আমার সম্পর্কে একটু বলি। আমি নাজিফা। ছোট বেলা থেকেই ঢাকায় মানুষ। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। চাঞ্ছ পেয়েছি মফঃস্বলের সম্পূর্ণ নতুন এক মেডিকেলে। অবশ্য এটা নিয়ে আমার কোন আফসোস নেই। শুধু পড়াশোনাটা বাদ দিলেই সবকিছু ফার্স্ট ক্লাস। এখানকার সবাই অনেক ভালো। টিচার, ফ্রেন্ড থেকে শুরু করে সবাই। সবাই অনেক ভালো। তবে আব্বু-আম্মুকে অনেক মিস করি। মেডিকেলের লাইফটা বেশ বোরিং। টিউটোরিয়াল, লেকচার, আইটেম আরও কতো কি? কিন্তু আমি ছিলাম বেশ দুষ্টু। নিজের দুষ্টামির কারনে ক্লাসের সবাই আমাকে চিনতো। আড্ডা দেয়া, সবাইকে পচানি দেয়া, এভাবেই চলছিলো।
আজকে ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ। অনেকের জন্যই দিনটা বেশ স্পেশাল। কিন্তু আমার জন্য আর দশটা দিনের মতই সাধারন। আজকের ঘুম একটু দেড়িতে ভেঙেছে। তারাতারি কলেজ যেতেই শুনি থার্ড মাইগ্রেশনে নতুন দুইটা ছেলে এসেছে আমাদের ক্লাসে। যেহেতু নতুন ছেলে। তাই তাদেরকে আজকে পচানি দিতে বেশ মজাই হবে। আর পচানি দেয়ার আগে শিকারকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে নেয়া জরুরী। তাকিয়ে দেখলাম দুইটাকে। একটা পুরাই বলদ মার্কা। একে পচিয়ে বেশ মজা পাওয়া যাবে। আরেকটা বেশ লম্বা। প্রায় ছয় ফুট। ফর্সা, কোঁকড়ানো চুল। চেহারাও মোটামোটি। কিন্তু বেশ মায়াবী দুটো চোখ। চোখ দুটোতে কি যেন ছিল। ওর চোখে চোখ পরতেই মনটা কেমন জানি করে উঠলো। একে পচাতে একদম ইচ্ছা করলো না। মনে হচ্ছিলো ওর চোখ দুটো খুলে ব্যাগে করে নিয়ে যাই। ক্লাস শেষে নিজেই গিয়ে ওর সাথে পরিচিত হলাম। মহাশয়ের নাম রাফু। নাম জানা ছাড়া আর কোন কথাই হয়নি। বিকালে আমি আর আমার কিছু ফ্রেন্ড মিলে ঘুরতে গেলাম। আমার এক ফ্রেন্ড শিশির এসে বলল,
দোস্ত! রাফু তো তোর উপর ক্রাশ খাইছে।
শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। বললাম,
মানে? কোন রাফু?
কানে কম শুনিশ? রাফু। ওই যে নতুন ছেলেটা। ও তোর উপর ক্রাশ খাইছে।
কিভাবে বুঝলি?
আজ ক্লাশ শেষে যেভাবে তোর ব্যাপারে ইনকোয়ারি করছিল। আর তাছাড়া.....
তাছাড়া কি?
তুই ওর সাথে কথা বলে চলে যাওয়ার সময় তোর দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিল। ওর চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো যে ও তোর প্রেমে পরছে।
যাহ! ভাগ! একদিন দেখায় কেউ কারো প্রেমে পরে নাকি?
বন্ধুরা মিলে হাসিঠাট্টা করেই ব্যাপারটাকে উড়িয়ে দিলাম।
এরপর বেশকিছুদিন কেটে গেলো। রাফুর দিকে দ্বিতীয়বার তাকানোই হয়নি। তবে একসাথে ক্লাসে থাকলে যতটুকু জানা যায়, জেনেছি। রাফুর বাড়ি এখানেই। ছেলেটা বেশ চুপচাপ। প্রয়োজন ছাড়া খুব একটা কথা বলে না। মেয়েদের সাথে তো কথাই বলেনা। আসলে মিশতেই পারেনা। যদি কখনো বে-খেয়ালে ওর দিকে চোখ পরে তাহলে দেখা যায় ও কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আর ওর সেই চোখ। উফ! মনে হয় খুলে নিয়ে যাই। কিন্তু আমার বদজাত ফ্রেন্ডগুলো প্রতিনিয়ত রাফুর নাম নিয়ে আমাকে জ্বালাতন করতো।
একদিনের ঘটনা, ব্রেক চলছে। এর পর এনাটমি টিউটোরিয়াল। শিশির আসছে। এপ্রন ঘাড়ে করে জুবুথুবু অবস্থায়। মনে হয় ঘুম থেকে উঠে আসছে। এসেই রাফুর পাশে বসে ঝিমুতে লাগলো। শিশিরকে পচানোর এই মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া করার পাত্রী আমি নই। এগিয়ে গেলাম শিশিরের কাছে। গিয়েই বেশ উঁচু গলায় সব্বাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে শিশিরকে পচানি দিতে লাগলাম। শিশির কিছু বলছেনা দেখে আমি আরও উদ্যম নিয়ে চিল্লাইতে লাগলাম। এমন সময় হঠাত করে রাফু আমার উপর চিল্লিয়ে উঠলো,
এই মেয়ে। তোমার সমস্যা কি? এতো চিল্লাচ্ছো কেন? তুমি তো পুরাই একটা পেইন।
ওর চিল্লানো শুনে পুরা ক্লাশ ওর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। শিশিরেরও ঝিমানি ছুটে গেছে। আমিও থ মেরে তাকিয়ে রইলাম। লজ্জায় অপমানে আমার কান দিয়ে ধুঁয়া বেরোতে লাগলো। আমার উপর কেউ কখনো এভাবে চিল্লায়নি। রাগে দুঃখে আমার গাল দুটো লাল হয়ে গেলো। কিছু না বলে ছুটে ক্লাস থেকে বেড়িয়ে গেলাম। সেদিন আর কোন ক্লাস করিনি। সোজা রুমে চলে আসলাম। সারাদিন অনেক মেজাজ খারাপ ছিল। মনে হচ্ছিলো রাফুকে ধরে সবার সামনে দুটো থাপ্পড় লাগালে শান্তি লাগলো। কেন থাপ্পড় লাগালাম না সে আফসোস হতে লাগলো সারাদিন। পরদিন কলেজ গেলাম। সারাদিন রাফুর দিকে একদম তাকাইনি। ক্লাস শেষে যখন ফিরছি। হঠাত করে পিছন থেকে কে যেন ডেকে উঠলো,
নাজিফা......
আমি পিছনে ঘুরতেই দেখি রাফু। ভদ্রতাবশত বললাম,
আমাকে বলছো?
আমাদের ব্যাচে নাজিফা নামে তো একজনই আছে। আর সে এখন আমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
কি বলবা? বলো।
সরি। কালকের ব্যবহারের জন্য আমি অনেক সরি।
ইটস ওকে। আমি কিছু মনে করিনি।
তারমানে তুমি আমাকে মাফ করে দিছ?
হ্যা! দিছি।
তাহলে?
তাহলে কি?
তোমার জন্য একটা জিনিস আনছিলাম।
বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিল। হাতে পাঁচটা কিটক্যাট। আমার সবচেয়ে পছন্দের চকলেট। কিটক্যাট দেখেই আমার মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। কিটক্যাট গুলো নিতে নিতে বললাম,
থ্যংকু। কিন্তু পাঁচটা কেন?
সরি শব্দটা ইংরেজিতে পাঁচ অক্ষরের। তাই কিটক্যাটও পাঁচটা।
কথাটা শুনেই হা হা হা করে হেসে উঠলাম আমি। এভাবেই টুকটাক কথা বলতে বলতেই রাফু আমাকে হোস্টেলে পৌঁছে দিল। কিন্তু সারাটা রাস্তা আমিই বকবক করে গেলাম। আর ও চুপচাপ শুনে গেলো।
এরপর থেকে ও আমার মানে আমাদের সার্কেলের বেশ ক্লোজ হয়ে গেলো। আড্ডা দিলে একসাথে দিতাম, ঘুরতে গেলেও একসাথে যেতাম। বলা যায়, সবসময় একসাথেই থাকতাম। কিন্তু পুরোটা সময় জুড়ে ও চুপচাপ থাকতো আর আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতো। ওর তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটা কখনো সেভাবে নোটিস করিনি।
প্রায় মাসখানেক পর। একদিন ক্লাস চলছে। ক্লাসে বসে ফেসবুক চালানো আমাদের নেশা নয় পেশা। হা হা হা। এমন সময় ওর নাম্বার থেকে একটা এসএমএস আসলো। লেখা ছিল,
Love You
ক্লাস শেষে ওকে ধরলাম। বললাম, 'এসবের মানে কি?'
ও কিছু বললনা। শুধুই হাসলো। হাসতে হাসতেই চলে গেলো। আমি বেশ অবাক হলাম। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতেই আবার এসএমএস,
Love You
আমি কোন রিপ্লাই দিলাম না। সন্ধায়, রাতে ঘুমানোর আগে একই এসএমএস। পরদিন ক্লাসে আবার সেই একই এসএমএস। এবার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেলো। রিপ্লাই দিলাম,
khb esy. ty na?? dekho amke eto nrml way te kw kokhno propose kre ni!!! it should be special!!!
এরপর ওর রিপ্লাই দেখে আমিতো পুরাই বেকুব বনে গেলাম। ও রিপ্লাই দিলো,
tumi serious hoila kan? saradin tmr sathe fazlami krchi. esb kichui na. vule jao ja blchi. i nvr felt for u!!!!!!
সেদিন আর কোন এসএমএস বা কথাও হলো না। পরদিন ক্লাসে এসে দেখি মহাশয় ক্লাসে আসেনি। ভাবলাম হয়তো কোন কাজে ব্যস্ত আছে। তারপর দিনেও ক্লাসে আসলো না। এবার শিশিরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম,
রাফুর কি হইছে রে?
ওর আবার কি হবে?
না। মানে, ক্লাসে আসে না ক্যান?
কি জানি। ইদানিং দেখছি রুম থেকেই বেশ কম বেড়োয়।
ও!
আর কিছু জানা হয়নি। আসলে জানার সময়ই হয়নি। কিছুদিন পরেই পহেলা বৈশাখ। সেদিন আমাদের কলেজে বেশ বড়সড় অনুষ্ঠান হবে। সেটার প্রস্তুতিতেই বেশ ব্যাস্ততায় কাটছিলো সময়।
শিশিরের সাথে কথা হওয়ার আরও দুই দিন পর রাফু কলেজে আসলো। ওকে জিজ্ঞেস ক্লাসে না আসার কারন জিজ্ঞেস করতেই ও উত্তর দিলো, 'সবসময় ক্লাস করতে হবে এটা কোন সংবিধানে লেখা আছে?'
আমি আর কথা বাড়ালাম না। কিন্তু একটা বিষয় খেয়াল করলাম। এই চার দিনে ও বেশ বদলে গেছে। বেশ এক্সট্রোভার্ট হয়ে গেছে। আর সুযোগ পেলেই আমাকে পচাচ্ছে। চার দিন আগের রাফুর সাথে এই রাফুকে আমি কোনভাবেই মিলাতে পারছিনা। ক্লাসরুম, প্রোগ্রামের রিহার্সেল, বন্ধুদের আড্ডায় সব জায়গায় সে আমাকে পচাচ্ছে। যেন আমাকে পচানোই তার এইম ইন লাইফ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ওকে কোন কাজ দিলেই একটা ডায়লগ দিচ্ছে, 'নাজু বলেছে আর রাফু পারবেনা, এমন কিছু হতেই পারেনা।' ওর ব্যবহার আমাকে সবসময় চমকে দিচ্ছিল। মাঝে মাঝে যখন ফ্রেন্ডরা মিলে কার কেমন জীবনসঙ্গী পছন্দ তা নিয়ে আলাপ করতাম তখন ও আমার কথা বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনতো। আর তার সেই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকা তো আছেই।
দেখতে দেখতে চলে আসলো পহেলা বৈশাখ। সারাদিন কলেজে প্রোগ্রাম চললো। সন্ধার পর শুরু হলো কনসার্ট। সবাই অনেক মজা করছি। লাফালাফি, নাচানাচি, গলা ছেড়ে গান গাওয়া। সবকিছুর ভিতরে খেয়াল করলাম রাফু অন্য সবার সাথে মজা করছে কিন্তু আমাকে এভয়েড করছে। আমি নাচানাচি করতে করতে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেই ও সেখান থেকে সরে যাচ্ছে। কোন ভাবে চোখে চোখ পড়লেই মুখ ঘুড়িয়ে নিচ্ছে। যেন ও চাচ্ছে যে আমি দেখি যে ও আমাকে এভয়েড করছে। অনেক রাগ হলো। আসলে কেমন যেন অন্য রকম একটা ফিলিংস হচ্ছিলো। পুরাই আজিব লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো আশেপাশের সবকিছু ভেঙে ফেলি। রাগে দুঃখে বেড়িয়ে গেলাম গ্যালারী থেকে। চুপচাপ হাঁটছিলাম। মিনিট দুয়েক পরেই পিছন থেকে ভেসে আসে রাফুর গলার আওয়াজ।
নাজু। এই নাজু।
কি হইছে? বলো।
তুমি এখানে কেন?
এমনিতেই। ভালো লাগছে না।
এরপর ও যা করলো তা আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। ও হাত বাড়িয়ে দিয়ে পুরা ফিল্মি স্টাইলে বললো, 'আমার সাথে নাচবা একবার?'
আমি পুরা শকড। কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না। ওর সেই চোখ। ওই মায়াকাড়া চোখ দুটোই আমাকে ওর সাথে নাচতে বাধ্য করে দিলো।
পরদিন পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক আমরা সাত দিনের অটো নিয়ে বাড়ি যাই। আমরা ঢাকার সবাই একসাথে একই বাসে যাচ্ছিলাম। রাফুও কি কাজে যেন ঢাকা যাচ্ছিলো। সারাটা পথ সে আমার পিছনেই লেগে ছিল। ও যে আমার কতটা কেয়ার করে সেটা আমি ওইদিন বুঝতে পারি। ও গাবতলিতে নেমে যায় আর আমরা নামবো কল্যাণপুর। নামার সময় ও বারবার পিছন ফিরে তাকাচ্ছিল আর বারবার 'বাই' বলছিল। যেন ওর যেতে একদম ইচ্ছে করছে না। ব্যাপারটা সবাই খেয়াল করছিলো। আমি বেশ বিব্রতবোধ করছিলাম আর মনে মনে বলছিলাম, 'এমন করছে কেন? মাত্র সাতটা দিনই তো।'
বাসায় আসার পর আব্বু, আম্মুর ভালবাসায় আর আদরে সবকিছু একদম ভুলে যাই। মাঝে মাঝে রাফু টেক্সট করতো, 'কি করো?' 'খাইছো কি না?' এই টাইপ। আমিও হ্যা/না রিপ্লাই দিতাম। সারাদিনই ফেসবুকে অনলাইন হয়ে বসে থাকতো, আমার জন্য অপেক্ষা করতো। ওর এসব কাজকর্ম আমি একসময় ওকে নিয়ে ভাবতে শুরু করি। কিন্তু আব্বু, আম্মুর মুখের দিকে তাকিয়ে সেই ভাবনাটাকে প্রশয় দেইনি। আব্বু, আম্মুর একমাত্র সন্তান আমি, তারা রিলেশন জিনিসটা তেমন একটা পছন্দ করে না। তার উপর রাফু আর আমি সেম এইজের। নিজের সাথেই নিজে যুদ্ধ করতে করতেই কেটে গেলো সাত সাতটি দিন। ফিরে আসতে হলো আবার সেই নিয়মতান্ত্রিক জীবনে। প্রতিবারের মতো এবারো কান্নাকাটি করতে করতে ঢাকা ছাড়লাম।
ফিরে আসার পর খেয়াল করলাম রাফু আরও এক্সট্রোভার্ট হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আমাকে ফোন দিত। কিন্তু আমি ওর ফোন পারতপক্ষে রিসিভ না করার ট্রাই করতাম। রিসিভ না করেও পারতাম না। বারবার ফোন দিত। ফোন দিতেই থাকতো। একদিনের কথা। সারাদিন ফোন দিছে। ধরিনি। ঠিক রাত ১২টার সময় ওর ফোন ধরলাম। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে রাফু বলে উঠলো,
একটু বারান্দায় আসবে? প্লিজ
না। এখন পারবো না। কি বলবা বলো।
একটু আসো। প্লিজ। একবার।
এতো বারবার রিকোয়েস্ট করার পর আমি গেলাম বারান্দায়। বারান্দায় গিয়ে দেখি মহাশয় হোস্টেলের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমার সাথে কথা বলছে।
এখন বলো। কি বলবা?
ও রাস্তার মাঝখানে হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়লো। এক হাতে ফোন কানে ধরে বললো,
আমি তোমাকে ভালবাসি। আমি নিজেকে অনেক কন্ট্রোল করেছি। কিন্তু আর পারছিনা। আমার তোমাকে চাই। তুমি সবসময় হাসো। সবাইকে হাসিখুশি রাখো। সবাই তোমার হাসি দেখে কিন্তু কেউ দেখে না হাসি শেষে তোমার নিরবতা। তুমি সবার কথা শুনো। সবার কথা ভাবো। কিন্তু কেউ ভাবে না তোমার কথা। এই জগতটা যে তোমার ভালো লাগে না সেটা কেউ বুঝে না।
এরপর চিৎকার করে বললো,
আআআআমিইইইইই তোমাআআআআআআআকেএএএ ভালবাসিইইইই।
আমি কিছু না বলে ফোন কেটে দিয়ে রুমে চলে গেলাম। রাফু বারবার ফোন দিচ্ছিলো। আমি ফোন সুইচ অফ করে দিলাম। সে রাতে আমার একটুও ঘুম হয়নি। সারারাত বালিশে মুখ গুজে কেঁদেছি শুধু। সারারাত ওর কথাগুলো কানে বেজেছে শুধু।
এরপর থেকে আমি ওর সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। ওর ফোন ধরতাম না। এসএমএস এর রিপ্লাই দিতাম না। কলেজে দেখা হলেও এড়িয়ে যেতাম। ও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতো। আমারও বেশ খারাপ লাগতো। কিন্তু এর মধ্যেই দুই জনের কল্যান। দিনগুলো কেটে যাচ্ছিলো এভাবেই। এর মাঝে শুনলাম ও সিগারেট খাওয়া শুরু করছে। তখন ওকে ঘৃণা করা শুরু করলাম। কিন্তু মনের কোন এক কোণে খুব কষ্ট হতো। অপরাধবোধে ভুগতাম সারাক্ষণ। সবসময় মনে হতো ছেলেটা বুঝি আমার জন্যই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মনের এই ভাবনাটাকে খুব বেশি পাত্তা দিতাম না। এভাবে কেটে গেলো অনেক দিন।
২ডিসেম্বর। আমার জন্মদিন। আব্বু, আম্মুকে ছেড়ে এই প্রথম বাড়ির বাইরে আমার জন্মদিন। ১১ তারিখ রাত ঠিক ১১টা ৫০ মিনিটে ফোন বেজে উঠলো। রাফুর নাম্বার থেকে। কি ভেবে রিসিভ করলাম। টুকটাক কথা বলতে বলতে বেজে গেলো ১২টা ১মিনিট। রাফু গীটার বাজিয়ে তপুর ‘আজ জন্মদিন তোমার’ গানটা গেয়ে সবার আগে আমাকে উইশ করলো। ওর সাথে কথা বলতে বলতেই আমার হোস্টেলের ফ্রেন্ডরা একসাথে আমার রুমে এসে আমাকে উইশ করলো। ওরা আসায় রাফুর ফোন কেটে দিতে হলো। এরপর ফ্রেন্ডরা মিলে কেক কাটা, হই হুল্লোড়, কেক মাখামাখি, গান, নাচানাচি, চিল্লাপাল্লা করতে করতে প্রায় রাত ৩টা বেজে গেলো। অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে পরলাম।
ভোর ৬টা। ফোনের রিংটোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেলো। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে রাফু বললো,
একটু বারান্দায় আসো।
বারান্দায় গিয়ে ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখি হোস্টেলের সামনের রাস্তার সেই একই জায়গায় সে হাঁটু গেঁড়ে বসে আছে আর হাতে তার এক গুচ্ছ লাল গোলাপ। এবারও চিল্লিয়ে বললো,
ভালোবাসিইইইইই
আমি আনন্দে কেঁদে ফেললাম। ছোটবেলা থেকেই আমার একটা স্বপ্ন ছিলো। যে মানুষটা আমার জন্মদিনের ভোরবেলা এক গুচ্ছ লাল গোলাপ নিয়ে আমাকে প্রোপোজ করবে তাকেই আমি এক্সেপ্ট করবো। কিন্তু আমার এই স্বপ্নের কথা আমি কাউকেই কখনও বলিনি। চোখের সামনে এভাবে আমার স্বপ্ন সত্যি হবে তা কখনও কল্পনাও করিনি। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। দৌড়ে নিচে নেমে গিয়ে জড়িয়ে ধরলাম ছাগলটাকে। ওর বুকে মুখ গুঁজে হু হু করে কাঁদতে থাকলাম। মনটা কেমন জানি খুব শান্তি শান্তি লাগছিল। ও বলতে থাকলো,
তোমার প্রতিটা জন্মদিন আমি স্পেশাল করে দিবো। প্রতিটা দিন করে দিবো স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর। তোমায় অনেক ভালবাসি নাজু।
ওর বুকে মুখ গুজেই বলে উঠলাম,
তুমি আর সিগারেট খাবানা। আর যদি কখনও সিগারেট খাও তাহলে আর কখনও আমি বারান্দায় আসবো না। ছাগল একটা।
ডিএসএস/
লেখক, ছড়াকার ও সাংবাদিক