মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত-অনালোচিত (১)
একাত্তরেও ষড়যন্ত্র: ধরা পড়ে গৃহবন্দী ছিলেন খন্দকার মোশতাক
ছবি : সংগৃহীত
খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা এবং পরবর্তী ঘটনার জন্য জাতীয় বেইমান হিসেবে পরিচিতি পেলেও তার বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধকালে। তার স্বাধীনতাবিরোধী ষড়যন্ত্রের তথ্য ফাঁস হয়ে পড়লে তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে নিস্ক্রিয় করা হয়েছিল। এমনকি কৌশলে গৃহবন্দীও করা হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানের হাতে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির অজুহাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বদলে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করে যুক্ত থাকার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। এ কারণে তাকে নিস্ক্রিয় করা হয়েছিল-এ তথ্য তখন প্রচার হয়েছিল। এ কারণে তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। সে তথ্য ততটা প্রচারিত ছিল না। গৃহবন্দী থাকার বিষয়টি জানা গেলো খন্দকার মোশতাক আহমেদের তৎকালীন একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্বপালনকারী ড. কামাল সিদ্দিকীর কাছ থেকে।
পাকিস্তানের সিএসপি অফিসার ড. কামাল সিদ্দিকী নড়াইলের মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনের যোদ্ধা হিসেবে তিনি যোগ দেন খুলনা সীমান্তের ভারতের গজাডাংগা প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। কিন্তু মুজিবনগর সরকার তাকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনে যোগদানের জন্য কলকাতায় চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের কাছ থেকে বার্তা পেয়ে প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী স্বয়ং তাকে এ নির্দেশ দেন। কলকাতায় গিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে নবনিযুক্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের একান্ত সচিব হিসেবে নিয়োগ দেন।
ড. কামাল সিদ্দিকী জানান, প্রধানমন্ত্রী তাকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে ব্রিফ করেন। খন্দকার মোশতাক সম্পর্কে বলেন, ‘উনি (মোশতাক) একটু আলাদা কিসিমের লোক। উনি কম্প্রোমাইজ চান, বোধ হয় পাকিস্তানের সঙ্গে একটি সম্পর্ক করতে চান। কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না, একটি গণতান্ত্রিক দলের লোক হিসেবে তাকে (মোশতাক আহমদকে) মন্ত্রিসভায় নিতে হয়েছে। এ জন্য তার তৎপরতার প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিশেষ কিছু নজরে এলে তৎক্ষণিকভাবে জানাতে হবে।’
ড. কামাল সিদ্দিকী জানান, তিনি ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। বাম ধারার রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে জানতেন। আওয়ামী লীগের নেতা, বিশেষ করে খন্দকার মোশতাক আহমেদ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা ছিল না। সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সরকারের নির্দেশ মতো তিনি কাজে যোগ দিলেন। তিনি বলেন, ‘একদিন মোশতাক আহমেদের অফিসের টেবিলে দেখি একটি কার্ড। কার্ডটি কনসোলেট জেনারেল অব ইউনাইটেড স্টেট ইন কলকাতার। দেখে আশ্চর্য হলাম। এই কার্ড কোথা থেকে এলো। আমি তো সব সময় থাকি মন্ত্রীর সঙ্গে। তাকে তো কখনও দেখিনি। কার্ডটি হাতে নিয়ে এ সব ভাবছি। এমন সময় মোশতাক সাহেব তার রুমে এলেন, আমার হাতে কার্ডটি দেখে চিলের মতো ছোঁ মেরে নিয়ে নিলেন। নির্দেশ মতো ঘটনাটি পরদিন প্রধানমন্ত্রীর অফিসে গিয়ে জানালাম। প্রধানমন্ত্রী বললেন, ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনীর লোকজন আমাকে অনেক কথাই বলে যায়। কিন্তু তাদের সব কথা আমি আমলে নিই না। আমরা আমাদের লোক সম্পর্কে আমাদের সোর্স থেকে না জানলে তো ব্যবস্থা নিতে পারি না। এখন আমরা ব্যবস্থা নেব। এর পর জাতিসংঘে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্টে মোশতাকের সফর বাতিল হয়ে গেল।’
ড. সিদ্দিকী জানান, ‘মোশতাকের সফর বাতিলই হলো না। তিনি গৃহবন্দী হলেন। বাইরে আর বের হতে পারতেন না। তার একটা অভ্যাস ছিল বিকালে নদীর পাড়ে গিয়ে হাটাহাটি করা। মিস ঘোষ বলে একজন ভারতীয় কর্মকর্তাকে ফোন করে বললে তিনি গাড়ি পাঠাতেন। কিন্তু ওই ঘটনার পর মিস ঘোষকে ফোন দিলে তিনি আর রেসপন্স করতেন না। পারমিশন দিতেন না, গাড়িও আসতো না। খন্দকার মোশতাক সেটি বুঝে গিয়েছিলেন। গাড়ির জন্য ফোন দিলে কোনো রেসপন্স না পাওয়ার বিষয়টি খন্দকার মোশতাককে জানাই। তিনি আমাকে বলেন, তুমি বুঝো না ওরা আমাকে গৃহবন্দী করেছে।’
সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিদল যুক্তরাজ্যে যাচ্ছে। এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ। এ রকম খবর সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা’র ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু পরে খন্দকার মোশতাককে বাদ দিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধি দল জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগ দিয়েছিল। আর সেপ্টেম্বর পরবর্তী সময়ে মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রীয় কাজ করতেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ। যার ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার পর মন্ত্রিসভায় তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অর্ন্তভুক্ত হয়েছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের লেখা আত্মজীবনী, কিসিঞ্জারকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাংবাদিক ও লেখক ক্রিস্টোফার হিচেনস-এর লেখা ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’, ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলামের ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’, মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা মঈদুল হাসানের ‘মূলধারা ‘৭১’, জেনারেল ওসমানীর জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের ‘একাত্তরের রণাঙ্গন কিছু অকথিত কথা’ বইতে খন্দকার মোশতাক আহমদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে তথ্য রয়েছে।
এসব তথ্য থেকে জানা যায়, মার্কিন যুক্তরাজ্যের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে কনফেডারেশনের মাধ্যমে যুক্ত থাকার ষড়যন্ত্র করেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। ৩০ জুলাই ১৯৭১ মোশতাকের প্রতিনিধি হিসেবে কুমিল্লার এমপি আওয়ামী লীগ নেতা কাজী জহিরুল কাইয়ুম কলকাতা মার্কিন দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। তিনি একাধিকবার দূতাবাসে গিয়ে ইঙ্গিত দেন শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির বিনিময়ে প্রয়োজনে স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোষ করতে রাজী মুজিবনগর সরকার। এর আগে মোশতাকের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষীও যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে যোগাযোগ করেন। তিনি মোশতাকের যুক্তরাষ্ট্র সফরের ইচ্ছা এবং তার ভিসার ব্যাপারে আলোচনা করেন।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম তার ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ বইতে লিখেছেন, ‘পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাক, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্যদের অগোচরে পাকিস্তানের সাথে একটি রাজনৈতিক সমঝোতায় আসার চেষ্টা করেন। একইসাথে তিনি দলীয় নেতাকর্মী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেন।’
‘একাত্তরের রণাঙ্গন কিছু অকথিত কথা’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ‘জুলাই মাসের দিকে কলকাতায় গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ‘মুজিবনগর সরকারের এই মন্ত্রী পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার শর্তেও বঙ্গবন্ধুকে হায়েনাদের কবল থেকে ফিরিয়ে আনার পক্ষপাতী। ...এই নেতা মুজিবকে উদ্ধারের জন্যে মার্কিন পররাষ্ট্র সেক্রেটারি হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছেন। পাশাপাশি অতি সংগোপনে এমন গুজবও ছড়িয়ে পড়ে যে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ও অন্যরা শেখ মুজিবের জীবনের বিনিময়ে হলেও দেশ স্বাধীন করতে চাচ্ছেন। এদের কাছে বঙ্গবন্ধুর জীবনের চেয়ে স্বাধীনতা অর্জনই বড়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ফিরে আসুন; এটা এরা চান না।’
জুলাইর দিকে মোশতাকের সঙ্গে দেখা করতে যান আওয়ামী লীগ নেতা নুরুল ইসলাম ও মুক্তিবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। তখন মোশতাক জানান, ইন্দিরা গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছিলেন। তাকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন সরাসরি বলে দিয়েছেন পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুজিবের প্রাণরক্ষা দুটো একসঙ্গে সম্ভব নয়। যদি মুজিবের অনুসারীরা তাদের নেতার প্রাণরক্ষা করতে চান, তাহলে পাকিস্তান রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে থেকেই আপোষরফার চেষ্টা করতে হবে। ইন্দিরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার মুজিবনগর সরকারের নেতৃবৃন্দের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন এবং মোশতাকের অভিমত একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেরই ক্ষমতা আছে বঙ্গবন্ধুকে সহি-সালামতে ফিরিয়ে আনার। সেক্ষেত্রে তাদের শর্তে রাজী হওয়াই উচিত। কারণ, বঙ্গবন্ধুই না থাকে, তাহলে কিসের স্বাধীনতা! [একাত্তরের রণাঙ্গন কিছু অকথিত কথা]
মোশতাকের ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে মুজিবনগর সরকার। ৫ ও ৬ জুলাই ১৯৭১ শিলিগুড়িতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দেওয়া বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি না স্বাধীনতা কোনটিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে এ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ বলেন : ‘আমরা স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতা পেলেই বঙ্গবন্ধুকে আমাদের মাঝে পাব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যদি খোদা না করুন, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু হয় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে, তাইলে বঙ্গবন্ধু শহীদ হয়েও স্বাধীন বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে অমর ও চিরঞ্জীব হয়ে থাকবেন। তিনি একটি নতুন জাতির জনক হিসেবে ইতিহাসে স্বীকৃত হবেন। ব্যক্তি মুজিব, ব্যক্তি নজরুল, তাজউদ্দীন, কামরুজ্জামান কেউ হয়ত বেঁচে থাকবেন না। একদিন না একদিন আমাদের সকলকেই মরতে হবে। বঙ্গবন্ধুকেও মরতে হবে। আমরা চিরদিন কেও বেঁচে থাকব না।’ [মূলধারা ’৭১]
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছিল মোশতাককে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরউত্তর দিল্লী ব্রিফিং বৈঠকে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্যরা যোগ দেন। কেবল একজনকে নেওয়া হয়নি, তিনি ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক।
যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সঙ্গে মোশতাকের এই গোপন যোগাযোগের খবর তখনই প্রকাশ পায়। এ সম্পর্কে মঈদুল হাসান লিখেছেন: ‘কিসিঞ্জারের স্মৃতিকথা প্রকাশের আগে অবধি এই ঘটনার কথা অবিদিত থাকলেও এই ধরনের কর্মকাণ্ড যে ভিতরে-ভিতরে চলছিল তা সেই সময়ের আর একটি সূত্র থেকে প্রকাশ পায়।’
অবমুক্ত হওয়া মার্কিন নথি থেকে জানা যায়, পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে প্রস্তাব করেন, কলকাতায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে তারা জানিয়ে রাখতে চান যে, ইয়াহিয়া তার সঙ্গে গোপন আলোচনা শুরু করতে রাজি। ফারল্যান্ডের এ প্রস্তাবে ইয়াহিয়াও রাজি হন।
জানা যায়, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে শেষ সাক্ষাতে অনুরোধ করেছিলেন, কোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত থাকা যায় কি-না ভেবে দেখতে। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ দেওয়া বক্তৃতায়ই স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি তোমরা সুখে থাকো। ...তোমাদের সাথে আর না। শেষ হয়ে গেছে। তোমরা স্বাধীন থাকো, আমিও স্বাধীন থাকি।’
খন্দকার মোশতাক আহমেদ আওয়ামী লীগের (আওয়ামী মুসলিম লীগ) প্রতিষ্ঠাকালীন যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন। আওয়ামী লীগের মধ্যে তিনি ডানপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তখন তিনি আওয়ামী লীগে সহ-সভাপতি ছিলেন। তিনি দলের হাইকমান্ডের সদস্য ছিলেন। ব্যারিস্টার আমীর উল ইসলাম জানিয়েছেন, মুজিবনগর সরকার গঠন প্রক্রিয়ার শুরুতে খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার চেষ্টা করেছেন। পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার শর্তে নিবৃত হয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর ১২ জানুয়ারি ১৯৭২-এ গঠিত দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় খন্দকার মোশতাক আহমদের ঠাঁই হয়নি। কিন্তু ১৯৭৩ সালে গঠিত তৃতীয় মন্ত্রিসভায় কূটকৌশলী খন্দকার মোশতাক আহমেদ স্বাধীনতার পর বিদ্যুৎ, সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করে ফিরে আসেন। ১৯৭৫ সালের মন্ত্রিসভায় তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন। বাকশালেরও কার্যকরী কমিটিরও সদস্য মনোনীত হন। কখনও রাষ্ট্রপতি মারা গেলে উপ-রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার কথা; কিন্তু ১৫ আগস্ট ভোরে সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ওই দিনই উপরাষ্ট্রপতি নয়, বাণিজ্যমন্ত্রী হয়েও রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব নেন খন্দকার মোশতাক আহমেদ। শুরু হয় বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার তৎপরতা। সেই রাতেই বেতার ঘোষণায় বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
মোশতাক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ‘জাতির সূর্য সন্তান' বলে আখ্যা দেন। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা নিয়ে তার প্রথম বক্তব্যে 'জয় বাংলা'র বদলে 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ' বলতে শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ বেতারের নাম পরিবর্তন করে রেডিও পাকিস্তানের অনুকরণে 'রেডিও বাংলাদেশ' নাম নির্ধারণ করেন। টুপিটিকে জাতীয় টুপি ঘোষণা করা হয়। দায়িত্ব পালনকালে, তার নির্দেশে ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া জাতীয় চার নেতাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী অবস্থায় হত্যা করা হয়। তিনিই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে ’ইনডেমনিটি অ্যাক্ট’ জারি করেন।
খন্দকার মোশতাক ৮৩ দিন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এরপর ১৯৭৬ সালে ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামে নতুন দল গঠন করেন। এখন দলটির কোনো অস্থিত্ব নেই। প্রকাশ্য কোনো অনুসারীও নেই। ১৯৯৬ মোশতাক মারা গেলে ঢাকায় তার জানাজা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। কুমিল্লায় তাকে দাফন করা জায়গাটিতে এখন প্রায়ই জুতা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।
এপি/এএন