প্রশাসনে চাপা অস্থিরতা!
সরকারের চলতি মেয়াদের শেষ সময়ে এসে হঠাৎ করেই প্রশাসনে এক ধরনের চাপা অস্থিরতা বিরাজ করছে। সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় সেটা আরও বেশি করে সামনে এসেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত রবিবার (১৬ অক্টোবর) তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মো. মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশনারদের সঙ্গে মাঠপ্রশাসনের দায়িত্বে থাকা জেলা প্রশাসক (ডিসি) এবং পুলিশ সুপারদের (এসপি) বৈঠকে ডিসি-এসপিরা যেভাবে একত্রে ইসিকে তোপের মুখে ফেলার পর এই অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
সাবেক আমলারা বলছেন, সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক কারণ না থাকলে বাধ্যতামূলক অবসরের ঘটনার কর্মকর্তাদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে। তাদের কেউ কেউ বলছেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া দরকার। একইসঙ্গে এ সংক্রান্ত বিধানের বিরুদ্ধে রিট করা দরকার।
রবিবার তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মো. মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে দেওয়ার পর থেকে বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, নিশ্চয়ই সরকার তার বিরুদ্ধে গুরুতর কোনো অভিযোগ পেয়েছে যার জন্য বাধ্য হয়ে তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে। না হলে চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র এক বছর আগে সরকার সমর্থক এই কর্মকর্তাকে অবসরে পাঠানোর অন্য কোনো কারণ নেই।
সোমবার (১৭ অক্টোবর) সচিবালয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের পদস্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুরো ঘটনায় তারা রীতিমত স্তম্ভিত। এখন পর্যন্ত কেউই বলতে পারছেন নাকি এমন ঘটল যে, নিজ দপ্তরে কর্মরত একজন সচিবকে আকস্মকি বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হল। সবার মুখে এ নিয়ে আলোচনা হলেও কেউই এ ব্যাপারে মুখ খুলেননি। অনেক দপ্তরে গিয়ে দেখা গেছে, বিষয়টি নিয়ে কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছেন।
সদ্য বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া তথ্য ও সম্প্রচার সচিব মকবুল হোসেন প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিতে সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে এসেছিলেন। এ সময় সাংবাদিকরা তাকে বাধ্যতামূলক অবসরে দেওয়ার কারণ সম্পর্কে তার কাছে জানতে চান।
জবাবে তিনি বলেন, তার কোনো কারণ জানা নেই। তার বিরুদ্ধে গণমাধ্যমে যেসব খবর বেরিয়েছে সেগুলো তিনি পত্রিকা পড়ে দেখেছেন। এ বিষয়ে তার কোনো মন্তব্য নেই উল্লেখ করে মকবুল হোসেন বলেন, ’আপনারা সত্য অনুসন্ধান করে বের করুন। তিনি কোনো অনিয়ম, দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নয় বলেও দাবি করেন।’
তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন-এমন অভিযোগের কথাও মোনা যাচ্ছে। এ বিষয়ে বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া এই সচিব বলেন, আমি তারেক রহমানকে কখনো সামনাসামনি দেখিনি, দেখতেও চাই না।
তথ্য ও সম্প্রচার সচিবকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো এবং প্রশাসনে মধ্যে চাপা অস্থিরতার বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার সোমবার রাতে ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকেই একটা আইন ছিল। রাষ্ট্রপতির আদেশ বলে যে কাউকে অবসরে পাঠানোর ক্ষমতা ছিল সরকারের।
তারপর ১৯৭৪ সালে সরকারি কর্মচারীদের আইনে এই বিধান ছিল। ২০১৮ সালে সরকারি কর্মচারী আইন যখন হয় সেই আইনেও ৪৫ ধারায় সেটা যুক্ত করা হয়েছে। সরকারের এই ক্ষমতা আছে। সরকার এই ক্ষমতাটা প্রয়োগ করেছে। কথা হচ্ছে, এই ক্ষমতার বিরুদ্ধে, একপক্ষীয় আদেশের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি চাইলে একমাত্র হাইকোর্টে যেতে পারবেন। এ পর্যন্ত যারা উচ্চ আদালতে গিয়েছেন সরকারের এসব আদেশের বিরুদ্ধে সেখানে কোথাও সরকার জয়যুক্ত হয়নি।
তিনি বলেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া ছাড়া শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক না। যদিও আইনে এই ধরনের কথা বলা নাই। আমাদের সংবিধানে কিন্তু আছে, কাউকে শাস্তি দিতে হলে তাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।
আলীইমাম মজুমদার বলেন, ‘আমি মনে করি আইনের বিধানটি প্রশ্নবিদ্ধ। সরকার চাইলে এটা সংশোধন করতে পারে। বিধানটা সম্পর্কে সরকারকে ভাবা উচিত। আমি মনে করি এর আইনের বিরুদ্ধে রিট করা দরকার।’
স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম শহিদ খান ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, সুনির্দিষ্ট ও যৌক্তিক কারণ না থাকলে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া উচিত নয়। এটি কর্মকর্তাদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করে। গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সঙ্গেও যায় না।
তিনি আরও বলেন, আইনে 'জনস্বার্থে কোনো কারণ দর্শানো ছাড়াই' শব্দগুলো পরস্পরবিরোধী। সংবিধানে বিবৃত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী।
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মকবুল হোসেনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর আগে গত ৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনে প্রধান নির্বাচন কমিশানরসহ অন্য কমিশনাররা ডিসি ও এসপিদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
সেই বৈঠকে ইসি আনিছুর রহমান সচিব নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, কর্মকর্তারা নানা সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু নির্বাচনের দায়িত্ব পালনের জন্য ম্যাজিস্ট্রেটদের যে তেল খরচ দেওয়া হয়, সেটাও অনেক সময় তাদের (ম্যাজিস্ট্রেট) কাছে পৌঁছায় না। তখন বেশ কয়েকজন ডিসি এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানান। এ সময় কিছুটা হট্টগোলের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়।
তখন আনিছুর রহমান বলেন, তিনি তথ্য-প্রমাণ নিয়েই কথা বলছেন। যদি কর্মকর্তারা তার বক্তব্য শুনতে না চান, তাহলে তিনি বক্তব্য দেবেন না। কর্মকর্তারা তার বক্তব্য শুনতে চান কি না, এমন প্রশ্ন রাখলে কেউ কেউ ‘না’ সূচক জবাব দেন। তখন বক্তব্য বন্ধ করে দেন আনিছুর রহমান।
এই ঘটনাও ইসির সঙ্গে মাঠ প্রশাসনের এক ধরনরে বৈরিতার সম্পর্ক বলেও বিভিন্ন মহলে আলোচনার জন্ম দেয়। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদরে এমন আচরণে প্রদান নির্বাচন কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই বিব্রত হন।
ইসির সঙ্গে ডিসি ও এসপিদের আচরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাবেক সচিব আলী ইমাম মজুমদার ঢাকাপ্রকাশ-কে বলেন, ‘আমি মনে করি গত দুই নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। তা সত্ত্বেও যারা বৈঠকে শৃঙ্খলা পরিপন্থি আচরণ করেছে তারা সঠিক করে নাই। তাদের ব্যাপারে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশন থেকে জনপ্রশাসনে লেখা উচিত ছিল।
এমএমএ/