অত বড় প্রেমিক আমি নই
স্যার বলেন তো, ঈশ্বর প্রথমে পুরুষ সৃস্টি করেছেন , পরে নারী সৃস্টি করেছেন কেন?
ছাত্রীর প্রশ্নের জবাবে বললাম,ঈশ্বরের ইচ্ছা মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। পড়ায় মন দাও।
গ্রাহ্য না করেই বিদ্যাবতী বলল, স্যার ধাঁধাঁটা অনেক সহজ ছিল।
বিরক্ত হয়ে বললাম, থামবে ? বুত্তের এক্সট্রা আবার ভুল করেছ?
বিদ্যাবতী : স্যার যারা ম্যাথসে ভাল হয় তারা লজিকে কাঁচা হয়। আমার লজিক ভাল , তাই ম্যাথসে কাঁচা। আমার ধাঁধাঁর উত্তর দেন।
কপট রাগ দেখিয়ে বললাম, ঊঁহ ! থামলে ভাল লাগে।
বিদ্যাবতী : স্যার এইটা কিন্তু টিভি নাটকের সংলাপ। মানে হচ্ছে, আপনি ম্যাথসে ভাল তাই আপনার লজিক খারাপ। কারন এই সিরিয়ালটা এখনো শেষ হয়নি। আপনি পুরনো সময়ের নাটকের সংলাপ বলতে পারতেন। তাহলে , আমি মনে করতাম , এটা আপনার নিজের , কারো কাছ থেকে ধার করেননি।
এবার ধমকের স্বরে বললাম, একটা প্রাসঙ্গিক কথা ধার করা হলে ক্ষতি কি?
বিদ্যাবতী : লাভ- ক্ষতির বিষয় না স্যার। এইটা হচ্ছে স্মার্টনেস। অন্যের কথা কিন্তু কেউ ধরতে পারল না।
এভাবে চলতে থাকলে আজ আর পড়বেই না, উদ্দেশ্য ধরে ফেললাম। তাই একটু আপোষের সুরেই বললাম, ঠিক আছে ধাঁধাঁর উত্তর বল। এরপর আর একটা কথাও নয়। অংকে মন দাও।
বিদ্যাবতী : ওকে গুরুর আদেশ শিরোধার্য। উত্তরটা হচ্ছে, রাফ কপির পরেই ফ্রেশ কপি করা হয়। অর্থাৎ ছেলেরা রাফ কপি আর মেয়েরা ফ্রেশ কপি। ঠিক না স্যার ?
ক্লাস টেন পড়–য়া ছাত্রী। আর দুমাস বাদে টেস্ট পরীক্ষা। বিচিত্র সব বিষয নিয়ে ওর আগ্রহ। আমি ওকে ডাকি বিদ্যবতী বলে।
বিদ্যাবতীকে কত বছর পড়িয়েছি এটা হিষাব কষাটা কঠিন। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পরও ছুটিতে বাড়ী যাওয়া মানেই ওকে পড়ানো। ভার্সিটিতে পড়াশুনার চাপ বাড়তে থাকল। বিদ্যাবতীকে পড়ানোটাও বন্ধ হয়ে গেল। এরই মধ্যে রাজশাহী মেডিকেলে ভর্তি হল বিদ্যবর্তী। যোগাযোগ চিঠি পত্রে। দুই ঈদ ছাড়া দেখাও হয় না।
মেডিক্যালে চান্স পাওয়ার পর , বিদ্যবতীকে অভিনন্দন জানিয়ে কার্ড পাঠালাম। লিখলাম, সোনালী জীবনকে সামনে রেখে সোনালী পণ্যে ভরা স্বর্ণ - শকট বেয়ে আরোহণ কর সাফল্যের স্বর্ণশিখরে - হও রাজে্শ্বরী। উত্তরে লিখেছে, আমি তো স্বর্ণ মোড়ানো রাজে্শ্বরী। আপনার স্থান কোথায় ? কবি গুরু থেকে উদ্ধৃতি টেনে লিখলাম, আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর।
বিদ্যাবতী খুব সুন্দর চিঠি লেখে। একটি চিঠিও নীল খামের নয়। ওর চিঠির ভাষা কখনো খুবই হেয়ালীপুর্ণ , আবার কখনো শিশুর সারল্যে মাখামাখি। ন্যাকামো নাই। তবে জ্যাঠামো - পাগলামো - দুস্টুমি ভরা।
একবার চিঠিতে লিখল , স্যার প্রেমের চিঠি কেমন হতে পারে ? আপনি অনেক সাহিত্য পড়েন। তবে আমি চাইব , নিজের কথা লিখবেন। কাউকে উদ্ধৃত করবেন না। আর কোন তাত্বিক কথা লিখবেন না। বিদ্যাবতীর এই চিঠির ভাষা আমার দ্ব্যর্থবোধক বলে মনে হল। তবে কি ? আশা দোলাও দিয়ে গেল মনে। বেয়াড়া ভাবনাটাকে জোর করে তাড়িয়ে দিলাম।
আমি সাধারন পরিবারের সাধারন ছেলে। পড়াশুনায় গড়পড়তা। চোখে পড়ার মত তেমন কিছুই নাই। সেভাবে লিখতে না পারলেও , প্রচুর সাহিত্য পড়ি। পড়াশুনা শেষ করে একটা ছোট খাটো চাকরী পেলেই আমি বর্তে যাই। বিত্ত - বিদ্যা, সামাজিক পরিচয় সবদিক থেকেই বিদ্যবতী অনেক এগিয়ে। আবেগ বশে রাখি , মন শান্ত রাখি।
এসব সাঁত পাঁচ ভেবে কয়েকদিন পর চিঠির উত্তর লিখলাম -
প্রেমের চিঠি বলতে আমি বুঝি সরল আবেগের প্রকাশ। এভাবে লেখা যেতে পারে,
আমি শাজাহান তুমি মমতাজ
স্বপ্নের তাজমহল গড়ি এসো আজ।
জবাবে বিদ্যবতী লিখেছে, আপনি মেল ভার্সনে লিখেছেন।
এইটার ফিমেল ভার্সন হতে পারে,
‘আমি মমতাজ তুমি শাজাহান
তোমার অনেক প্রেমিকা - আমার স্বপ্ন ভেঙে খান খান’।
একনিষ্ঠ প্রেমের অনুসারী ছেলেরা হতে পারে না, খুব সহজ করেই বুঝিয়ে দিয়েছে বিদ্যাবতী। একবার এক চিঠিতে লিখল , স্যার মেডিকেলে না পড়ে আমি ভার্সিটিতে পড়লে খুব ভাল হত ? ধরেন আপনি ভার্সিটিতে আপনার প্রেমিকাকে নিয়ে হাঁটছেন। আপনার সামনেই আপনার প্রেমিকাকে বলতাম, আপনার সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। কিন্তু ভার্সিটিতে আসার পর আমাকে ভুলে গেছেন। কাঁদো কাঁদো হয়ে আপনার প্রেমিকাকে বলতাম, আপনি মায়াবিনী আপনি আমার স্বপ্ন আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছেন !
এভাবেই চলছে। তবে চিঠির সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। আমার মাস্টার্স শেষের পথে। বিদ্যাবতীর চিঠি। লিখেছে, একটা ভাল সংবাদ আছে। ইয়ার ফাইনালে খুব ভাল ফল করেছি। এতটা ভাল করব ভাবিনি। এটা আপনার জন্য ভাল সংবাদ। আমার জন্য ভাল সংবাদটা আপনি দেবেন। মাস্টার্সের পর কি করবেন ? ঠিক করেছেন কিছ ু? আমি কিন্তু আপনাকে খুব বেশি সময় দিতে পারব না। বাবা -মা’র একমাত্র সন্তান আমি। ইন্টার্নি করা পর্যন্ত বড় জোর আটকে রাখতে পারব। আর একটা কথা , আপনি তো খুব ভালভাবেই জানেন , আমি অনেক সাহসী। নেক্সট চিঠিতে আপনাকে ‘ তুমি’ সম্বোধন করব। হা হাহাহা ..। আপনার ভাষাতেই বলি , আমি কিন্তু রাজেশ্বরী। সো যথা আজ্ঞা বলে , যা বলছি মেনে ‘নাও’।
মাস্টার্স শেষ হয়েছে দু বছর। চাকরী যোগাড় করতে পারিনি। চিঠির ভাষায় আবেগের জায়গাগুলো দখল করে নিচ্ছে বাস্তবতা। এভাবে চলল আরো কিছুদিন। বিদ্যাবতীর ইন্টার্নি শেষের পথে। চিঠি পেলাম। যেন সতর্কবার্তা। লিখেছে, ইন্টার্নি শেষ হতে আর অল্প কিছুদিন বাকি। পাত্র দেখা চলছে। যা করার খুব দ্রæত কর।’
ততদিনে বুঝে গেছি, সবার জন্য সবকিছু নয়।
চিঠি লিখলাম।
চিঠিতে সিতা বিসর্জনের আধুনিক কাহিনি ফাঁদলাম --
আমরা ঘুমাই। ঘুমালে সাভাবিক কারনেই স্বপ্ন দেখি। একটা বিষয় খেয়াল করেছি । স্বপ্নে কারো সঙ্গে শারিরীক স্পর্শ ঘটলেই স্বপ্ন ভেঙে যায়। তোমার - আমার সম্পর্কটা স্বপ্নের মত। আর স্বপ্নে ছোঁয়াছুঁয়ি মানেই তো অনিবার্য স্বপ্নভঙ্গ। তোমার - আমার একসঙ্গে থাকা মানেই তো স্বপ্ন ভঙ্গ। বরঞ্চ আমরা স্বপ্নটাকেই বাঁচিয়ে রাখি। দুরত্বই হোক আমাদেও বড় প্রেমের স্মারক।’
উত্তরে বিদ্যাবতী লিখেছে, শোন, আলগা বড় প্রেমিক সাজবা না। আমরা খুবই সাধারন। বড় প্রেমের নাগাল আমরা কখনোই পাবো না। তুমিই তো একবার বলেছিলে, এক শিল্পীর কথা। যিনি তার প্রেমিকাকে বলেছিলেন, তোমার চেয়ে সুন্দর পৃখিবীতে আর কিছুই হতে পারে না। একবার ওই শিল্পী গেলেন সমুদ্রে। জোছনায় সমুদ্র স্নান করছে। অপার্থিব সৌন্দর্যে মুগ্ধ হযে গেলেন শিল্পী। অস্ফুটে বলে উঠলেন, এত সুন্দর। তারপরই তার মনে পড়ল তার প্রেমিকার কথা। তার মনে হল , প্রেমিকার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। ঝাপিয়ে পড়লেন সমুদ্রে। প্রেম বেঁচে থাকল। সলিল সমাধি হলেন শিল্পী। এরা অন্য ঘরানার। এদের বোধ অনেক বিশাল। যেটা তুমি - আমি নই। আর আমার সঙ্গে অকারণ ভাব ধরবা না। তোমাকে কিছু করতে হবে না। যা করার আমি করছি।
বাসর রাত। বিদ্যাবতীকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কিভাবে সম্ভব করলে! জবাবে বলল, আমি বাবা- মার একমাত্র সস্তান। দুদিনের হাঙ্গার স্টাইক। দরজা আটকে ঘরবন্দী থাকলাম। কি আর করবেন আম্মু –- আব্বু।
বললাম, তোমার এই পদ্ধতি যদি কাজ না করত ? বিদ্যবতী জানাল, বলতাম, আমার শরীরে তোমার বেবি। আমি আর্ত - চীৎকার করে উঠলাম মানে! নির্লিপ্ত বিদ্যাবতীর উত্তর, ভাঙা স্বপ্নে ঘুম ভাঙবে। আবার জেগে ওঠার পর সেই স্বপ্ন জোড়া লাগবে। এই ভাঙা - গড়ার খেলা চলতেই থাকবে জীবনভর। তবে অত বড় প্রেমিক কিন্তু তুমি নও।
ডিএসএস/