রাজধানীর গণপরিবহন সেবা
৫ কোটি টাকা জরিমানার বিধান রেখে আসছে নতুন আইন
সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকার জরিমানার বিধান রেখে গণপরিবহন সেবায় নতুন আইন আসছে। রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজ পদ্ধতিকে আইনি কাঠামোতে আনতে এই আইন করতে যাচ্ছে সরকার। এ জন্য ‘বাস পরিবহন সেবা পরিচালনা ও বিশেষ অধিকার (রুট ফ্রাঞ্চাইজ) আইন-২০২২’ নামে একটি আইন করতে যাচ্ছে সরকার। ইতোমধ্যে ওই আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। আইনটি তৈরি করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অধীন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)।
নতুন আইন অনুযায়ী ঢাকা মহানগর এলাকা এবং সংলগ্ন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিগঞ্জ জেলাকে বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজ এর আওতায় আনা হবে।
প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন কোনো বাস পরিবহন সেবা পরিচালনের জন্য ফ্রাঞ্চাইজপ্রাপ্ত না হলে কোনো ব্যক্তি ঢাকা মহানগর ও সংলগ্ন এলাকায় বাস সেবা পরিচালন করতে পারবেন না।
কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত বা স্বীকৃত ভাড়ার বিনিময়ে পরিচালিত যাত্রী পরিবহনের কাজে নিয়োজিত বাস পরিবহন সেবার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। সরকার বা সরকারের পক্ষে কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার মালিকানাধীন বাস পরিচালন সেবা দেওয়া যাবে না।
বিমানবন্দর থেকে বা বিমানবন্দর অভিমুখি আন্তর্জাতিক যাত্রী পরিবহন কাজে নিয়োজিত বাস পরিবহন সেবা; কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত হোটেল বা পর্যটন পরিসেবার জন্য নিয়োজিত বাস সেবা; সরকার বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক বা কর্মচারী পরিবহন কাজে নিয়োজিত বাস পরিচালন সেবা; স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহের মালিকানাধীন বা চুক্তিবদ্ধ ভাড়ার বিনিময়ে নাগরিক সেবা প্রদান কাজে নিয়োজিত বাস পরিচালন সেবা এবং এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সময় অনুমোদিত অন্য কোনো বাস পরিবহন সেবা।
প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রত্যেক পরিচালন কোম্পানি প্রতি বছর পরবর্তী বছরের জন্য একটি কর্মপরিকল্পনা প্রস্তুত করে সেটি অনুমোদনের জন্য কর্তৃপক্ষকে দেবে।
এই কর্মপরকিল্পনার মধ্যে থাকবে বাস রুট উন্নয়ন পরিকল্পনাসহ বাস পরিবহন সেবা প্রদানের বিস্তারিত বিবরণ এবং বাস চলাচলের ফ্রিকোয়েন্সি ও পরিবহন যান বারদ্দের বিবরণ; কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে পরিচালিত বাসের সংখ্যা ও বাসের ধরণ সম্পর্কিত বিবরণ; পুরাতন ও চলাচলের অনুপযোগী বাসের ফেইজ আউট কর্মসূচি; বাস রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত; সম্ভাব্য আয় ও আর্থিক সক্ষমতা এবং কর্তৃপক্ষ কর্তৃক যাচিত প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়াদি।
আইন অনুযায়ী, এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে কোনো পরিচালন কোম্পানি ব্যর্থ হলে উক্ত কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনের ৩৩ ধারায় প্রশাসনিক জরিমানা করা হবে।
প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় ফ্রাঞ্চাইজ এর মেয়াদ, বর্ধিত মেয়াদ ও নবায়ন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ফ্রাঞ্চাইজ প্রদানের মেয়াদ হবে প্রদানের তারিখ থেকে ১০ বছর। উক্ত মেয়াদের মধ্যে তফসিলে উল্লেখিত বাস রুট পরিবর্তন হলে মেয়াদ গণনার ক্ষেত্রে এটি বিবেচনায় নেওয়া হবে না।
ফ্রাঞ্চাইজ কোম্পানির আবেদনের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ ক্রয় আইনের বিধান সাপেক্ষে ফ্রাঞ্চাইজ এর মেয়াদ অনধিক দুই বছর সময়ের জন্য নবায়ন করতে পারবে।
কোনো পরিচালন কোম্পানি তার ফ্রাঞ্চাইজ বা এর অংশ বিশেষ কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির কাছে হস্তান্তর করতে পারবে না।
তবে কোনো পরিচালন কোম্পানির আওতাভুক্ত ফ্রাঞ্চাইজ বা এর কোনো অংশ বিশেষ, কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে অপর ফ্রাঞ্চাইজ এর কাছে হস্তান্তর করা যাবে।
অবশ্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির কাছে কোনো ফাঞ্চাইজ বা এর কোনো অংশবিশেষ হস্তান্তর করা হলে সেটির আইনি ভিত্তি থাকবে না।
ফ্রাঞ্চাইজ এর অধিকার বা বাতিল বিষয়ে প্রস্তাবিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, কর্তৃপক্ষের কাছে যদি প্রতীয়মান হয় যে, এই আইনের বিধি বিধান বা ফ্রাঞ্চাইজ চুক্তির অধীন কোনো পরিচালন কোম্পানি বাস পরিবহন সেবা পরিচালনা করতে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে বা আইনের অধীন আরোপিত প্রশাসনিক জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ হয় বা আইনের অধীন কোনো অপরাধে দন্ডিত হয় তা হলে কর্তৃপক্ষ পরিচালন কোম্পানিকে ফ্রাঞ্চাইজ চুক্তির প্রদত্ত অধিকার বাতিল বা প্রত্যাহার করতে পারবে।
তবে কোম্পানিকে যুক্তিসঙ্গত শুনানির সুযোগ দেওয়া ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
ফ্রাঞ্চাইজের অধিকার প্রত্যাহার বা বাতিল করা হলে কর্তৃপক্ষ সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে বাস পরিবহন সেবায় নিয়োজিত বাস ও সংশ্লিষ্ট অস্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ করতে এবং অধিগ্রহণকৃত বাস ও অস্থাবর সম্পদ অপর কোনো ফ্রাঞ্চাইজ এর কাছে হস্তান্তর করতে পারবে।
প্রস্তাবিত আইনের তৃতীয় অধ্যায়ে বাস রুট ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বলা হয়েছে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ তে যাই থাকুক না কেন নতুন আইন অনুযায়ী বাস রুটসমূহ যে গুচ্ছ বাস রুট এলাকার জন্য প্রযোজ্য বা যে বাস রুটে এই আইন কার্যকর হবে সেই রুট এলাকায় বাস পরিবহন সেবা পরিচালন বিষয়ে উক্ত আইনের অধীন প্রদত্ত রুট পারমিট স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাতিল হবে। ফাঞ্চাইজপ্রাপ্ত কোম্পানির বাস এই রুট এলাকায় পরিবহন সেবা পরিচালনার জন্য রুট পারমিটপ্রাপ্ত বলে গণ্য হবে।
প্রস্তাবিত আইনের সপ্তম অধ্যায়ে আইন ভঙ্গ করলে শাস্তি ও জরিমানার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে ফ্রাঞ্চাইজ চুক্তির কোনো শর্ত লঙ্ঘন করলে বা কোনো শর্ত প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে বা চুক্তি দ্বারা নির্দিষ্টকৃত ফ্রাইঞ্চাইজ ছাড়া অন্য কোনো রুটে বাস পরিবহন সেবা প্রদান করলে কর্তৃপক্ষ আর্থিক ও প্রশাসিক জরিমানা আরোপ করতে পারবে।
এক্ষেত্রে প্রশাসনিক জরিমানার পরিমান হবে সর্বোচ্চ পাঁচ কোটি টাকা এবং সর্বনিম্ন পাঁচ লাখ টাকা। এই জরিমানা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই অভিযোগের বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত শেষে প্রশাসনিক জরিমানা আরোপ ও আপিলের পদ্ধতি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে।
কোনো ফ্রাঞ্চাইজ জরিমানা পরিশোধে ব্যর্থ হলে পাবলিক ডিমান্ড রিকোভারি অ্যাক্ট ১৯১৩ (বেঙ্গল অ্যাক্ট নং ১১১ অভ ১৯১৩) এর অধীন সরকারি দাবি গণ্যে আদায়যোগ্য হবে।
প্রস্তাবিত এই আইনের বিষয়ে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম রবিবার (১৫ মে) রাতে ঢাকাপ্রকাশ’কে বলেন, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) এরকম একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে। এখন সেটির বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে স্টেকহোল্ডার মতামত নেওয়া হবে। তারপর আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা হবে। এরপর একটি আইন করতে যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে সেগুলো সম্পন্ন করে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে।
প্রসঙ্গত, বাস রুট ফ্রাঞ্চাইজ প্রবর্তনের জন্য ঢাকা মহানগরীর বাস রুট ও সার্ভিসগুলোকে প্রাথমিকভাবে নয়টি ক্লাস্টার, ২২টি কোম্পানি এবং ৪২টি রুটে পরিণত করা হবে।
এ সব রুটকে আরবান ও সাব-আরবান এই দুই ভাগে ভাগ করে ঢাকার বাইরের বাসগুলোকে শহরের ভেতরে প্রবেশ সীমিত করা হবে। একই সঙ্গে রুটের দৈর্ঘ্য যৌক্তিকভাবে কমিয়ে আনা হবে। এ জন্য নগরীর আবদুল্লাহপুর, কাঁচপুর, ঝিলমিলসহ বিভিন্ন পয়েন্টে ট্রান্সফার স্টেশন নির্মাণ করা হবে।
ঢাকা মহানগরী ও সংলগ্ন এলাকায় যাত্রী পরিবহন সেবার মানোন্নয়ন এবং বাস পরিবহনব্যবস্থা নিরাপদ, দ্রুতগামী, পরিকল্পিত, সুষ্ঠু ও আধুনিকীকরণের উদ্দেশেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এনএইচবি/আরএ/