খালেদা ও তারেককে হারানোর ভয়ে কাউন্সিল করছে না বিএনপি!
দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ৩ বছর পরপর বিএনপির কাউন্সিল ও নতুন নেতৃত্ব নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু ৬ বছর পার হয়ে গেলেও দলটির কাউন্সিল হয়নি। কবে হবে সেটাও কেউ সুনির্দিষ্ট করে বলছেন না।
কাউন্সিলের এই দীর্ঘ বিলম্বের কারণ হিসেবে দলের বিভিন্ন সূত্র বলছে, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল করলে দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে হারাতে হবে। এই ভয়ে বিএনপি ৬ বছরেও কাউন্সিল করতে পারেনি। অবশ্য এ বিষয়ে দলের নেতারা মুখে তালা দিয়েছেন। কোনো কথা বলছেন না।
অন্যদিকে দীর্ঘ ৬ বছরেও কাউন্সিল না হওয়ায় দল পরিচালনায় তৃণমূলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক গড়তে পারছে না দলটির হাইকমান্ড।
তবে কাউন্সিল না করতে পারার বিষয়ে বিএনপি নেতারা দায়ী করছেন সরকারের দমন-পীড়নকে।
বিএনপির দলীয় গঠনতন্ত্রের ১১(চ) ধারা অনুযায়ী, প্রতি ৬ মাসে অন্তত একবার জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে। প্রয়োজনবোধে যেকোনো সময় কমিটির সভা চেয়ারম্যানের অনুমতিক্রমে ডাকা যেতে পারে। যে বছর জাতীয় কাউন্সিল হবে, সে বছর ছাড়া প্রতিবছর অন্তত একবার জাতীয় নির্বাহী কমিটির বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হবে। গঠনতন্ত্রে এমন বাধ্যবাধকতা থাকলেও দলটি নির্বাহী কমিটির সভা করছে না। এতে দলের অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক তৎপরতা ও দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। অভিযোগ উঠেছে, দলের কার্যক্রমে সমন্বয় নেই।
বিএনপির ৬ষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ। কাউন্সিলের সাড়ে ৪ মাস পর দলের স্থায়ী কমিটি, ভাইস চেয়ারম্যান আর নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদস্য নিয়ে প্রায় ৫৯৪ সদস্যের বিশাল কমিটি করে বিএনপি।
জানা গেছে, দুর্নীতির মামলায় দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যান ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। তার পাঁচ দিন আগে ৩ ফেব্রুয়ারি নির্বাহী কমিটির বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় খালেদা জিয়া দলের নেতাদের দিক-নির্দেশনা দিয়ে যান, যাতে তার অবর্তমানে দলের মধ্যে কোন্দল বা বিভ্রান্তি তৈরি না হয়।
তবে বিএনপি নেতারা বলছেন, দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর থেকে ২১ আগস্ট মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে বসে দল পরিচালনা করে যাচ্ছেন। তার নির্দেশে দলে পদায়ন, নতুন কমিটি গঠন, কমিটি বিলুপ্ত, বহিষ্কার, বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হলেও দলটির পরবর্তী কাউন্সিলের বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। যদিও দল ও ব্যক্তি স্বার্থে গঠনতন্ত্রে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করেছে বিএনপি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএনপির রাজনীতি ও আগামী দিনের আন্দোলনসহ নানা বিষয়ে দলটির ভেতরে-বাইরে সমালোচনা থাকলেও একমাত্র কাউন্সিল ইস্যুতে সবার মুখে কুলুপ। সবার মুখে একই সুর, প্রতিকূল পরিবেশের কারণেই দলের সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল করা যাচ্ছে না।
তবে বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দণ্ডপ্রাপ্ত হওয়া, সংগঠনের পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ করতে না পারা, কাউন্সিল সুষ্ঠুভাবে করার ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ না করার নিশ্চয়তা পাওয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন দলটির দায়িত্বশীল নেতারা।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘দলের কাউন্সিল হচ্ছে না, এর মানে এই নয় যে কাউন্সিল আর হবে না। কাউন্সিল হচ্ছে না দেশের সার্বিক পরিস্থিতির কারণে। হয়তো এমনও হতে পারে এই সরকারের পতনের মধ্যে দিয়ে নতুন একটা পরিস্থিতি তৈরি হলে, অস্বাভাবিক পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে আমরা ধুমধাম করে কাউন্সিল করব। সেই কাউন্সিল এই বছরের শেষ দিকে নতুবা আগামী বছরের মাঝামাঝি হতে পারে।’
অবশ্য বিএনপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে ও বিভিন্ন পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চেয়ারপারসনকে ছাড়া কাউন্সিল মানে অভিভাবককে মাইনাস করা। সেটি সিনিয়র নেতারা করতে চাচ্ছেন না। নেতাদের বিশ্বাস, যেকোনো সময় খালেদা জিয়া মুক্ত হবেন এবং তার উপস্থিতিতেই সম্মেলন হবে। দ্বিতীয়ত, যদি খালেদা জিয়া সম্মতি দেন, সে ক্ষেত্রে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করবেন। কিন্তু তিনি দেশে নেই। স্কাইপে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে হয়তো থাকতে পারবেন। কিন্তু তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচারের ক্ষেত্রে আদালতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে, যা নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে।
তৃণমূল নেতা-কর্মীরা মনে করছেন, দলে দ্রুত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করা উচিত। নিষ্ক্রিয় ও সুবিধাভোগীদের বাদ দিয়ে দুঃসময়ের ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের নির্বাহী কমিটিতে জায়গা দেওয়া উচিত। নইলে চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলন হোঁচট খাবে। দলও চরম ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সিংহভাগ নেতায় নিষ্ক্রিয়। বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সম্পাদকরা কোনো কাজই করছেন না। কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচিতে হাজিরা দিয়েই অনেকে নিজের দায়িত্ব পালন করছেন। আর বেশিরভাগ নেতায় পদ-পদবি বাগিয়ে চুপচাপ। দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতি ছয় মাস অন্তর নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হলে এসব নেতার কার্যক্রম সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত। কিন্তু এখন দল পরিচালনা হচ্ছে শুধু গুটিকয়েক নেতার শ্রম, মেধা আর আন্তরিকতার উপর ভর করে। এভাবে বেশিদূর যাওয়া যায় না। তাই বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভা আয়োজনের দাবি ক্রমশই প্রবল হচ্ছে। দলীয় ফোরামের ভেতরে ও বাইরে এ বিষয়ে কথা বলছেন অনেকে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘কাউন্সিল করার পরিবেশ দেশের রাজনীতিতে নেই। কাউন্সিলের জন্য পরিবেশ নেই বলতে রাজনীতিতে এখন প্রতিকূল পরিবেশ অনুপস্থিত। যেখানে জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে সরকারবিরোধী মিটিং মিছিল সভায় নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। জেলা পর্যায়ে দলীয় কাউন্সিল করার পরিবেশ থাকছে না। সরকারি দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দমন পীড়ন ও নির্যাতনে সেখানে জাতীয় কাউন্সিলের মতো একটি বড় আয়োজন কীভাবে সম্ভব হবে? বিএনপির সপ্তম জাতীয় কাউন্সিল হবে উৎসবমুখর পরিবেশে।
এদিকে বিএনপির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের মহাসচিব দলের চেয়ারম্যানের লিখিত পরামর্শক্রমে জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা আহ্বান করতে পারবেন। কাউন্সিলের মোট সদস্য সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ সদস্যের উপস্থিতিতে নির্বাহী কমিটি কোরাম পূর্ণ হবে। ছয় মাস বা বছরে অন্তত একবার জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। একইভাবে কাউন্সিল করতে চাইলে ৫ দিনের নোটিশে নির্বাহী কমিটির জরুরি সভা ডাকা যাবে। জরুরি কারণে যদি কোনো সংশোধনী প্রয়োজন হয়ে পড়ে, দলের চেয়ারম্যান গঠনতন্ত্রে সে সংশোধন করতে পারবেন। তবে জাতীয় কাউন্সিলের পরবর্তী সভায় ‘ক’তে বর্ণিত সংখ্যাগরিষ্ঠতায় উক্ত সংশোধনী গৃহীত হতে হবে।
সূত্রে জানা যায়, বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৭নং ধারায় ‘কমিটির সদস্য পদের অযোগ্যতা’ শিরোনামে বলা ছিল, ‘নিন্মোক্ত ব্যক্তিরা জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা যেকোনো পর্যায়ের যেকোনো নির্বাহী কমিটির সদস্য পদের কিংবা জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।’
এগুলো হচ্ছে- (ক) ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশ নম্বর ৮-এর বলে দণ্ডিত ব্যক্তি, (খ) দেউলিয়া, (গ) উন্মাদ বলে প্রমাণিত ব্যক্তি এবং (ঘ) সমাজে দুর্নীতিপরায়ণ বা কুখ্যাত বলে পরিচিত ব্যক্তি। অবশ্য এই ৭ ধারা গোপনে পরিবর্তন করা হয়েছে।
এই বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বিএনপিকে ভাঙতে সরকারের একটি মহল থেকে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। যেমনটা হয়েছিল জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায়ের পর। মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা হলে ‘দুর্নীতিপরায়ণ’ ব্যক্তি দলের সদস্য পদের অযোগ্য হবেন বলে যে কথাটি গঠনতন্ত্রে আছে, তা সামনে এনে ওই মহল বিএনপিতে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য দলের একটা অংশকে ব্যবহার করতে পারে। এ আশঙ্কার কারণে গঠনতন্ত্রের ৭ ধারাটি তুলে দেওয়া হয়েছে।’
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলে গঠনতন্ত্রে কিছু সংশোধনীর প্রস্তাব পাস হয়। আগে গঠনতন্ত্রে ৭ (ঘ) ধারাটি ছিল বলে জানা গেছে। কিন্তু কাউন্সিলের ২২ মাস পর এই ধারা বাদ দিয়ে নির্বাচন কমিশনে গঠনতন্ত্র জমা দেয় দলটি।
প্রসঙ্গত, বিএনপির সর্বপ্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর। ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিতীয়, ১৯৮৯ সালের মার্চে তৃতীয়, ১৯৯৩ সালের সেপ্টেম্বরে চতুর্থ, ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পঞ্চম এবং ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ সর্বশেষ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।
এনএইচবি/এসজি