও দেরি করত না। ধরা হয়ে গেলে লোহার শিকলটা ঢিলা করে বন্দি কুকুরটার ঘাড় মুক্ত করে দিত সে। পাড়ার ছেলেরা যদি কোনো কুকুরকে কোনো কারণে প্রতিরক্ষা দিতে না পারত তাহলে কুকুর ধরা হতো এই প্রক্রিয়াতেই। তারা সবাই সংঘবদ্ধভাবেই কুকুর শিকারির বিপক্ষে ছিল। তারা জানত, ধৃত কুকুরগুলো পৌর খোঁয়াড়ে নিয়ে যাওযা হয়, তিন দিন পর্যন্ত সেখানে রাখা হয়। যদি কেউ মালিকানা দাবি না করে তাহলে কুকুরগুলো মেরে ফেলা হয়। এই তথ্য তাদের যদি জানা না থাকত তাহলেও সফল অভিযান শেষে ওই মৃত্যুবাহী গাড়ির ফিরে যাওয়ার দৃশ্য তাদের মনের ভেতর শিকারির প্রতি ঘৃণা জাগিয়ে থাকত। কেননা সব রঙের এবং আকারের কুকুর খাঁচার জালের মধ্য থেকে ভয়ার্ত চিৎকার আর কান্নার আওয়াজ রেখে যেত চলমান গাড়িটার পেছনে। সুতরাং জেলখানারূপী গাড়িটা পাড়ায় আসামাত্র ছেলেরা একে অন্যকে সতর্ক করে দিত। তারা পাড়ার বিভিন্ন রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ত। তারাও কুকুরদের ধাওয়া করত তবে ভয়ঙ্কর লাসো থেকে দূরে শহরের অন্য প্রান্তের দিকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্য। তাদের এরকম চেষ্টা সত্ত্বেও যদি কুকুর শিকারি মালিকহীন কোনো কুকুর দেখতে পেত তাহলে পিয়েরে এবং জ্যাকের কৌশল একই রকম থাকত। শিকারি কুকুরটার খুব কাছে পৌঁছনোর আগেই জ্যাক এবং পিয়েরে তীক্ষ্ম এবং আতঙ্কজাগানিয়া কণ্ঠে গ্যালুফা, গ্যালুফা বলে জোরে জোরে চিৎকার করতে থাকত। আর কুকুরটা যত দ্রুত পারে দৌড়ে আয়ত্বের বাইরে চলে যেত। তারপর জ্যাক এবং পিয়েরের পালা দ্রুত মানবের মতো দৌড়ে পালানো। কেননা প্রত্যেকটা কুকুর ধরার জন্য একটা বিশেষ পরিমাণ টাকা পেত গ্যালুফা। ব্যর্থতার কারণে সে জ্যাকদের ওপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে চামড়ার লাঠিটা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে তাদেরকে তাড়া করত। বড়রা গ্যালুফার পথ আটকে কিংবা সরাসরি তাকে নিজের চরকায় তেল দেওয়ার কথা বলে থামিয়ে দিয়ে ছোটদের পালিয়ে যেতে সাহায্য করত। পাড়ার শ্রমজীবি মানুষেরা সবাই ছিল শখের শিকারি। তাদের শিকার অভিযানে কুকুরগুলো কাজে লাগত বলে তারা কুকুর ধরার কাজটাকে মোটেও পছন্দ করত না। আর্নেস্ট মামা কুকুর শিকারিকে গালি দিয়ে বলত, শালা লোফার। গ্যালুফার গাড়ি চালক বৃদ্ধ আরব লোকটা চোখের সামনের ওইসব নাটকীয়তায় একদম নির্বিকার থাকত। তর্কবিতর্ক আরো কিছুদূর গড়ালে সে হাতের মধ্যে একটা সিগারেট ডলতে থাকত। বিড়াল ধরা কিংবা কুকুর বাঁচানো যেটাই হোক, সেটা শেষ হয়ে গেলে বাচ্চারা, শীতের দিনের বাতাস থেকে বাঁচার জন্য প্রাবার পরিহিত অবস্থায় আর গরমের দিনে হলে তাদের স্যান্ডেলে চটর চটর শব্দ তুলে দ্রুত কেউ স্কুলে কেউ কাজে চলে যেত। তাদের কাছে স্যান্ডেলের আরেক নাম ছিল মিভাস।
বাজার পার হওয়ার সময় তারা ফলের দোকানগুলোতে সাজিয়ে রাখা ফলের দিকে এক নজর তাকাত মাত্র। দোকানে কমলালেবু, কমলালেবুর আরেক জাত ট্যাঙ্গারিন, ক্ষুদে আপেল, খুবানি, পিসফল, বাঙ্গি, তরমুজ ইত্যাদি ফলের পাহাড় যেন তাদের পেছনের দিকে চলে যেত। কখনও কখনও তারা ওইসব ফলের সবচেয়ে কমদামি কোনোটার অল্প পরিমাণ খেতে পারত। পানির ফোয়ারার বেসিনের চকচকে প্রশস্ত চারধারে কয়েকপাক ঠেলাঠেলি করে ঘোরার পরে তারা গুদামঘর পেরিয়ে বিথীকার দিকে চলে যেত। ওখানে কারখানা থেকে কমলালেবুর সুগন্ধ তাদের নাকে এসে আঘাত করত। কারখানায় কমলালেবুর খোসা দিয়ে রস তৈরি করা হতো। বাগান এবং ভিলার পাশের আরেকটা রাস্তা পার হয়ে তারা শেষে পৌঁছে যেত রিউ অমেরাতে একদল শিশুদের মধ্যে। সেখানে সবাই একে অন্যের হৈচৈ করার মধ্য দিয়েই সামনের দরজা খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করত।
তারপর এম বার্নার্ডের ক্লাস। তাদের কাছে এম বার্নার্ডের ক্লাস মজার মনে হতো শুধু একটি কারণেই: তিনি তার কাজ প্রচন্ড আবেগের সঙ্গে ভালোবাসতেন। বাইরে তখন হয়তো সূর্যালোক তামাটে দেয়ালের ওপরে আছড়ে পড়ছে, যদিও ক্লাসরুমের চারপাশ চাঁদোয়া ঘেরা থাকত তবু তাপ সেখানেও কড়কড়ে আবহ তৈরি করত। কিংবা আলজেরিয়ার মহাপ্লাবনের মতো বৃষ্টিও পড়ত, রাস্তায় খানাখন্দের সৃষ্টি করত। কিন্তু ক্লাসরুমের ভেতরে ছাত্রছাত্রীদের মনোযোগ তাতে নষ্ট হতো না। ঝড়ো বাতাসের সময় শুধু মাছিদের উপদ্রব তাদের মনোযোগে একটুখানি ব্যাঘাত ঘটাত। তবে ছাত্রছাত্রীরা মাছিগুলো ধরে ধরে ডেস্কের মসিধানীর মধ্যে ফেলে দিত। মাছিগুলো সেখানে তলিয়ে যেতে যেতে ভয়ঙ্কর মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করত। তবে মাছিদের উপদ্রব যতই থাকুক এম বার্নার্ডের ক্লাস পরিচালনার কাঠোর নিয়ন্ত্রণী কৌশলের মধ্য দিয়েই গোটা ক্লাসের পরিবেশ হতো প্রাণবন্ত ও আনন্দদায়ক। ছাত্রছাত্রীদের অবসন্ন মনোযোগ পুনরায় জাগিয়ে তোলার জন্য ঠিক মুহূর্তে তিনি তার সম্পদের সিন্দুক থেকে ধনরত্ম, শুষ্ক উদ্ভিদের সংগ্রহ, আরূঢ় প্রজাপতি, পতঙ্গ, মানচিত্র ইত্যাদি বের করে নিয়ে আসতেন। স্কুলে তিনিই একমাত্র শিক্ষক ছিলেন যিনি যাদুর প্রদীপের অধিকারী ছিলেন। মাসে দুবার তিনি প্রাকৃতিক ইতিহাস এবং ভূগোলের কোনো বিষয়ে প্রক্ষেপণ ব্যবহার করতেন। পাটীগণিতে তিনি মানসাঙ্কের প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন যাতে ছাত্রছাত্রীরা দ্রুত চিন্তা করা শিখতে পারে। গোটা ক্লাসের সামনে তিনি একটা সমস্যা তুলে ধরতেন। সবাই হাত গুটিয়ে বসে ভাগ, গুণ কিংবা জটিল কোনো যোগ মনে মনে মেলাতে ব্যস্ত থাকত। ১২৬৭+৬৯১= কত? প্রথমে যে উত্তর দিতে পারত তার মাসিক ফলাফলের সঙ্গে যোগ হতো ওই উত্তর থেকে প্রাপ্ত নম্বর। তাছাড়া তিনি টেক্সট বইগুলো যোগ্যতা এবং যথার্থতার সঙ্গে ব্যবহার করতেন। ফ্রান্সের স্কুলে যে সকল উপাদান ব্যবহার করা হতো এখানকার টেক্সটবইগুলোও সেসব উপাদান নিয়েই সাজানো। যে ছাত্রছাত্রীরা বাস্তবে পরিচিত ছিল তপ্ত আর্দ্র বায়ুপ্রবাহ, ধূলি, আকস্মিক প্রবল বর্ষণ, সৈকতের বালুকণা, সূর্যের নিচে শিখা-উত্তোলিত সমুদ্রের সঙ্গে তারাই দাঁড়ি-কমা পর্যন্ত উচ্চারণ করে করে নিষ্ঠার সঙ্গে পড়ত অন্য জগতের গল্পও। সেগুলো তাদের কাছে পৌরাণিক কাহিনীর মতো মনে হতো। গল্পের শিশুদের দেখা যেত মাথায় শিরোবস্ত্র, গলায় মফলার পরা, পায়ে কাঠের জুতা। তুষারাচ্ছন্ন পথের ওপর দিয়ে বাড়ি পর্যন্ত টেনে আনছে লাঠির আঁটি। বাড়ির চারপাশ বরফে আবৃত। চিমনির ধোঁয়া থেকে তারা বুঝতে পারে, বাড়িতে মটরের স্যুপ রান্না হচ্ছে। জ্যাকের কাছে ওই গল্পগুলো যেমন নতুন তেমনি মজার মনে হতো। তার স্বপ্ন জুড়ে থাকত ওইসব গল্পের উপাদান। তার রচনাগুলোতে সে কখনও দেখেনি এমন সব অচেনা কল্পিত জায়গার বিস্তারিত বর্ণনা থাকত। বিশ বছর আগে নাকি আলজিয়ার্স এলাকায় তুষার পড়ে দুঘণ্টা স্থায়ী হয়েছিল। সেই তুষারপাত সম্পর্কে নানিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যেত সে। তার জন্য ওই গল্পগুলো ছিল স্কুলের প্রভাববিস্তারী কবিতার অংশ বিশেষ। আর সেগুলোর পুষ্টির মতো ছিল বার্নিশ করা রুলার এবং কলমদানির সুগন্ধ, তার স্কুল ব্যাগের প্লাস্টিকের ফিতার স্বাদ-পড়া তৈরি করার সময় সে ওই জিনিসটা চিবিয়ে এক ধরনের মজা পেত, গাঢ় লাল কালির কটু স্বাদ, বিশেষ করে যখন বিরাট একটা কালো বোতল থেকে মসিধানী পূর্ণ করার দায়িত্ব পড়ত তার ওপর। বোতলের ছিপির মধ্যে একটা বাঁকানো কাঁচের নল ঢোকানো থাকত; নলটার মুখের কাছে নাক নিয়ে জ্যাক গন্ধ শোঁকার চেষ্টা করত। কোনো কোনো বইয়ের চকচকে পাতার নরম মসৃন ছোঁয়া অভিভূত করে দিত তাকে। সেসব বইয়ের ছাপার কালি এবং বাঁধাইয়ের আঠার সুগন্ধ ভালো লাগত। বুষ্টির দিনে ক্লাসরুমের পেছনের পশমের কোট থেকে ভেসে আসা ভেজা ভেজা গন্ধ স্বর্গের বাগানের কথা মনে করিয়ে দিত যেখানে কাঠের জুতা আর পশমের শিরোবস্ত্র পরিহিত শিশুরা তুষারের ওপর দিয়ে দৌড়ে তাদের উষ্ণ বাড়িতে পৌঁছে যায়।
চলবে...