ধারাবাহিক উপন্যাস পর্ব-৩৭
দ্য ফার্স্ট ম্যান
বস,আমরা এখন কী করব?
আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম তাহলে গেরিলায় যোগ দিতাম। ফ্রান্সে আর একটা লোকও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কৃষক হেসে ফেলে বলল, কী রকম ভোতাবুদ্ধি, তাই না?
জ্যাক বলল, তারা আপনার সঙ্গে থাকেন?
না, তিনি আলজেরিয়া সম্পর্কে একটা কথাও শুনতে চাননি। তিনি মার্সেইতে একটা আধুনিক অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন। মা আমার কাছে চিঠিতে লিখেছেন বাবা তার রুমের চারপাশে হাঁটাহাঁটি করেন।
আর আপনি?
ওহ, আমি তো থেকেই গেলাম। শেষ পর্যন্ত যা-ই ঘটুক আমি থেকেই গেলাম। আমার পরিবার আলজিয়ার্সে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমি এখানেই বুড়ো ব্যাঙের মতো কর্কশ স্বরে ডাকতে থাকব। যারা প্যারিসে আছে তারা এটা বুঝতে পারে না। আমরা ছাড়া আর কারা বুঝতে পারে? আরবরা।
ঠিক বলেছেন। আমরা উভয়ই যেন একে অপরকে বুঝতে পারি শুরু থেকেই। মানুষের একই রক্ত নিয়ে বোকারা আর নির্বোধেরা আমাদের পছন্দ করে। আমরা একে অন্যকে আরো কিছুদিন হত্যা করতে থাকব। একজন আরেকজনের বিচি কাটতে থাকব; একজন আরেকজনের ওপর অত্যাচার করতে থাকব। তারপর আমরা একসঙ্গে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য ফিরে যাব। দেশটা সেরকমই চাই। আরেকটু রস? হালকা একটু। আরেকটু পরে তারা দুজনই বাইরে বের হয়ে এলো। জ্যাক জিজ্ঞেস করল তার বাবা মাকে চিনতে পারে এমন কেউ আছে কি না। ভেইলার্ড বলল, না। যে বৃদ্ধ ডাক্তার তাকে পৃথিবীর আলোতে নিয়ে এসেছিলেন এবং পরে সলফেরিনোতেই অবসরে গেছেন তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। সেইন্ট আপোর্ত্রের সম্পত্তি দুবার হাত বদল হয়েছে। দুটো যুদ্ধে আরবের কর্মজীবি লোকেরা সবাই মারা গেছে; আরো কত জনের জন্ম হয়েছে। ভেইলার্ড বলেই চলল, এখানে সবকিছু বদলে যায়। পরিবর্তন খুব দ্রুত ঘটে। আর মানুষেরাও সব ভুলে যায়। তবে সেইন্ট আপোর্ত্রের খামারের কেয়ারটেকার তামজাল কিছু জেনে থাকতেও পারে। ১৯১৩ সালে তার বয়স বিশের কাছাকাছি ছিল। জ্যাক সিদ্ধান্ত নেয় যে করেই হোক তার জন্মস্থানটা দেখতে যাবে সে।
শুধু উত্তর দিক ছাড়া দেশটার বাকি সবদিক দূরবর্তী পাহাড় পর্বতে ঘেরা। দুপুরের রোদের তাপে পাথরের বড় বড় স্তুপ কিংবা উজ্জ্বল ঘন কুয়াশার মতো সেগুলোর চেহারা আবছা আবছা দেখা যায়। পাহাড়গুলোর মাঝখানে উত্তরে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত সূর্যের তাপে সাদা হয়ে যাওয়া আকাশের নিচে এক সময়ের জলাপূর্ণ সাইবুজ সমতল ভূমি। সেখানকার সারিবদ্ধ আঙুরের গাছগুলোর পাতা কপার সালফেটে নীলাভ হয়ে গেছে। আর আঙুরগুলো ইতোমধ্যে গাঢ় রং ধারণ করেছে। মাঝে মাঝে দেখা যায় সাইপ্রেস কিংবা ইউক্যালিপটাসের ঝাড়, নিচের বাড়ি ঘরগুলো ছায়া দিয়ে ঢেকে রেখেছে। খামারের ভেতর দিয়ে হাঁটা পথে এগোচ্ছে জ্যাক এবং ভেইলার্ড। তাদের পায়ের নিচ থেকে লাল রঙের ধূলা উড়ে যাচ্ছে। পাহাড় পর্যন্ত সারাটা পথ বাতাস মরিচীকার মতো কাঁপছে। সূর্যের তাপ ঢেউ খেলে যাচ্ছে। সাধারণ গাছপালা গুচ্ছের পেছনে একটা বাড়িতে যখন তারা পৌঁছে তাদের শরীর থেকে ঘাম চুইয়ে পড়তে থাকে। আড়ালে কোথা থেকে যেন একটা কুকুর রাগান্বিত স্বরে ঘেউ ঘেউ করে তাদের স্বাগত জানায়।
প্রায় ভাঙা একটা ঘরের তুঁতকাঠের তৈরি দরজাটা যত্নে করে বন্ধ করা। ভেইলার্ড দরজায় টোকা দিলে কুকুরটা আগের মতোই চিৎকার দিয়ে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। ঘরের অন্য পাশের ঘেরা দেওয়া উঠোন থেকে মনে হয় শব্দটা আসছে। কিন্তু কারও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। ভেউলার্ড জ্যাককে বলে, কী রকম বিশ্বাসী আমরা একে অপরের প্রতি! লোকজন আছে। কিন্তু অপেক্ষা করছে।
ডাক ছেড়ে বলল সে, তামজাল, আমি ভেইলার্ড।
এরপর জ্যাককে উদ্দেশ করে বলল, ছয় মাস আগে তার জামাতার খোঁজে লোক এসেছিল। তারা জানতে এসেছিল, সে গেরিলাদের কোনো কিছু সরবরাহ করছে কি না। তাকে নিয়ে যাওয়ার পরে তার সম্পর্কে আর কোনো খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি। পরে লোকজন তামজালকে বলেছে, হয়তো পালাতে গিয়ে সে মারা পড়েছে।
জ্যাক বলল, আহ্ কী ভয়াবহ কথা! সে কি আসলেই গেরিলাদের সরবরাহকারী ছিল?
কী জানি; হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। যুদ্ধের সময় আর কী-ই বা আশা করা যায়। তবে এ থেকে বোঝা যায়, এই আতিথেয়তার দেশে কী কারণে দরজা খুলতে দেরি হয়।
ঠিক তখনই দরজা খুলে গেল। তামজাল বের হয়ে এল। ছোটখাটো শরীরের একজন মানুষ; মাথায় চারপাশে ছড়ানো একটা হ্যাট, জোড়াতালি দেওয়া একটা ওভারল। ভেইলার্ডের দিকে হাসি দিয়ে জ্যাকের দিকে তাকাল।
ভেইলার্ড পরিচয় করিয়ে দিল, একজন বন্ধু।
তামজাল বলল, ভেতরে আসুন; আপনারা চা খাবেন।
তামজালের তেমন কিছু মনে নেই। হ্যাঁ, হতে পারে: তার এক চাচার মুখে একজন ম্যানেজারের কথা শুনেছে। তিনি নাকি যুদ্ধের পরে কয়েক মাস এখানে ছিলেন।
জ্যাক বলল, যুদ্ধের আগে।
হ্যাঁ, আগেও হতে পারে; সেটাও সম্ভব। তার বয়স তো তখন খুব অল্প ছিল। যা-ই হোক তার বাবার কী হয়েছিল?
তিনি যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। তামজাল বলল, কপালের লিখন; তবে যুদ্ধ জিনিসটা খুব খারাপ।
ভেইলার্ড বলল, যুদ্ধ সব সময়ই চলছে। তবে মানুষ খুব তাড়াতাড়িই শান্তির সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কাজেই তাদের মনে হয় এরকমটাই স্বাভাবিক আসলে কোনো যুদ্ধই অন্য সব স্বাভাবিক বিষয়ের মতো নয়।
পাশের ঘরে তার স্ত্রী অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে চায়ের ট্রে হাতে। তার কাছ থেকে ট্রেটা আনতে যেতে যেতে তামজাল বলল, যুদ্ধের সময় মানুষেরা ক্ষেপাটে হয়ে থাকে।
তারা আগুন গরম চা শেষ করে তামজালকে ধন্যবাদ দিয়ে কঠিন তাপের নিচে দগ্ধ আঙুর ক্ষেতের মধ্য দিয়ে বয়ে যাওয়া পথে বের হয়ে পড়ল।
জ্যাক বলল, আমি ট্যাক্সি নিয়ে সলফেরিনোতে যাচ্ছি। ডাক্তার সাহেব আমাকে দুপুরের খাবারে নিমন্ত্রণ করেছেন।
তার কথা শুনে ভেইলার্ড বলল, সঙ্গে আমি নিজেকে নিমন্ত্রণ করছি একটু অপেক্ষা করুন। সামান্য খাবার নিয়ে আসছি।
পরবর্তীতে আজিয়ার্সগামী বিমানে বসে জ্যাক প্রাপ্ত তথ্যের মধ্যে থেকে বাছাই করতে লাগল। আসলে সে সামান্য তথ্যই পেয়েছে। তার বাবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তেমন কোনো তথ্য নেই বললেই চলে। রাতটা অদ্ভুতভাবে যেন মাটির পৃথিবী থেকে পরিমাপযোগ্য ছন্দে উপরের দিকে উঠে যাচ্ছে। অবশেষে রাত বিমানটাকে এমনভাবে গিলে ফেলছে যেন রাতের শরীরে স্ক্রু ড্রাইভারের মতো গেঁথে দেওয়া হচ্ছে বিমানটাকে। তবে রাতটা জ্যাকের অস্বস্তিতে যেন আরো কয়েক মাত্রা যোগ করে দিচ্ছে। কেননা নিজেকে সে দুভাবে আটক বলে মনে করতে থাকে: প্রথমত বিমানের মধ্যে, দ্বিতীয়ত রাতের অন্ধকারের মধ্যে। নিঃশ্বাস ফেলতেই তার কষ্ট হতে থাকে। আবারও সে জন্ম নিবন্ধনের খাতায় প্রত্যক্ষদর্শীদের নাম দেখে। দুটো ফরাসি নাম; এরকম নাম প্যারিসের বিভিন্ন সংকেতে দেখা যায়। তার বাবার আগমন এবং তার জন্ম সম্পর্কে বলার পর ডাক্তার বলেছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা ছিল স্থানীয় দোকানদার। তাদের মধ্যে প্রথমজন তার বাবাকে সহযোগিতা করতে রাজী হয়েছিল। তাদের নাম প্যারিসের উপশহরের নামের মতো। তবে সেটা কোনো বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। কারণ সলফেরিনো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আটচল্লিশাদের দ্বারা।
ভেইলার্ডও বলেছে, ও হ্যাঁ, আমার দাদার বাবা মা ও তাদেরই অন্যতম। কাজেই আমার বাবার জিনের মধ্যেও বিপ্লব ছিল। সে আরো জানিয়েছে, তার পূর্ব পুরুষদের একজন ছিল ফবর্গ সেইন্ট-ডেনিস কাঠমিস্ত্রি; তার স্ত্রী ছিল ধোপানি। ফ্রান্সে তখন বেকার সমস্যা প্রকট এবং মানুষের মাঝে অস্থিরতাও ছিল। নির্বাচকম-লীর শাসনতন্ত্র নতুন বসতিস্থাপনকারীদের জন্য পঞ্চাশ মিলিয়ন ফ্রাঁ দানের অনুমোদন দিয়েছিল। সবার জন্য একটি করে ঘর এবং দুই থেকে দশ হেক্টর করে জমি দানের প্রতিজ্ঞা করেছিল। ভেইলার্ড বলে চলে, বুঝতে পারছেন, কী রকম কৌশল ব্যবহার করা হয়েছিল। হাজার হাজারেরও বেশি মানুষ প্রতিজ্ঞ ভূমির স্বপ্ন দেখেছিল। বিশেষ করে নারী পুরুষেরা অচেনা জায়গা সম্পর্কে ভীত ছিল। পুরুষেরা এমনি এমনি বিপ্লব করতে চায়নি। তারা সবাই সান্তা ক্লসে বিশ্বাস করার মতো মানুষ ছিল। আর তাদের সেই সান্তা ক্লস পরিধান করেছিল বুর্নুস। হ্যাঁ, এ কথা ঠিক যে, তারা এক ধরনের সান্তা ক্লস পেয়েছিল। তারা যাত্রা করেছিল ’৪৯ সালে এবং প্রথম ঘর তৈরি হয়েছিল ’৫৪ সালের গ্রীষ্মে। ততদিনে...।
চলব...
এমএমএ/