ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব-৩৯
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা
সবাই চিৎকার করতে করতে যে যার পথে যেতে শুরু করে। বাংলাদেশ শব্দে মুখর হয়ে ওঠে যশোর রোড। মুজফফর আর লুৎফা হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সীমান্ত পর্যন্ত যায়। লুৎফা মাটিতে বসে পড়ে দেশের মাটিতে মাথা ঠেকায়। কপালে লেগে থাকে মাটির ছোঁয়া।
মুজফফর ওর দিকে তাকিয়ে বলে তাঁবুতে ফিরলে কপালের মাটি পুরো মাথায় ঘঁষে দিও।
-এখনই দিব। মাথা ভরে যাক মাটিতে।
লুৎফা কপালে লেগে থাকা মাটি টেনে মাথার চুল মাখায়। পেছন থেকে চুল টেনে কপালের মাটি মোছে। একসময় ধপ করে বসে পড়ে মাটিতে হাত ঘঁষে চুলে লাগায়।
মুজফফর ধমক দিয়ে বলে, বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এত মাটি লাগালে চুল নষ্ট হবে।
-নষ্ট হলে আমার চুল হবে। তোমার কি?
-আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমার মন খারাপ হচ্ছে। চলো ওই দূরের পানিতে তোমাকে নিয়ে যাই। ওখানে গিয়ে মাথা ধুয়ে ফেল।
-ধুয়ে ফেলব না। মাটি আর পানি এক করব।
-এটাইতো মাথা থেকে সরিয়ে দেয়া।
-হ্যাঁ, তা ঠিক বলেছ। মাটিকে পানিতে মিশিয়ে দিলে পানি মাটিকে ওর তলদেশে নিয়ে যাবে।
-চলো, চলো। এখানে আর বেশিক্ষণ থাকার দরকার নাই।
-আমি পানিতে নামবনা। আমার মাথায় মাটি থাকবে। তাঁবুতে ফিরে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়ব।
-মাথায় মাটি নিয়ে ঘুম আসবে?
-আসবে। মনে করব স্বাধীন দেশকে মাথায় নিয়ে ঘুমাচ্ছি।
মুজাফফর আর কথা বলেনা। বুঝতে পারে এসব দিয়ে কথা বলে লাভ নেই। লুৎফা নিজের ধারণা থেকে সরবেনা। নিজে যা করেছে তাকে নিজের মতো করে ধরে রাখবে। তবে এটা ঠিক যে ও একটি বড় চিন্তা করছে। নিজেকে ডুবিয়েছে সেই চিন্তায়। ওর সঙ্গে তর্ক করে আর লাভ নেই। মুজফফর ওর হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে। দু’পা হাঁটার পরই লুৎফা হাত ছাড়িয়ে নেয়। মাথা থেকে ঝরতে থাকে মাটির কণা মুজফফর মাঝে মাঝে চুলের সঙ্গে লেগে থাকা মাটি হাত দিয়ে মুছে দেয়।
লুৎফা আপত্তি জানিয়ে বলে, মুছে দিচ্ছ কেন? এটাতো শুধু মাটি না, এটা আমার স্বাধীন দেশ। মাথায় নিয়ে হাঁটছি।
-আচ্ছা, ঠিক আছে। আর মুছবনা। তোমার চিন্তা আমাকেও স্বাধীন দেশের মানুষ করল। তাঁবুতে গিয়ে তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকব। আজকের শুয়ে থাকা হবে একদম অন্যরকম।
লুৎফা আর কথা বলেনা। দ্রæতপায়ে হাঁটতে থাকে। কাছাকাছি কোথাও থেকে শুনতে পায় গানের সুরে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশ বাংলাদেশ। দুহাত মাথায় রেখে মুজাফফরের দিকে তাকিয়ে বলে, বাংলাদেশ আমার মাথায়।
-ঠিক বলেছ। তোমার চিন্তায় আমিও ব্যাকুল হয়ে গেছি। চলো দৌড়াই।
-না, দৌড়াবনা। লোকজন কিছু না বুঝে হাসাহাসি করবে।
- হাসুক না, আমাদের কি যায় আসবে
-আমার খারাপ লাগবে। নিজের কোনো আচরণ দেখে অন্যদের ব্যঙ্গের হাসি আমি সহ্য করতে পারিনা।
-ঠিক বলেছ। আমি আমার জীবনে অনেক কিছু উপেক্ষা করতে চাই। তবে তোমার ভাবনা মান-সম্মানের। তুমি আমার চেয়ে বড় ভাবনায় আছ।
লুৎফা গভীর দৃষ্টিতে মুজফফরের দিকে তাকায়। মুজফফর কথা না বলে নিজের মাথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নেয়। দুজনে ধীর গতিতে হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেদের তাঁবুতে এসে ঢোকে। লুৎফা গুণগুনিয়ে বলতে থাকে, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ।
মুজফফর একসময় ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, মনে রেখ আমরা আর কোনোদিন যেন পূর্ব পাকিস্তান না বলি। আমাদের কাছে পূর্ব পাকিস্তান শব্দ আর থাকবে না।
-ঠিক, ঠিক। বাংলাদেশ বাংলাদেশ
-লুৎফার গানের সুরে উচ্চারিত শব্দ ভরে দেয় তাঁবুর পরিধি। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরে। লুৎফা মাথা ঘঁষতে থাকে মুজফফরের বুকে।
চারদিক থেকে সবাই চিৎকার করে বলে, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। মুজফফর আর লুৎফা উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। সবার কন্ঠের সঙ্গে নিজেদের কন্ঠ মেলায়। দেখতে পায় একটু পরে তিনি চলে যাচ্ছেন। অনেকেই তাঁর পেছনে পেছনে হাঁটে, কিন্তু বেশিদূর যেতে পারেনা। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে সবাইকে নিষেধ করেন। মুজফফর আর লুৎফা সীমান্তের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। সামনের দিকে তাকিয়ে দূরে পাকিস্তানি বাহিনীকে দেখে দৌড়াতে দৌড়াতে অন্যদিকে চলে যায়। এক জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে একজন বলে, ওই দেখেন ঐটা ভারতের বয়ড়া গ্রাম। এই গ্রামের পাশেই আমাদের চৌগাছা। মুজফফর লুৎফার হাত ধরে বলে, চলো ওখান থেকে ঘুরে আসি।
চলবে..
শরণার্থীর সুবর্ণরেখা। পর্ব- ৩৩