বিমান ভাড়া ও হজের খরচ কমাতে প্রধানমন্ত্রীকে খোলা চিঠি
বিমান ভাড়া এবং হজের খরচ কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে খোলা চিঠি লিখেছেন ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিষদ।
বুধবার (২৯ মার্চ) গণমাধ্যমে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। সংগঠনের সভাপতি শহিদুল ইসলাম কবির প্রধানমন্ত্রীকে এই খোলা চিঠি লিখেছেন।
নিম্নে পাঠকের জন্য খোলা চিঠিটা হুবহু তুলে ধরা হলো:
বরাবর
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
ঢাকা।
বিষয়: হজ্জ প্যাকেজ কমানোর আবেদন প্রসঙ্গে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহ। আশাকরি সুস্থ থেকে দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছেন। দেশের একজন নাগরিক ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে বর্তমান সময়ে আমরাও নানাবিধ সমস্যা, সংকটের মধ্যে দিনাতিপাত করছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধগতি, গ্যাস ও বিদ্যুতের অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধি, গরুর গোস্ত খেতে ব্যর্থ গরিবের খাবার ডিম ও পোল্ট্রি মুরগির মূল্য দ্বিগুণ বৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ যে চরমে পৌঁছেছে তা নিশ্চয়ই আপনার অজানা নয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
আপনি নিশ্চয়ই অবগত রয়েছেন, হজ শুধু ইবাদতই নয়, বরং আত্মিক পরিশুদ্ধতার এক অনস্বীকার্য পদ্ধতি। আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হজের বিনিময় নিশ্চিত জান্নাত। এ সম্পর্কে হাদিসে বলা হয়েছে, ‘কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়’। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা পথের ব্যয় নির্বাহ করতে সক্ষম তাদের ওপর আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে কাবা ঘরে হজ্জ পালন করা ফরজ’ (সূরা বাকারা : ৯৭)। ‘আল্লাহ তায়ালা যাকে হজ পালনের সামর্থ্য দিয়েছেন অথচ সে হজ না করে মৃত্যু বরণ করে, তাহলে সে দোজখের যন্ত্রণাদায়ক শাস্তিতে পতিত হবে’ (মিশকাত)।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে সামর্থ্যবানদের হজ পালন করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। আর যাদের উপর হজ ফরজ হয়েছে তারা হজ যেতে না পারার কারণে আল্লাহর দরবারে অপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হবেন। তাদের গোনাহের ভাগ রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আপনার উপর ও বর্তাবে বলে আমি মনে করি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
হজের খরচ বৃদ্ধির কারণ যখন অস্বাভাবিক বিমান ভাড়া নির্ধারণ, তখন বিশ্বের অন্যান্য দেশের বিমান ভাড়া ও দূরত্ব আপনার বিবেচনা ও অবগতির জন্য তুলে ধরছি।
১। ভারতে সরকারিভাবে এয়ার ইন্ডিয়া কোলকাতা থেকে জেদ্দা পর্যন্ত বিমান ভাড়া সরকারী ৪৫ থেকে ৫০ হাজার রুপি, বেসরকারিভাবে ১ লাখ টাকা।
২। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে জেদ্দা আকাশ পথে দূরত্ব ৭ হাজার কিলোমিটার। সৌদি এয়ারলাইন্স এ ভাড়া ৪ হাজার রিঙ্গিত যা বাংলাদেশি টাকায় ১ লাখ টাকা।
৩। ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা থেকে জেদ্দার দূরত্ব ৮ হাজার কিলোমিটার, বিমান ভাড়া ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা।
৪। যুক্তরাষ্ট্রের লসঅ্যাঞ্জেলস থেকে জেদ্দার দূরত্ব ১৩ হাজার ৩৯৫ কিলোমিটার। বিমানে সময় লাগে ১৫ ঘণ্টা ২০ মিনিট। যার বিমান ভাড়া ১৭০০ ডলার যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা।
৫। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে জেদ্দা শহরের দূরত্ব ১০ হাজার কিলোমিটারের বেশি। রয়েল জর্ডান এয়ারলাইন্স এ ভাড়া ৭৮০ ডলার বাংলাদেশি টাকায় ৮০ হাজার টাকা। গতবছরের হজ্জ এ সৌদি এয়ারলাইন্স এ টিকেট কেনা হয়েছে ১৮০০ ডলারে।
৬। আয়ারল্যান্ড থেকে জেদ্দার দূরত্ব ৬ হাজার ৭৭৯ কিলোমিটার। বিমান ভাড়া ৮০ থেকে ৮৫ কিলোমিটার।
৭। জার্মানির বার্লিন থেকে সৌদি আরবের জেদ্দার দূরত্ব ৫ হাজার ৩৪০ কিলোমিটার।ফ্রাঙ্কফুট থেকে জেদ্দার দূরত্ব ৫৪৮০ কিলোমিটার। বিমান ভাড়া ৫৭১ থেকে ৮৫০ ইউরো। যা বাংলাদেশি টাকায় ৬০ থেকে ৯০ হাজার টাকা।
৮। বাংলাদেশ থেকে জেদ্দার দূরত্ব সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার হলেও ওমরায় ৮০ হাজার টাকার বিমান ভাড়া খোড়া অজুহাত দেখিয়ে হজ ১ লাখ ৯৭ হাজার ৭৯৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। উপরে উল্লেখিত বিমান ভাড়ার পরে বাংলাদেশের হজযাত্রীদের উপর জুলুম ও অমানবিক আচরণ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
একইভাবে বিভিন্ন দেশের হজ প্যাকেজ আপনার সিদ্ধান্তগ্রহণ ও অবগতির জন্য তুলে ধরছি ।
১।ইন্দোনেশিয়া থেকে একজন মুসলমানকে হজে যেতে হলে ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৩৪৭ টাকা খরচ করতে হবে। যা গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি।
২। মালয়েশিয়ায় যেসব পরিবারের মাসিক আয় ৯৬ হাজার টাকার কম, সেসব পরিবারের সদস্যদের জন্য হজের খরচ ধরা হয়েছে দুই লাখ ১৮ হাজার ৭৫৪ টাকা। মাসিক আয় বেশি হলে দিতে হবে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৬০০ টাকা। দেশটিতে হজের জন্য সরকার বড় অঙ্কের ভর্তুকি দিয়ে থাকে।
৩। পাকিস্তানে গত বছরের তুলনায় হজের খরচ ৩৬.৫৯ শতাংশ বাড়িয়ে ১১ লাখ ৭০ হাজার পাকিস্তানি রূপি যা বাংলাদেশি টাকায় ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৬১৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
৪। ভারতে ২০২১ সালে এই খরচ ছিল বাংলাদেশি মুদ্রায় চার লাখ ২৩ হাজার ৫৭১ টাকা। তবে সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, হজ্জ প্যাকেজের খরচ ৫০ হাজার টাকা কমানো হবে। অর্থাৎ সেদেশে হজ কমিটি অব ইন্ডিয়ার মাধ্যমে যারা হজ যাবেন, তাদের খরচ হবে চার লাখ টাকার কম।
৫। সিঙ্গাপুরে হজের খরচ গত বছরের তুলনায় প্রায় দেড় হাজার ডলার বেড়েছে। সেখানে সবচেয়ে কম প্যাকেজের জন্য দিতে হবে ৬ লাখ ৬০ হাজার ৯২০ টাকা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে হজের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদাত করার জন্য রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেভাবে সহযোগিতা ও পৃষ্টপোষকতা দেবার প্রয়োজন ছিল এ ক্ষেত্রে আমরা তা দেখছি না। হজ প্যাকেজ নির্ধারণ দেখে মনে হচ্ছে হাজীদেরকে শোষণ করতে বিমান ভাড়া ও হজের এই প্যাকেজ তৈরি করতে হয়েছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে বাংলাদেশে হজ হচ্ছে বিমানের সারা বছরের লোকসান কাটিয়ে লাভবান হবার মোক্ষম সুযোগ। মধ্যবিত্ত শ্রেণির হজ যাত্রীদের পকেট কাটার হাতিয়ার। এ ছাড়া, সরকার যেখানে ভর্তুকি দিয়ে হজ যাত্রীদেরকে ফরজ ইবাদাত পালনে সহযোগিতা করবে সে ক্ষেত্রে ভ্যাট ট্যাক্সের বোঝা দিয়ে হজ যাত্রীদের খরচ বৃদ্ধি করেছে। মাননীয় বিচারপতিরা যাকে বলেছেন অমানবিক হজ প্যাকেজ। বাংলাদেশে গত বছর কোরবানি ছাড়া বেসরকারি‘সাধারণ’হজ্জ প্যাকেজের সর্বনিন্ম ব্যয় ছিল ৫ লাখ ২২ হাজার টাকা। এবারের হজ্জে সেই ব্যয় ধরা হয়েছে কোরবানি ছাড়া ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৪ টাকা। অর্থাৎ এক বছরে খরচ বেড়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৬১৮ টাকা। তার সঙ্গে কোরবানির টাকা মিলিয়ে বাড়তি অংক ২ লাখ ছুঁয়ে ফেলবে। এখানে স্পষ্ট এ বছরে একজন হজ্জ যাত্রীর খরচ পড়বে কম পক্ষে ৯ লাখ টাকা। এছাড়া হজ্জ পালনকারীকে বাড়িতে পরিবারের ভরণপোষণ ও কুরবানির জন্য কমপক্ষে আরো দেড় থেকে ২ লাখ টাকা খরচ করতে হবে। সব মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে এবারের হজ্জ পালন করতে। যা সাধারণ মুসলমানদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
দেশের মানুষ মনে করছে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদেরকে হজ্জ পালন থেকে বিরত রাখতে ইসলাম ও মুসলমানদের কোন দুশমনদের কল কাঠিতে মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। মুসলমানদের আবেগ অনুভূতি ধ্বংস করে হজ্জ পালনকে যারা কঠিন করছে তারা আগামী নির্বাচনে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে একটি ইস্যু সৃষ্টির জন্য কাজ করছে বলে আমরা মনে করছি। এবারের হজ প্যাকেজে অস্বাভাবিক উচ্চমূল্য নির্ধারণের ফলে হজ পালনও সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
হজ্জের সময় চাহিদা বেশি থাকায় বিমান ভাড়ার খরচ বৃদ্ধি স্বাভাবিক। কিন্তু চার, পাঁচ গুণ বৃদ্ধি অস্বাভাবিক। উপরন্তু এবার হজ্জ উপলক্ষে সৌদি সরকার বিভিন্ন ফি কমিয়েছে। ওমরাহ ও হজের জন্য কোনো ভিসা ফি লাগবে না। সৌদি আরবের হজ ও উমরা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে এই বিষয় স্পষ্ট করে বলা আছে। এরপরও হজ্জের খরচ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এবারের প্যাকেজে বিমানভাড়া ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা। হজের বিশেষ ফ্লাইটে যাত্রীরা যাতায়াত করেন। কিন্তু তাই বলে ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকা বিমানভাড়া বেশি বলেই মনে হচ্ছে। বাংলাদেশ বিমান ও সৌদি এয়ারলাইনস ছাড়াও অন্যান্য একাধিক বিমান সংস্থাকে হজযাত্রী পরিবহনে যুক্ত করা হলে বিমানভাড়া কমে আসতে পারে। মুজদালিফায় যাতায়াতের জন্য বিনামূল্যে পরিবহনব্যবস্থা থাকে। সরকারের পাশাপাশি সৌদি আরবের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানি বিনামূল্যে পরিবহন সুবিধা দিয়ে থাকে। তাই উন্নতমানের বাস ভাড়ার কথা বলে ১৯ হাজার টাকা আদায় অতিরিক্ত ও অযৌক্তিক খরচ বলে মনে হয়েছে।
হজ প্যাকেজের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা যায়। প্রথমত, ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হজের মতো ধর্মপালনের রীতিকেও সরকার লাভজনক ব্যবসা হিসেবে বিবেচনা করছে বলে আমরা মনে করি। তা না হলে খরচ এতটা বৃদ্ধি পাওয়ার কথা নয়। হজের এই অস্বভাবিক খরচ বৃদ্ধির নেপথ্যে যে রাজনৈতিক শক্তির মদতপুষ্ট শ্রেণির অতিমুনাফালোভী গোষ্ঠীর হাত আছে, সে ধারণা আমরা করতে পারি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য হজ পালন এখন স্বপ্নের বিষয়ে পরিণত হতে যাচ্ছে। এত টাকা খরচ করে সাধারণ মানুষের পক্ষে হজে যাওয়া সম্ভব নাও হতে পারে। অনেকেই সরকারি চাকরি থেকে অবসরে গিয়ে বা শেষ বয়সে সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে হজে যান। স্বল্প আয়ের এসব মানুষ এখন যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করবেন হজ থেকে। যে কারণে অনেকেই ওমরাহ হজের দিকে আগ্রহী হচ্ছেন। সম্প্রতি ওমরাহ হজ পালন করেছেন-এমন লোকজন জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়ার শ্রেণিগত পরিবর্তন হচ্ছে। আগে হজে সমাজের সব শ্রেণির মানুষ অংশগ্রহণ করতেন। আর উমরা ছিল উচ্চবিত্তের রীতি। এখন হজে উচ্চবিত্তরা বেশি যান। উমরায় নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তের ভিড় বাড়ছে। কারণ, এত অর্থ ব্যয় করে সাধারণের পক্ষে হজে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
এ পরিস্থিতিতে আপনার নিকট আকুল আবেদন জানাচ্ছি যে, আপনার সরাসরি হস্তক্ষেপে হজ্জ যাত্রীদের বিমান ভাড়া ১ লাখ টাকা যেমন কমানো সম্ভব। তেমনি অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশে ভর্তুকি দিয়ে হলেও ৪ লাখ ৫০ টাকা হজ্জ প্যাকেজ করা সম্ভব হবে। আশাকরি অনেক অসম্ভবকে সম্ভব যেমন আপনি করতে সক্ষম হয়েছেন তেমনি হজ্জের খরচ সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আনতে প্যাকেজ করা আপনার সহযোগিতা ও নির্দেশে সম্ভব হবে।
বিনীত নিবেদক
শহিদুল ইসলাম কবির
সভাপতি, ইসলামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম পরিষদ
এমএইচ/এমএমএ/