প্রথম পর্ব
ফেসবুকে ইংরেজি শেখানোর ধুম, আসলে কতটা কার্যকরী?
ফেসবুক খুললেই দেখা যায় কিছু কিছু শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা কোচিংয়ের মালিক ইংরেজি শেখাচ্ছেন। অনেক শিক্ষার্থী, আগ্রহী লোকজন আবার প্রচুর কমেন্ট করছেন এভাবে- ইংরেজি শেখার সঠিক মাধ্যমটি পেলাম, এতদিন ইংরেজি শেখা থেকে বঞ্চিত ছিলাম, যথার্থ ইংরেজি ক্লাস, সাককেসফুল ইংরেজি টিচার, এই ধরনের ইংরেজি শিক্ষকই দেশে প্রয়োজন’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কেউ কেউ লিখেছেন স্যার আপনার ক্লাস আমি প্রতিদিন দেখি, অনেকে তার ভিডিও পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেছেন। আবার লেখা আছে ভিডিওটি বার বার দেখার জন্য ক্লিক দিয়ে রাখুন ইত্যাদি।
এবার দেখা যাক তারা কী ইংরেজি শেখাচ্ছেন । দেখলাম জনৈক শিক্ষক ইংরেজি শেখাচ্ছেন— আই অর্থ আমি, অ্যাম অর্থ হয়। বি অর্থ হয়, টু বি অর্থ হতে। এটি কি অ্যাকটিভ ভয়েস, এটি কি প্যাসিভ ভয়েস। অ্যাকটিভ ভয়েসের গঠন প্রণালি কী? প্যাসিভের গঠন প্রণালি কী? সাবজেক্টকে অবজেক্ট করতে হয়, তারপর অকজিলারি ভার্ব বাসাতে হয়, তারপর ভার্বের পাস্ট পার্টিসিপল ফরম বসাতে হয়। মাঝে মাঝে আবার শিক্ষার্থীদের লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছেন। আই অর্থ আমি, ইট মানে খাওয়া আর আমি খাই— আই ইট, কি খাই ভাত মানে রাইস। ‘অ্যাম টু’, ইজ টু মানি ‘তে হয়’— এভাবে কী ইংরেজি শেখা যায়? এই জাতীয় ইংরেজি পড়ানোর মধ্যে নতুনত্ব কী আছে? আমরা তো এভাবেই পড়ে এসেছি কিন্তু বাস্তব জীবনে কী ব্যবহার করা হচ্ছে? ক’জন ইংরেজি ব্যবহার করতে পারছে? এভাবে গ্রামার ট্রান্সলেশন মেথডে ইংরেজি পড়িয়ে শিক্ষার্থীদের দক্ষ করা যাচ্ছে না অর্থাৎ বাস্তব জীবনে তারা শোনা, বলা, পড়া ও লেখা—এর কোনোটিতেই ফলপ্রসূভাবে ইংরেজি ব্যবহার করতে পারছে না। তাই আমাদানি করা হলো’ কমিউনিকেটিভ ইংলিশ’।
কমিউনিকেটিভ ইংরেজির মূল বৈশিষ্টগুলো কী? ‘পার্সোনাল এনগেজমেন্ট’ অর্থাৎ শিক্ষার্থীকে অ্যাক্টিভিটি করতে হবে, গ্রামারের নিয়ম মুখস্ত করবে না, গ্রামার পড়বে কনটেক্সটচ্য়ুয়ালি অর্থাৎ টেক্সট থেকে, কোনো গল্প পড়ে সেখানে থেকেই গ্রামার শিখবে, শিক্ষার্থীদের ফ্লুয়েন্সির ওপর অর্থাৎ ভাষা ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে। যে ট্রান্সলেশন মেথডের বিপরীতে ‘কমিউনিকেটিভ ল্যাংগুয়েজ টিচিং’ বা সিএলটি এল, দুনিয়াব্যাপী এখন এটি নিয়ে চর্চা হচ্ছে, গবেষণা হচ্ছে, আলোচনা হচ্ছে, সেখানে এখনো শিক্ষকরা আই অর্থ আমি, কুক অর্থ রান্না করা, রাইস অর্থ ভাত অর্থাৎ আমি ভাত রান্না করি। এটি হচ্ছে একটিভ ফর্ম এবং প্যাসিভ ফর্ম হচ্ছে রাইস ইজ কুকড বাই মি, তাও দেখলাম টিচারই সব বলে দিচ্ছেন, প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার পর শিক্ষার্থীরা উত্তর দিচ্ছে বিষয়টি এমনভাবেও করাচ্ছেন না। শিক্ষক নিজে নিজেই সব বলে দিচ্ছেন। সিএলটি-তে পার্সনাল এনগেজমেন্ট বলতে যা বুঝাচ্ছে তার ধারে কাছেও নেই।
কমিউনিকেটিভ ইংরেজিতে টার্গেট ল্যাংগুয়েজ যত বেশি বেশি ব্যবহার করানো হবে, শিক্ষার্থীদের জন্য তা ততই মঙ্গলজনক, শিক্ষার্থীরা কনটেক্সট থেকে, সিসুয়েশন থেকে ইংরেজি শিখবে, পারিপাশ্বিক অবস্থা থেকে শুনে শুনে ইংরেজি শিখবে কিন্তু সেই পরিবেশ স্বাভাবিক কারণে আমাদের থাকবে না কারন আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আমরা আমাদের চারপাশে বাংলা শুনব, সবাই বাংলা ব্যবহার করবে, এটিই স্বাভাবিক। যেহেতু কমিউনিকেটিভ ইংরেজিতে ইংরেজির একটি পরিবেশ তৈরি করতে বলা হয় ,সেটি শিক্ষককেই নিশ্চিত করতে হয়। তিনি সর্বদাই সহজ ইংরেজিতে কথা বলবেন, কিছু কিছু শিক্ষার্থী সেগুলো শুনে প্রথমে সবটুকু কিংবা অনেক অংশই বুঝবে না, তারপরেও বলতে হবে। শুনে শুনে তারা শিখতে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। এই বিষয়টি কন্টেজিয়াস অর্থাৎ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে । শিক্ষক নিজে যদি ইংরেজি ব্যবহার করেন, সেটি শিক্ষার্থীদের ভেতর সংক্রমিত হয়। শিক্ষার্থীরাও তখন ইংরেজি বলা শুরু করতে চাইবে। কিন্তু ফেসবুকে যারা ইংরেজি শেখাচ্ছেন এক দু’জন ছাড়া সবাই বাংলায় শুধু গ্রামার ব্যাখ্যা করছেন, ভাষার ব্যবহার নেই বললেই চলে। পুরোটাই বাংলা বলছেন। বাকি যে কাজটুকু করছেন তা হচ্ছে ট্রান্সলেট করছেন বাক্য, শব্দ যা বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি নয়। কিছু ক্ষেত্রে হয়ত ট্রান্সলেশন ব্যবহার করা যেতে পারে, কিন্তু ওনারা যেটি করছেন পুরো ইংরেজি গ্রামার পড়াচ্ছেন, পড়াচ্ছেন বাংলায় যে বিষয়গুলো আমাদের স্কুল ও কলেজ জীবনে ঘটেছে, এখনো ঘটছে। ফলে শিক্ষার্থীরা ভাষা ব্যবহারের অর্থাৎ ইংরেজি শুনে বুঝা, নিজে ইংরেজিতে কিছু বলা, ইংরেজি পড়ে মর্মোদ্ধার করা এবং নিজে কিছু ইংরেজি লেখা। এর কোনোটাই কিন্তু ফেসবুকের টিচাররা করাচ্ছেন না, শুধু গ্রামারের নিয়ম আর স্ট্রাকচার করাচ্ছেন। শিক্ষার্থীরা থাকছেন অধিকাংশ সময়ই ইনঅ্যাকটিভ।
ভাষা শিখতে হলে নিজেকে এনগেজড হতে হবে, নিজেকে খেলোয়ার হতে হবে। মাঠের ভেতর খেলোয়াররা খেলছেন আর আপনি যদি মাঠের বাইরে বসে হাত তালি দেন তাতে আপনি খেলোয়ার হতে পারবেন না। খেলোয়ার হতে হলে আপনাকে মাঠে নামতে হবে, ফুটবলে লাথি দিতে হবে, ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিতে হবে, প্রাকটিস করতেই হবে।
অনেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবক বলে থাকেন— ‘ওমুক স্যার সুন্দর করে গ্রামার বুঝিয়ে দেন, কাজেই ওনার কাছে পড়লেই কেল্লা ফতে।’ গ্রামার বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, বুঝার বিষয়। একটি ভাষা কীভাবে গঠিত হয়েছে তার ব্যবহার থেকে, এপ্লিকেশন থেকে, টেক্সট থেকে আপনাকে বুঝতে হবে এবং নিজে নিজে আবিষ্কার করতে হবে এটি যেভাবে হলো তার যুক্তিটি কি। নিজে আবিষ্কার করলে সারাজীবন মনে থাকবে। একজন শিক্ষক আপনাকে বলে দিল ‘থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নম্বর হলে ভার্বরের শেষে এস বা ইয়েস যোগ করতে হয়। আপনি বুঝলেন, সেটি অনেক দিন ধরে রাখতে পারবেন না। ধরে রাখলেও ব্যবহার করতে পারবেন না, আপনার ব্যবহার করে করে অটোমেটিক আপনার ঠোঁটে, আপনার হাতে লেখায় নিয়ে আসতে হবে। সেটি না হলে ভাষা শিক্ষা হচ্ছে না। সাইকেল কিংবা মটর সাইকেলে আপনার সামনে যিনি আছে তিনি যদি সব সময় চালান তাতে আপনার কষ্ট কম হয়, টেনশন কম, আপনি আরামে থাকেন কিন্তু আপনি কখনো চালানো শিখতে পারছেন না। বিষয়টি ঠিক এ রকম যখন কোনো শিক্ষক আপনাকে বার বার বলে দিচ্ছেন, তাতে আপনার কষ্ট হয়ত কম হচ্ছে কিন্তু আপনি ভাষা ব্যবহার করা শিখছেন না। সাঁতার কাটতে হলে আপানকে পানিতে নামতে হবে, পানিতে নেমে সাঁতার কাটতে হবে। এখানে শিক্ষকের ভূমিকা হবে ‘ফেসিলিটেশন’ অর্থাৎ সাঁতার কাটার সময় আপনার পাশে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, মাঝে মাঝে প্রয়োজনে আপনাকে সহায়তা করছেন কিন্তু সাঁতার আপনাকেই দিতে হবে। ভাষা শেখার বিষয়টি ঠিক তাই। শিক্ষক নিজে সাঁতার কাটতে থাকলে শিক্ষার্থীরা সাঁতার কাটা শিখবে কীভাবে?
আমরা দেখতে পাচ্ছি এলাকাভিত্তিক কিছু কিছু শিক্ষক, কিছু কোচিং সেন্টার, কিছু শিক্ষার্থী নিজের আগ্রহে ইংরেজি শেখানোর চেষ্টা করছেন। তারা মূলত নিজ উদ্যোগে নিজেদের ব্যক্তিগত চিন্তায় ও ধারণায় যা এসেছে তা দিয়ে ইংরেজি শেখানোর চেষ্টা করছেন। এগুলো কিন্তু ভাষা শেখানোর মূল পদ্ধতি, অ্যাপ্রোচ থেকে আলাদা। তারা ট্রাডিশনাল পদ্ধতিই ব্যবহার করছেন। এতে স্থানীয়ভাবে কিছু শব্দ ও কিছু বাক্য তৈরি করতে পারবে শিক্ষার্থীরা, নির্ভুলই তৈরি করবে কিন্তু ভাষার ভিত্তি বা ভাষার ব্যবহার করার যে দক্ষতা, কম্পিটেন্সিগুলো অর্জিত হয় না।
ইংরেজি কিছু গল্প, ইংরেজির কিছু টেক্সট, ইংরেজি পত্রিকার কিছু সংবাদ ও কলাম শিক্ষার্থীরা পড়ে দেখলে সেটি চমৎকার প্রাকটিস। সেটি তারা বুঝে কিনা। একজন নেটিভ স্পিকারের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারেন আপনি তার কথা বুঝতে পারছেন কিনা, তিনি কীভাবে ইংরেজি ব্যবহার করছেন সেগুলো লক্ষ্য করবেন, দেখবেন আমরা যে, বলি বারটি টেন্স মুখস্থ করলে ইংরেজি ভাষা পুরোটাই শেখা হয়। এ কথার ভিত্তি কতটা সেটিও টের পাবেন। একজন নেটিভ স্পিকার অর্থাৎ যার মাতৃভাষা ইংরেজি তার সঙ্গে কথা বলে। আই ইট রাইস, আই গো, ইউ গো শিখিয়ে সময়ই অপচয় হচ্ছে। যে অপচয় আমরা দীর্ঘ বার বছর করেছি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত। ওই ইংরেজি শিখে ইংরেজি ভাষা ক’জন শিখতে পেরেছে তার প্রমাণ আপনি হাতে হাতেই পেয়ে যাবেন, আমরা অহরহ দেখছি। কিছু কিছু শিক্ষার্থী এর মধ্যে থেকে ইংরেজি শিখেছে। তারা কীভাবে শিখেছে ইংরেজি পত্রিকা পড়ে, ইংরেজি গল্পের বই পড়ে যেখানে অরজিনাল ইংরেজি লেখা আছে, যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি তারা সেগুলো লিখেছেন, আর যাদের ইংরেজি মুভি দেখার শখ তারা সেগুলো দেখে দেখে ইউটিউব, গুগল থেকে ইংরেজি কথোপকথন শুনে, পড়ে, আর্ন্তজাতিক টেস্ট দেখে দেখে ইংরেজি শিখেছেন।
চলবে….
লেখক: প্রেসিডেন্ট, ইংলিশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইট্যাব)
আরএ/